ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেফতার যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া জেলে বসেই ‘বসগিরি’র পরিকল্পনা করছেন। ক্যাসিনোসহ অবৈধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন গারদে বসেই। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভয়ংকর ১৫ কিলারকে এরই মধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন খালেদ। বসের নির্দেশনা পেয়ে মাঠে কাজে শুরু করে দিয়েছে ওই কিলাররা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র, খালেদের ঘনিষ্ঠ একাধিক সহযোগীর জবানি এবং এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
প্রায় দুই মাস আগে খালেদ র্যাবের হাতে গ্রেফতার হলেও তার অস্ত্রধারী ক্যাডারদের কেউ গ্রেফতার হয়নি। তার বিশাল অস্ত্রভাণ্ডারও এখন পর্যন্ত অক্ষত।
এই ১৫ কিলার ঢাকার আলোচিত সব হত্যা মামলার আসামি। তাদের হাতেই রয়েছে খালেদের সব আগ্নেয়াস্ত্র। এদের মাধ্যমেই একসময় খালেদ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। এখন জেলে বসেই ফরিকাপুল, পল্টন, রামপুরা, খিলগাঁও, সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিল, রমনাসহ আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। তারা ক্যাসিনো, ফুটপাত, বিভিন্ন স্থাপনায় চাঁদবাজি শুরু করে দিয়েছেন।
খালেদের এই ১৫ ক্যাডারের হাতে রয়েছে শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র। এর মধ্যে ৪টি অত্যাধুনিক অভিজাত অস্ত্র একে-২২। অধিকাংশ অস্ত্রই চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বাবর চট্টগ্রামে জোড়া খুনসহ ১৬টি মামলার আসামি। চট্টগ্রাম থেকে অস্ত্রের চালান আসত ট্রেনে। বাবরের বন্ধুর পল্টনের অস্ত্রের দোকান থেকেও খালেদের কাছে অস্ত্র যেত। অস্ত্র মজুদ করা হতো ঢাকার শান্তিনগরের চামেলীবাগের একটি বাসা এবং কমলাপুরের একটি বাসায়। চামেলীবাগের বাসাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক জনপ্রতিনিধির। আর কমলাপুরের বাসাটির মালিক একজন চিকিৎসক। তারা দু’জনেই খালেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, খালেদের প্রধান সহযোগীর নাম বেলাল হোসেন কিসলু ও রইছ উদ্দিন। তারা দু’জনেই শীর্ষ সন্ত্রাসী কাইল্লা পলাশের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। ২০০৫ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে বনশ্রীর ক্রিস্টাল ক্যাবল নেটওয়ার্কের অফিসে মিথুন ও টিটু খুনের অন্যতম আসামি তারা। রনি ও সজিব নামের দুই ভাড়াটে কিলারও এই ডাবল মার্ডার কেসের আসামি। তারা খালেদের হয়ে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু ডাবল মার্ডার নয়, ক্যাবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২০১৪ সালে মগবাজারে মাহবুবুর রহমান রানা হত্যার সঙ্গে জড়িত রইছ, রনি ও সজিব। খালেদের আরেক সহযোগী ফখরুলও এই রানা হত্যায় জড়িত। শাহাদাত হোসেন সাধু, রাসেল ও সোহাগ নামে আরও তিন ভাড়াটে কিলার খালেদের দলে যোগ দিয়ে নগরীর ত্রাস হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে।
এদিকে ২০১৩ সালে আলোচিত যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যা মামলার তিন আসামিকে পুনর্বাসিত করেন খালেদ। এই তিনজন হল- কাইল্যা আমিনুল, অঙ্কুর ও উজ্জ্বল মোর্শেদ। তাদের কাছেও খালেদের অস্ত্রভাণ্ডারের অনেক অস্ত্র রয়েছে। ২০১০ সালে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ নেতা ডা. নিতাই হত্যা মামলার দুই আসামি কবির ও পারভেজকে দলে ভিড়িয়েছে খালেদ। কবিরের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে। খালেদের আরেক সহযোগী পল্টি রিপন ২০০৭ সালে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাওছার হত্যা মামলার আসামি। আরেক সহযোগী সেলিম মহাখালীতে আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিক হত্যা মামলার আসামি।
খালেদের অস্ত্রভাণ্ডারের মূল নিয়ন্ত্রক কিসলু : অনুসন্ধানে জানা যায়, কিসলু নিজেকে খালেদের ভাই হিসেবে পরিচয় দেয়। সে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করত। টেন্ডার কিংখ্যাত জি কে শামীমের সঙ্গেও ছিল তার ঘনিষ্ঠতা। খালেদের অস্ত্রভাণ্ডারের ভারী অস্ত্রগুলো তার কাছেই রয়েছে। এছাড়া ছোট ছোট অনেক আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদও তার কাছে। কিসলুকে আইনের আওতায় আনা গেলে খালেদের অস্ত্রসাম্রাজ্যের যাবতীয় তথ্য জানা যাবে।
খালেদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত সোহরাওয়ার্দী জানান, বাবরের মাধ্যমে খালেদ অস্ত্র সংগ্রহ করত। বায়তুল মোকাররম মসজিদের উল্টোপাশে পল্টনে বাবরের এক বন্ধুর একটি বৈধ অস্ত্রের দোকান আছে। বৈধ অস্ত্রের আড়ালে সেখানেও চলে অবৈধ অস্ত্রের কারবার। বাবর তার কাছ থেকেও অস্ত্র নিয়ে খালেদকে দিয়েছে। একটি সূত্র জানায়, অস্ত্র ও ইয়াবার বিনিময়ে খালেদ ব্যাগভর্তি করে বাবরকে টাকা দিত। সেই টাকা নিয়ে বাবর বিমানে করে চট্টগ্রামে যেত। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর বাবর দুবাইয়ে পালিয়ে যায়।
খালেদের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, প্রায় দুই মাস আগে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় গ্রেফতার হন খালেদ। ওই সময় তার ধারণা ছিল, দ্রুতই জামিনে মুক্ত হবেন তিনি। কিন্তু এখন তিনি বুঝতে পারছেন সহজে তার মুক্তি মিলছে না। এ কারণেই এখন তার পরিকল্পনা- জেলে বসেই সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা। জেলে বসেই সহযোগীদের নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেছেন, রামপুরা, খিলগাঁও, সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিল এবং রমনা এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিকের সঙ্গে যেন তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখে। দীর্ঘদিন ধরে মজুদ করা আগ্নেয়াস্ত্র যেন খোয়া না যায়, এ বিষয়েও ঘনিষ্ঠদের নির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি।
উল্লেখ্য, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। ১৯৮৯ সালে ফ্রিডম পার্টির নেতাদের নেতৃত্বে শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হামলা হয়। ওই হামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহম্মদ মানিক, সৈয়দ নাজমুল মাহমুদ মুরাদ এবং তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী খালেদ সরাসরি অংশ নেয়। পরে কৌশলে চার্জশিট থেকে খালেদের নাম বাদ দেয়া হয়। এই তথ্য জানিয়েছেন খালেদের দীর্ঘদিনের সহযোগী মোহাম্মদ আলী।
র্যা বের এক কর্মকর্তা বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর খালেদের বাবা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। তখন তিনি ধীরে ধীরে শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার অনেক নথি নষ্ট করে ফেলেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এক সময় খালেদের নামটিও কৌশলে অভিযোগপত্র থেকে বাদ যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যাসিনো খালেদ একসময় ফ্রিডম পার্টি করতেন। পরে যুবদলের রাজনীতি করেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে যুবলীগ নেতা বনে যান। বহুরূপী খালেদের উত্থান শুনে গা শিউরে উঠে অনেকের।
এই খালেদই শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টায় অংশ নেন। তবে মৃত দেখিয়ে অভিযোগপত্র থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খালেদ মারা যাননি।
১৯৮৯ সালে ফ্রিডম পার্টির নেতাদের নেতৃত্বে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হামলা হয়। ওই হামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহম্মদ মানিক, সৈয়দ নাজমুল মাহমুদ মুরাদ এবং তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী খালেদ সরাসরি অংশ নেয়।
এ ঘটনার ৮ বছর পর মানিক-মুরাদের সঙ্গে খালেদের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে সূত্রাপুর থানার একটি হত্যা মামলার সূত্র উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘খালেদ’ মারা গেছে। কখন, কীভাবে সে মারা গেছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।