বিচ্ছেদের সংকট থেকে মের বিদায়

ফরিদুল আলম :

বিচ্ছেদের গণরায় এসেছিল আজ থেকে তিন বছর আগে, ২০১৬ সালের ২৩ জুন। কথা ছিল পরের দুই বছরের মধ্যে এর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। সেই লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে ‘ডিভোর্স বিল’ খ্যাত যে খসড়া বিচ্ছেদ চুক্তি পার্লামেন্টে পেশ করা হয়, তিনবার তা নাকচ হয়ে যাওয়ার পর বিচ্ছেদ দীর্ঘায়িত হতে হতে গত ২৯ মার্চ গিয়ে ঠেকে। সেই সময়ের মধ্যেও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে না পারার ফলে শেষবারের মতো যুক্তরাজ্যকে আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয় ইইউ। সংসদ সদস্যদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মের আকুল আকুতি ছিল তার পেশকৃত খসড়া চুক্তিটি অনুমোদন দিতে এবং প্রয়োজনে এর বিনিময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাকে শূন্য হাতেই পদ ছাড়তে হচ্ছে।

গত ২৪ মে এক আবেগঘন বক্তব্যে আগামী ৭ জুন প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এর আগে তিনি যে কয়বার খসড়া চুক্তি হাউস অব কমন্সে পেশ করেছিলেন, প্রতিবারই তার নিজের দল কনজারভেটিভ পার্টিসহ বিরোধী লেবার এবং অপরাপর সবার তোপের মুখে পড়তে হয়। কারণ তিনি যে চুক্তিটি পাস করিয়ে নিতে চাইছেন, এর মধ্য দিয়ে ইইউর কাছে ব্রিটেন অনেকটা নিজেকে সঁপে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কীভাবে সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক- বহুল আলোচিত ‘ডিভোর্স বিল’ চুক্তির যে খসড়া মে সরকার এবং ইইউ মিলে তৈরি করেছে, সেখানে এই বিচ্ছেদ পুরোপুরি কার্যকর করতে ২১ মাস সময় ধরা হয়েছে এবং পরবর্তীকালে তা আরও দুই বছর বৃদ্ধি করার বিষয় যুক্ত রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাজ্যের জন্য ইইউর সব আইন (ভবিষ্যতের পরিবর্তনযোগ্য আইনসহ) মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তারা সংস্থাটির সদস্যপদ চিরতরে হারাবে। সেই সঙ্গে এই সময়ের মধ্যে বিচ্ছেদ প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ খরচ এবং ইইউকে প্রদেয় যুক্তরাজ্যের চাঁদা (আনুমানিক ৩৯ বিলিয়ন পাউন্ড) যুক্তরাজ্যকেই বহন করতে হবে। উলেল্গখ্য, ২০১৮-১৯ সময়কালে কেবল এই চাঁদার অঙ্কই ছিল ১০ বিলিয়ন পাউন্ড। ব্রিটেন ও অপরাপর ইইউভুক্ত নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টির দিকে খেয়াল রেখে এই চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে, ব্রিটেনে বসবাসরত ইইউ দেশগুলোর নাগরিক এবং ইইউভুক্ত দেশগুলোতে বসবাসরত ব্রিটেনের নাগরিকরা অব্যাহতভাবে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে বসবাস করতে থাকবে। কোনো নির্দিষ্ট স্থানে কোনো নাগরিক ৫ বছরের অধিককাল বসবাস করলে তারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে। ব্রিটেনের ব্রেক্সিটপন্থি রাজনীতিবিদ এবং এর পক্ষের নাগরিকদের মূল দুশ্চিন্তার জায়গা এটাই ছিল। অনেক কারণের মধ্যে ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে অবাধে নাগরিকদের ব্রিটেনের ভেতর ঢুকে পড়া এবং তাদের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভাগ বসানো নিয়ে ব্রিটেনবাসীর দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল। তাই খসড়া এই চুক্তি ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্তের জন্য একটি আত্মহত্যার শামিল বলে মনে করা হয়।

আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার সীমান্ত বিষয়ক যে সমঝোতা চলছে, তার একটি বাস্তবভিত্তিক পরিণতির জন্য যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইইউর বাণিজ্যবিষয়ক একক কাস্টমস ইউনিয়ন বহাল রাখা অত্যন্ত জরুরি। এখানে ইইউ যুক্তরাজ্যের যে দুর্বল জায়গাটি চিহ্নিত করেছে তা হচ্ছে, উত্তর আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যবিষয়ক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। সে ক্ষেত্রে আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সীমান্ত সমস্যা সমাধানে ব্রিটেনকে ছাড় দিয়ে হলেও বাধ্য করার একটি প্রবণতা লক্ষণীয়। উভয়ের নিজস্ব জলসীমায় অবাধে মৎস্য সম্পদ আহরণের বিষয়েও বাধ্যবাধকতার বিষয় রয়েছে। অথচ ব্রিটেনের জাতীয় আয়ের খুব কমই এই খাত থেকে অর্জিত হয়। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ভবিষ্যৎ সালিশ-মীমাংসার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিসের (ইসিজে) মধ্যে একটি যৌথ সালিশি কমিটি গঠনের কথা বলা আছে। যদি এর মাধ্যমে বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধান অর্জিত না হয়, তবে ইসিজের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে বলে খসড়া চুক্তিতে বলা আছে। বিষয়টি প্রকারান্তরে এমন দাঁড়াল যে, ভবিষ্যতে ইইউ যেমন চাইবে যুক্তরাজ্যকে তেমনটাই করে যেতে হবে।

সঙ্গত কারণেই ব্রিটেনের পার্লামেন্ট এই চুক্তি পাস করেনি এবং প্রধানমন্ত্রী মে কোনো জুতসই চুক্তিপত্র সংসদের সামনে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনটা যদি আমরা ধরে নিই, তাহলে এর সঙ্গে এটাও ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে যে, এটা কি কেবল প্রধানমন্ত্রী মের ব্যর্থতা নাকি বাস্তব অবস্থাই এর চেয়ে বিকল্প আর কিছু হাজির করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে এই সমস্যাটির মূল সূচনা করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। নিজে ব্রেক্সিটের বিপক্ষে থাকলেও কেবল সস্তা জনপ্রিয়তার নেশায় দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের আগে নাগরিকদের মধ্যে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর নাগরিকদের ব্যাপক হারে ব্রিটেনে অভিবাসী হওয়ার ক্ষোভকে প্রশমনের লক্ষ্যে একটি গণভোট আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে যখন দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আরোহণ করলেন এবং প্রতিশ্রুত গণভোট দিলেন, সামান্য ব্যবধান (ব্রেক্সিটের পক্ষে ৫২ শতাংশ এবং বিপক্ষে ৪৮ শতাংশ) সত্ত্বেও ব্রেক্সিটের পক্ষে গণরায় এলে তিনি পদত্যাগ করেন। দলের নেতৃত্বে থেকে সরকার গঠন করা এবং সে সময় তার পদত্যাগের বিষয়ে তেমন জোর চাপ না থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন পদ ছেড়ে দিলেন, তা আজ মের অবস্থা থেকে অনেকটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। অর্থাৎ মে যে প্রস্তাবনাটি সংসদের সামনে হাজির করেছেন, এর চেয়ে ভালো কোনো প্রস্তাবনা তার উত্তরসূরি যিনি আসবেন, তিনি যে আনতে পারবেন, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখানে মনে রাখতে হবে যে, সমস্যাটি ব্রিটেনের, ইইউর নয়। ইইউ ত্যাগ করলেও ভবিষ্যতে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে ব্রিটেনের সার্বিক সম্পর্কের স্বার্থে ব্রিটেনকেই বিদ্যমান বাস্তবতায় তার জন্য তুলনামূলক ভালো পন্থাটি বেছে নিতে হবে। যদিও সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বাগ্রে রয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন এবং মে মন্ত্রিসভার অপর মন্ত্রী মাইকেল গোভ। এর বাইরেও রয়েছেন জেরেমি হান্ট, হেগেক ও স্টুয়ার্ট। তবে এদের কারও পক্ষেই সরকারের বাকি মেয়াদে যে একটি গ্রহণযোগ্য চুক্তিতে উপনীত হওয়া সম্ভব, সে ভরসা খুব সামান্য। অবশ্য বিষয়টি অনেকটা আগেভাগেই আঁচ করতে পেরে বরিস জনসন বলেই ফেলেছেন, ‘কোনো চুক্তি হোক আর না হোক, আমরা ৩১ অক্টোবর ইইউ ত্যাগ করব। একটি ভালো চুক্তি হওয়ার মোক্ষম উপায় হচ্ছে কোনো চুক্তি না করার জন্য প্রস্তুতি রাখা।’ এর মধ্য দিয়ে তিনি অনেকটা পরিস্কার করে দিয়েছেন যে, যুক্তরাজ্যের চাহিদামাফিক চুক্তি স্বাক্ষর করা খুবই দুরূহ বিষয়। তাহলে বিষয়টা যা দাঁড়াল তা হচ্ছে, এখানে স্রেফ নেতৃত্বের কোন্দল অর্থাৎ দলের ভেতর একটা বড় অংশ মেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চায় না এবং তাদের লোভ রয়েছে এই পদের দিকে। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, গত কয়েক মাসে মের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে দলের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং আরও অন্তত ১৫ জন পদত্যাগের হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে মে যখন বিরোধী লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনের সমর্থন চাইলেন চুক্তি

স্বাক্ষরের জন্য, এটাকে লেবার পার্টির কাছে নিজেদের সঁপে দেওয়া হিসেবে উলেল্গখ করেছেন অনেকেই। এ ক্ষেত্রে মে যখন বিকল্প সমাধান হিসেবে আরেকটি গণভোটের চিন্তাভাবনা মাথায় রেখেছেন, সেটিকেও

হতে দিতে চাইছেন না দলের অনেকেই। সুতরাং সার্বিক পরিস্থিতি জাতীয় প্রয়োজন

নয়, অসুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতারই

একটি নেতিবাচক ফল হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে আমরা যদি ধরে নিই যে, নতুন যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, তিনিও কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প হাজির করতে পারলেন না এবং এই অবস্থায় কোনো চুক্তি ব্যতিরেকেই ব্রিটেন ইইউ থেকে বের হয়ে গেল, তাহলে ক্ষতির মাত্রা কার কতটুকু হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করে যে সিদ্ধান্তে সহজেই উপনীত হওয়া যায় তা হচ্ছে, ব্রিটেনের মতো একটি বড় শক্তি হারিয়ে গেলেও ইইউ কিন্তু অপর ২৮টি দেশ নিয়ে একত্রেই পথ চলবে। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ বাকি বিশ্বের কাছে ইইউর তুলনায় আলাদা করে যুক্তরাজ্যের বিশেষ কোনো আবেদন থাকার সুযোগ থাকবে না। এই বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হিসেবে যুক্তরাজ্য ইইউকে যতটুকু দিয়েছে, তার চেয়ে কম পেয়েছে- এটা অন্যতম কারণ ছিল। তবে এই সরল হিসাবের বাইরে যে সূক্ষ্ণ হিসাবগুলো তাদের নজর এড়িয়ে গেছে তা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে তারা বড্ড একা হয়ে পড়ছে। আগামী নির্বাচনে হয়তো এর মাসুল দিতে হতে পারে কনজারভেটিভ দলকে। তবে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যারা রয়েছে অর্থাৎ লেবার পার্টি, তারা যদি কনজারভেটিভদের এই দুর্বলতার সুযোগে ক্ষমতাসীন হয়, তবে এরই মধ্যে দেশটির রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে যাবে, তা সামাল দিতে তারা কী ধরনের মহৌষধ প্রয়োগ করবে, সেটা অজানা। আসলে সার্বিক বিবেচনায় এখন এটাই মনে হচ্ছে যে, এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকেই যাচ্ছে যুক্তরাজ্য।

সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
mfulka@yahoo.com

Advertisement