বাংলাদেশে পুরুষ কোন সূত্রে নারীর অভিভাবক সেজে বসে আছে?

:: আফরোজা সোমা :: তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সাংবাদিকতা করি একটি অনলাইন বার্তা সংস্থায়। একদিন সচিবালয়ের সামনে দিয়ে হেঁটে প্রেসক্লাবে যাচ্ছি। প্রেসক্লাবের রাস্তায় ঢোকার মুখেই দেখি সচিবালয়ের পাশে ফুটপাথে এক যুবক ভিখিরি।

হাঁটুর উপর থেকে তার দুটি পা-ই কাটা। আকুলতায় সাড়া দিয়ে কিছু অর্থ তার থালায় রেখে আমি ফিরে যাবার সময় তিনি বললেন: ‘আপা, কিছু মনে কইরেন না। একটা কথা বলি’। ‘বলেন’, উত্তর দিলাম। তিনি বললেন: ‘আপা, আপনি মেয়ে মানুষ; ওড়না পইড়েন’।

হতভম্ব হলাম। কিন্তু এ নতুন কিছু নয়। রিকশায় উঠার পর অসংখ্যবার রিকশা-চালক নিজ দায়িত্বে হুড উঠিয়ে দিতে গেছেন। নিরস্ত করেছি। নিরস্ত হলেও কেউ-কেউ শুনিয়েছেন: ‘মেয়ে মানুষ হুড দিয়া যাওয়া ভালো।’

অমঙ্গল চেয়ে এসব পরামর্শ তারা দেননি, জানি। বরং সুরক্ষাই চেয়েছেন। কিন্তু আমাদের সামাজিক মনস্তত্ত্বে পুরুষ মাত্রই কেন নারীর অভিভাবক? নারী প্রশ্নে কী ভিখিরি কী আমির, অশিক্ষিত কী কামেল — অধিকাংশ পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি এমন সমধর্ম হয় কী করে?

তার মানে আমাদের সমাজে এমন কিছু মূল্যবোধ পরোক্ষে ও প্রত্যক্ষে বিরাজমান যা পুরুষকে ‘প্রবল’ নারীকে ‘দুর্বল’, পুরুষকে ‘প্রধান’ নারীকে ‘সহকারী’ হিসেবে ভাবার অনুষঙ্গ মনে গেঁথে দিচ্ছে।

রামায়ণে সীতা: লক্ষণ-গণ্ডি দিয়ে আটকে রেখেও শেষ রক্ষা হয়নি। তিনি অপহৃত হয়েছিলেন।
রামায়ণে সীতার নিরাপত্তায় এঁকে দেয়া হয়েছিল লক্ষণ-গণ্ডি। গণ্ডি পেরোনো মানা। কারণ গণ্ডির ওপারেই রাক্ষসকুল; ওপারেই ওঁৎ পাতা সমূহ বিপদ।

আজকের যুগে আমরা রাক্ষস-সংকুল রাজ্যে বাস করি না। তাহলে কেন আজেও সমাজের মনস্তত্ত্বে নারীর জন্য আঁকা থাকে লক্ষণ-গণ্ডি?

লক্ষণ-গণ্ডি দিয়েও সীতাকে রক্ষা করা যায়নি। তিনি অপহৃত হয়েছিলেন।

সমাজে পুরুষের অপরাধ-প্রবণতা কমে এলে নারীর জন্য আলাদা লক্ষণ-গণ্ডির প্রয়োজন হবে না। লক্ষণ-গণ্ডির দরকার না হলে পুরুষেরও আর নিজেকে নারীর রক্ষাকর্তা ভাবতে হবে না।

দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেলে অপরাধ প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সামাজিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি বদলের জন্য সম্মিলিতভাবে কিছু পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

এক্ষেত্রে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সবচে’ জরুরি।

নারীর চলাচলে কড়াকড়ি আরোপের বদলে অপরাধ-মনস্ক পুরুষের আচরণ নিয়ে ভাবতে হবে। যে পুরুষ নারীর শরীরে হাত দেয়া বা তাকে ধর্ষণযোগ্য ভাবে তার ভাবনা ও আচরণকে সামাজিক ও আইনি শোধন-প্রক্রিয়ায় আনতে হবে।

ঢাকায় প্রতিবাদী নারী: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈষম্য দূর করা সম্ভব।
এর পাশাপাশি, সমাজে ‘অপরাধ-প্রবণ পুরুষ’ মানসিকতা যাতে তৈরি না হয় সেদিকে মনোযোগ দেয়া জরুরি। অপরাধ করার মানসিকতাই যেনো একটি ছেলে শিশুর গড়ে না উঠে তেমন পরিবেশ বা সংস্কৃতি নির্মাণ দরকার।

বদলের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজন সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ। যেমন: নারীদেরকে অর্থনৈতিকভাবে আরো স্বাবলম্বী করার পথ সুগম করতে হবে। হয়তো আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের ক্ষেত্রে নারীর স্বাবলম্বন কীভাবে ভূমিকা রাখবে? বলছি।

আমাদের সমাজে সাধারণত ছেলেরাই সংসার চালানোর অর্থনৈতিক দায়িত্ব নেয়। তাই, তাদের পেছনেই অভিভাবকেরা বেশি লগ্নি করেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এখন অনেক নারীও সংসারের মূল দায়িত্ব পালন করছেন। তবে তা সংখ্যায় কম।

এই সংখ্যা যত বাড়বে কন্যা সন্তানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও পালটাবে। নারী স্বাবলম্বী হয়ে পিতৃ-পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়ার সংস্কৃতি চালু হলে অভিভাবকেরা কন্যাদেরকে বোঝা ভাববেন না। ছেলে ও মেয়ে পরিবারে সমান গুরুত্ব পেলে ছেলেটির আর ‘রক্ষাকর্তা মনোভাব’ নিয়ে বেড়ে উঠার বাস্তবতাই থাকবে না।

এর পাশাপাশি, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার বিষয়ক আইন পরিবর্তন করাটা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের দেশে মুসলিম বিধি মতে, পুত্র সন্তানকে দেয়া হয় হিস্যার সিংহভাগ। কন্যা সন্তান নামকাওয়াস্তে কিছু পায় মাত্র।

আমি যেদিন প্রথম এই আইন সম্পর্কে জেনেছি, আমার খুব মন ছোটো লেগেছে। ‘সম্পদ কম পাবো’ ভেবে নয়, নিজেকে হীনস্থানে দেখে অপমান লেগেছে।

আমাকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে, যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় সন্তান হিসেবে পরিবার তো আমাকে সবসময় সবচে’ বেশি গুরুত্বই দিয়ে এসেছে। তাহলে, সম্পদ বণ্টনে আইন কেন আমাদের মাঝে এমন বিভেদ রোচে দেবে!

আইনে অবশ্যই এই বিধির বিকল্প থাকা দরকার।

বৈষম্যমূলক আইনের কারণে উচ্চশিক্ষিত হয়েও, ভালো উপার্জন করেও কোনো নারী যদি পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহ দেখান তাকে দোষ দেয়া কি যুক্তি-যুক্ত হবে?

কারণ আমাদের দেশে নারী তার পিতার হিস্যাতে পায় যৎসামান্য। স্বামীর সংসারেও তার হিস্যা প্রহসন মাত্র। এই বাস্তবতার কারণে শিক্ষিত-উপার্জনক্ষম কোনো নারী ভবিষ্যতের আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভেবে নিজের উপার্জনের সমুদয় অর্থ পিতৃ পরিবারের পেছনে খরচ না করে জমিয়ে রাখতে আগ্রহী হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

অসম বণ্টনের কারণে মেয়েকে কম ও ছেলেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। এভাবে বণ্টনের বৈষম্য সমাজে বৈষম্যমূলক সংস্কৃতিকেই বাড়ায়।

তাই, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যার সমানাধিকার নিশ্চিত করাটাই হতে পারে বৈষম্য-বিলোপ-প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ।

এগুলোর পাশাপাশি আরেকটি বিষয়ে ভাবা দরকার বলে বোধ করি।

নারীর শরীরের সাথে পারিবারিক, ব্যক্তিগত সম্মান-অসম্মানের বিষয়টি জড়িয়ে দেখা হয়। তাই, পরিবারকে ঘায়েল করতে ঘটে নারী নির্যাতন। নারীর শরীর থেকে পারিবারিক সম্মান-অসম্মানের ধারণাটি সরানো দরকার।

আমাদের দেশে বাল্য-বিবাহ এবং এসিড সন্ত্রাস রোধে দীর্ঘমেয়াদী এডভোকেসি কার্যক্রম এক্ষেত্রে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর সফল দৃষ্টান্ত।

অর্থাৎ ইচ্ছে দৃঢ় হলে বহু প্রাচীন সামাজিক ধারণাও পাল্টানো সম্ভব।

এই কাজগুলো করা গেলে, আমি মনে করি, একদিন আমাদের পুরুষেরা মুক্তি পাবে ‘রক্ষাকর্তা’ হয়ে জীবন কাটানোর ভার থেকে, নারীরা মুক্তি পাবে লক্ষণ-গণ্ডি থেকে আর সমাজ মুক্তি পাবে বৈষম্যমূলক অবিচারের সংস্কৃতি থেকে।

Advertisement