ফরহাদ মজহার অপহরণের নেপথ্য কারণ!

আলোচিত ফরহান মজহার অপহরণের নেপথ্য কাহিনী নিয়ে বিশাল ফেইস বুক স্ট্যাটাস লিখেছেন অস্ট্রেলিয় প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারী। সেটা ব্রিটবাংলার পাঠকের সামনে তুলে ধরা হল।

ডানপন্থী,  ভারত বিরোধী এবং বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত-পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’! তবে গুম করতে নয়। শায়েস্তা করতে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে তাদের ডাকা ভারত বিরোধী এক সংবাদ সম্মেলন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া ত্বরান্বিত করে। সরকারের শীর্ষ মহল তার বিনাশ না চাওয়ায়, তাকে উদ্ধারে সক্রিয় হওয়াতে তিনি এভাবে দ্রুত ফিরে এসেছেন। যেটি প্রকাশ পেয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ফরহাদ মজহারকে যদি সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়া হতো তা হতো সরকারের জন্যে বেশি বিপদের। আর ফিরে এসে চিহ্নিত আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী মজহার বলেছেন,  যারা সরকারকে বিব্রত করতে চায় তারাই তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল! পুরো ঘটনার বৃত্তান্ত অথবা গল্পটি এখানে বলি। যার যার মতো মিলিয়ে দেখতে পারেন।
ওয়াকিফহালরা জানেন বাংলাদেশে অনেকগুলো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা  সক্রিয়! বিশেষ করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, মার্কিন, রুশ, ব্রিটিশ, ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সক্রিয় ভূমিকার কথা। ঢাকাস্থ বেশির ভাগ বিদেশি হাইকমিশন, দূতাবাসের কর্মী-কর্মকর্তাদের অনেকে নানা পদের নামের আড়ালে আসলে একেকজন পেশাদার গোয়েন্দা! এরা বাংলাদেশে যার যার দেশের সামরিক, রাজনৈতিক, বানিজ্যিক সহ নানা স্বার্থ দেখে। এটা অবশ্য শুধু বাংলাদেশ বলে কথা নয়। বিশ্বের নানা দেশের ক্ষেত্রেই এমনটি বাস্তব সত্য।
এখন জানা যাক কী কারনে ভারতীয় গোয়েন্দাদের বিরাগভাজন অথবা বদ নজরে ফরহাদ মজহার। ডানপন্থী এই কবি, লেখক এবং এনজিও ব্যবসায়ী অনেকদিন ধরে ভারতের বিচ্ছিনতাবাদীদের ঘনিষ্ঠজন। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্সের রাজ্যগুলোর স্বাধীনতার সমর্থক অথবা তাদের জন্য কাজ করছেন। র’ মনে করে এর পিছনে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’এর যোগসাজশ অথবা অর্থায়ন আছে। ফরহাদ মজহারের এই তৎপরতার সঙ্গে সাবেক আমলা, খালেদা জিয়ার বিশেষ প্রিয়ভাজন মাহমুদুর রহমান সহ আরও কয়েকজন সংশ্লিষ্ট। একই সূত্রে এই মাহমুদুর রহমান-ফরহাদ মজহার হেফাজতেরও বিশেষ ঘনিষ্ঠ। ফরহাদ মজহার অপহরন, উদ্ধার দুই পর্বে বিএনপির বাইরে যে সংগঠনটি কথা বলেছে, বিবৃতি দিয়েছে সেটির নাম হেফাজত। কারন তাদের তাদের লিটারেচার সহ নানাকিছু যারা লিখে দেন ফরহাদ মজহার তাদের অন্যতম। বাংলাদেশের আরেকটি সত্য হচ্ছে এখানে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকলে আইএসআই আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে র’ স্বাধীনভাবে অথবা সরকারের সহায়তায় কাজ করে।
সর্বশেষ গত রোববার কাশ্মীরে মুসলিম নিধন নিয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলন ডাকেন মাহমুদুর রহমান ও ফরহাদ মজহার। পুলিশি বাধায় সেই সংবাদ সম্মেলন ঠিক সময়ে হতে পারেনি। তবে বাধা এড়িয়ে এক পর্যায়ে তা হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়াতেও সেই অপহরনের ঘটনা ঘটে। ফরহাদ মজহারকে ফোন করে বলা হয়, তাকেও মাহমুদুর রহমানকে ধরে নিয়ে যেতে তাদের বাসায় পুলিশ যাচ্ছে। গ্রেফতার হতে চান না একদার বিপ্লবী(!) ও আজকের বদলে যাওয়া ফরহাদ মজহার। সে কারনে  আত্মগোপনে যাবার উদ্দেশেই সেই সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতপন্থী এই বুদ্ধিজীবী। একজন লোক আত্মগোপনে যেতে ফোনের চার্জার সহ জরুরি যা যা তার সঙ্গে থাকা দরকার সবই তিনি সঙ্গে নেন। নিজেকে ভীষন চালাক এবং ধূর্ত মনে করেন ফরহাদ মজহার। আসলে বোকারাই নিজেদের অতিচালাক ভাবে। সে কারনে যারা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারাই যে তাকে ফোন করে বাসা থেকে বের করেছে তা তিনি ধরতে-বুঝতে পারেননি।
সিসিটিভির ফুটেজে ফরহাদ মজহারের বাসা থেকে বেরুবার দৃশ্য যারা দেখেছেন তারা হয়তো খেয়াল করেছেন তারা বেরুবার দৃশ্যটিতে একটি ত্রস্ত ভাব রয়েছে! যেন ‘তারা ধরে নিয়ে যেতে আ’য়া পড়তেছে তার আগে ভাগি’ জাতীয় একটা  ভাব ছিল সেই দৃশ্যে। এবং যাদের ভয়ে ফরহাদ পালাচ্ছিলেন, ‘ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া’ তাদের অপেক্ষমান মাইক্রোবাসে করেই তাকে তুলে নেয়া হয়। ফরহাদ মজহারের কথাবার্তায় অনেক অসঙ্গতি আছে। যারা তাকে ধরে নিয়ে গেছে তাদের তিনি অন্তত ধরে নিয়ে যাবার সময় দেখেছেন। কিন্তু স্বীকারোক্তিতে তা চেপে গেছেন অথবা তাকে চেপে যেতে বলা হয়েছে।
ফরহাদ মজহারের বক্তব্য অনুসারে অপহরনকারীরা তাকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। মাইক্রোবাসে তোলার পরপরই তারা তার চোখ বেঁধে ফেলে! আবার মজহার নিজে তার পার্টনার ফরিদা আখতারকে ফোন করে বলেছেন, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হয়তো তারা তাকে মেরে ফেলবে! প্রশ্ন উঠতে পারে ফরিদাকে তিনি ফোন কখন করেছেন? চোখ বাঁধার আগে না পরে? এরপর বলা হয় মজহার ওই ফোনটি করার পরপর অপহরনকারীরা তার ফোন সেটটি কেড়ে নিয়ে যায়! তাহলে এরপরও তিনি যে পাঁচবার ফোন করেছেন সেটি কী করে করলেন? অপহরনকারীদের সঙ্গে সমঝোতায়? তাহলে নিশ্চয় তার সঙ্গে তাদের আরও কথাবার্তা হচ্ছিলো তা কী চোখ বাঁধা না খোলা অবস্থায়? ফরহাদ মজহার এখনও অনেক কথা বলছেননা বা খোলাসা করছেননা যা তার স্বভাব বিরুদ্ধ।
প্রাথমিক না তথ্য আর ১৬৪ ধারার জবানবন্দীতে স্পষ্ট ফরহাদ মজহার প্রথম থেকে তাকে যারা ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো তাদেরকে অপহরনকারীই মনে করেছেন। অপহরনকারীরা মূলত টাকা পয়সা চায়। কিন্তু তারা তার কাছে টাকা-পয়সা চাইছিলোনা! টাকার কথা তুলেছেন মজহার নিজেই! টাকার বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দেবার জন্যে কাকুতি মিনতি করছিলেন! তখন তার সঙ্গে থাকা লোকজন জানতে চায় কত টাকা তিনি দিতে পারবেন? তখন ৩৫-৪০ লাখের কথাটি বলেন ফরহাদ মজহার। তখন ওই লোকগুলোই ঘটনাটিকে অপহরনের রঙ দিতে অথবা বিভ্রান্ত করতে তাদের সামনে টাকার কথাটি তাকে ফোনে বলতে বাঁধা দেয়নি।
এর পরের প্রসঙ্গ ফরহাদ মজহারকে ওইপথ দিয়ে কোথায় নেয়া হচ্ছিলো? ভারতে নিয়ে যাবার কথা থাকলে বেনাপোল অথবা ভোমরা সীমান্ত অথবা অচিহ্নিত কোন সীমান্ত দিয়ে তারা তাকে নিয়ে যেতে পারতো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট সরকার চায়নি তাকে সীমান্তের ওপারে নেয়া হোক। এরজন্যে সব ধরনের সতর্কতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথবা তাকে সংশ্লিষ্টদের সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাবার কোন চিন্তাই ছিলোনা। থেরাপি যা দেবার পথে গাড়িতেই দেয়া হয়েছে! এবং খুলনা পৌঁছবার পর তাকে রাস্তায় পরিত্যক্ত করে ছেড়ে দেয়া হয়। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে ঝোলা ব্যাগ থাকতো, ব্যাগে টাকা থাকতো এসব তার পরিজন বলেছেন। এরজন্যে তার খুলনায় খাবার দোকানে গিয়ে পছন্দ করে খাবার খাওয়া, বাসের টিকেট কেনা এসবে কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু বাসের টিকেট তিনি গফুর নামে কেনো কিনলেন, এর উত্তর এখনো তিনি বা কেউ দেয়নি। আর বাসে উঠে একেবারে শেষ আসনে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন বিএনপি-হেফাজতের প্রিয় বুদ্ধিজীবী ওরফে গফুর! গল্পগুলো নিশ্চয় পরবর্তিতে আরও নানাভাবে আসবে।
এরপর আবার আরেক ক্রাইসিস দেখা দেয় ফরহাদ মজহারের মালিকানা নিয়ে! পুলিশ বাস থামিয়ে রাখে নোয়াপাড়ায়। কিন্তু পুলিশের কাছ থেকে তাকে একরকম ছিনতাই করে নেয় র্যাব! পরে আবার র‍্যাবের হাত থেকে তাকে চিনিয়ে নিতে পুলিশকে পথেপথে ব্যারিকেড দিতে হয়েছে! কী নৈরাজ্য প্রশাসনের ভিতরে!
এরপর ফরহাদ মজহারকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। থানায় তার পার্টনার-মেয়েকে তিনি যেভাবে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন, সেই ছবি দেখে মনে হয়ে তিনি এবং তার স্বজনরা এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছেন। তার পার্টনার ফরিদা আখতার বলেছেন, তাকে ফিরে পেয়েছেন তাতেই তিনি খুশি। যেমন বলেছিলেন পরিবেশবাদী সৈয়দ রিজোয়ানা তার স্বামী ফিরে আসার পর। ফরহাদ মজহারের গল্পগুলো এখনও বলা হচ্ছেনা। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ত্রাসী বলা এই লোকটির প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোন সহানুভূতি, শ্রদ্ধাবোধ নেই। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে  ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে যে কখনো আইএসআই, কখনো র’ বা বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা নির্ভয় কাজ করছে এসব বোধ করি বন্ধ হওয়া দরকার।
ফজলুল বারী: অস্ট্রেলিয় প্রবাসী সাংবাদিক।

Advertisement