বিজ্ঞাপনের ভাষায় প্রতিবেশীর বন্ধুত্ব!

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: কোনো কোনো বিজ্ঞাপনের ভাষা ও কথাগুলো এত অর্থবহ ও আকর্ষণীয় হয় যে মাঝেমধ্যে ওগুলোর সৃজনশীল লেখকদের প্রতি আমার খুব ঈর্ষা হয়। কপিরাইটার হিসেবে পরিচিত বিজ্ঞাপনী সংস্থার এসব সৃজনশীল লেখকের ছোট ছোট একেকটি বাক্য এত বিপুল সম্ভাবনার কথা বলে, যা সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে বাধ্য। কথাগুলো মনে পড়ল ঢাকার ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর প্রথম পাতায় গত সোমবার প্রকাশিত ভারতীয় একটি বেসরকারি বিমান কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখে। বিজ্ঞাপনটিতে বলা হচ্ছে, ‘দিল্লি, এখন ঢাকার আরও কাছাকাছি’ (ডেলহি, নাউ ইভেন ক্লোজার টু ঢাকা)। কথাটির গুরুত্ব মোটামুটি সবাই বোঝেন। সংস্কৃতি, বিনোদন, অর্থনীতি, বাণিজ্য, ক্রীড়া, রাজনীতি-সব ক্ষেত্রেই এই নৈকট্য দৃশ্যমান। আবার সব ক্ষেত্রেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর একটা প্রতিযোগিতাও আছে।

সপ্তাহ কয়েক আগে ‘রাজনীতির গাড্ডায় পড়া’ বিএনপির নেতাদের দিল্লি সফরের পর এই প্রতিযোগিতার বিষয়টি এখন অনেকেরই আলোচনার খুব প্রিয় বিষয়। যেন এর আগে বিএনপি কখনোই দিল্লিমুখো হয়নি। অথচ দিল্লির সহানুভূতি পেতে দলটি যে কত বেপরোয়া, তা প্রমাণের জন্য ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়ে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের সঙ্গে খালেদা জিয়ার একটি কথিত টেলিসংলাপের রেকর্ড গায়েবি সূত্র থেকে গণমাধ্যমে হাজির হয়েছিল এবং তা নিয়ে কত তোলপাড়ই না হয়েছিল। গত কয়েক বছরে একাধিকবার বিএনপির কথিত লন্ডন ষড়যন্ত্রের গল্পও বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ভারতীয় টাটা গোষ্ঠীর মালিকানাধীন লন্ডনের তাজ হোটেলে খালেদা জিয়া ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেছেন, এমন খবরও ছাপা হয়েছে। দিল্লিমুখী হওয়ার জন্য বিএনপির সমালোচনার যৌক্তিকতা নেই, এমন দাবি কেউ করবেন বলে মনে হয় না। তবে ‘দুর্বলেরে আঘাত হানা’ আমাদের জাতীয় অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে কি না, সেটা বোধ হয় একটু ভেবে দেখার অবকাশ আছে।

ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পটভূমিতে বাংলাদেশের জন্য যে বিজ্ঞাপন আদর্শ, সেটি অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশে প্রযোজ্য হবে কি না, সন্দেহ। প্রধানমন্ত্রী মোদি ক্ষমতা গ্রহণের দিনে ‘পড়শি পহেলে’ ঘোষণা দিলেও গত কিছুদিনে সম্পর্কগুলোয় যেন কিছুটা উল্টোমুখী প্রবণতা শুরু হয়েছে। শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রী মোদি এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গেও বিশেষ সম্পর্ক গড়ায় উদ্যোগী হয়েছিলেন, নওয়াজ শরিফকে তাঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে হঠাৎ করেই লাহোরে তাঁর পারিবারিক বাসভবনে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে বৈরিতা বরং বেড়েছে।

ভৌগোলিক নৈকট্যের দিক থেকে ঢাকা দিল্লির যতটা কাছে, তার চেয়েও কাছে আছে, এমন প্রতিবেশীর সঙ্গেও হঠাৎ করেই ভারতের যেন একটু দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। যেমন বলা যায় নেপালের কথা। আকাশপথে কাঠমান্ডু ঢাকার চেয়ে দিল্লির কাছে। কাঠমান্ডুর সঙ্গে দূরত্ব যেখানে ৪৯৮ মাইল, ঢাকার সঙ্গে তা প্রায় ৯০০ মাইল। কিন্তু কাছের বন্ধু এখন দূরে সরে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। নেপালে বিচ্ছিন্নতাবাদী মাধেশিদের আন্দোলনে সমর্থন দিতে গিয়ে দেশটির জ্বালানি সরবরাহে কার্যত অবরোধ সৃষ্টির কারণে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল, তার রেশ এখনো বিদ্যমান। নেপালের প্রধানমন্ত্রী অলি গেল সপ্তাহে চীনে গেছেন এবং তাঁদের আলোচ্যসূচিতে আছে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি রেলসংযোগ প্রতিষ্ঠা। এই রেলসংযোগ ভবিষ্যতে জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের জরুরি সরবরাহের বিকল্প পথ নিশ্চিত করবে।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে মালদ্বীপের। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ঠেলাঠেলি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ভারত গত মঙ্গলবার ২৬ জুন মালদ্বীপে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের রপ্তানির কোটা নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দিয়েছে। মালদিভস টাইমস জানায়, গম ও ডিমের মতো খাদ্যসামগ্রী আমদানির উৎস হিসেবে মালদ্বীপ কয়েক দশক ধরেই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু নতুন কোটায় গম রপ্তানির পরিমাণ কমানো হয়েছে প্রায় ৯৮ শতাংশ, চিনি ৯৭ শতাংশ, পেঁয়াজ ৪৯ শতাংশ। এর আগে এ মাসের গোড়ার দিকে মালদ্বীপের ক্ষমতাসীন দল প্রগ্রেসিভ পার্টির পার্লামেন্টারি শাখার প্রধান আহমেদ নাহিন চিকিৎসার জন্য মুম্বাইয়ে গেলে ভিসা না দিয়ে ভারত তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

বিপরীতে মালদ্বীপকে দেওয়া দুটি সামরিক হেলিকপ্টার চলতি মাসের মধ্যেই ফিরিয়ে নিতে বলেছে মালে। ২০১২-১৩ সালে দেওয়া হেলিকপ্টার দুটির সঙ্গে ভারতীয় সামরিক প্রশিক্ষকেরা দেশটিতে অবস্থান করছিলেন বলেই তা দ্রুত ফিরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। মালদ্বীপে কর্মরত ভারতীয়দের কাজের অনুমতি আর নবায়ন করা হবে না বলে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখন চাকরির বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, ভারতীয়দের আবেদনের প্রয়োজন নেই।
বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, মালদ্বীপের রাজনীতিতে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের নির্বাচিত সরকার প্রেসিডেন্ট নাশিদকে উৎখাতের সময় ভারত গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সরকারকে সমর্থন দেয়নি। পরে বিতর্কিত নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন ক্ষমতাসীন হন এবং তাঁর প্রতি ভারতের সমর্থন অব্যাহত থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে হঠাৎ করেই এই সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, মালদ্বীপ গত বছর চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে যুক্ত হওয়ার পর সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করে। মালদ্বীপে অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগের সুবাদে দেশটির ওপর চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব জোরদার হয়েছে।

এ বছরের গোড়ার দিকে মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের সময়ে ভারতের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ বন্ধে ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর তৎপরতায় তা বেশ প্রকটভাবেই ধরা পড়ে। কিন্তু এত কিছুর পরও মোহাম্মদ নাশিদের দল, মালদিভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ নাসিম মঙ্গলবার মালদ্বীপে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর দলের অধিকাংশ নেতা হয় নির্বাসনে, নয়তো কারাগারে। তিনি বলছেন, প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনকে যদি সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে ভোট চুরির সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে দেশটিতে স্বৈরশাসন চেপে বসবে।

আরেক প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার ওপরও ভারতের প্রভাব লক্ষণীয় মাত্রায় কমেছে। শ্রীলঙ্কায় ভারত যে হামবানটোটা বন্দরকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক নয় বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেটিই দেশটিতে চীনের প্রভাব সংহত করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। হামবানটোটা সমুদ্রবন্দর ছাড়াও মাত্তালায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন এখন দেশটির প্রধান বিনিয়োগ উৎস। ২৬ জুন মঙ্গলবারের নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, চীনা ঋণের বোঝা শ্রীলঙ্কার ঘাড়ে এমনভাবে চেপে বসেছে যে দেশটিকে এখন তার কিছু এলাকা বেইজিংয়ের কাছে ছেড়ে দিতে হতে পারে (হাউ চায়না গট শ্রীলঙ্কা টু কফ আপ আ পোর্ট)।

বছর কয়েক আগে কলম্বোর গলে ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের জন্য ঠিক করা একটি জমি শ্রীলঙ্কা চীনা বিমান প্রস্তুতকারী কোম্পানির কাছে বিক্রি করেছিল। বিষয়টার প্রতীকী মূল্য এখন ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে অবশ্য শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে চীনের প্রত্যক্ষ প্রভাব খাটানোর কিছু তথ্যপ্রমাণও তুলে ধরা হয়েছে, যার মধ্যে আছে সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের দলকে বিপুল অঙ্কের চাঁদা দেওয়ার ঘটনা।

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যে শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই বড় ধরনের ধাক্কা খাচ্ছে তা-ই নয়, এই অঞ্চলের বাইরে বৈশ্বিক পরিসরেও তার কিছু আলামত মিলছে। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতকে কৌশলগত সামরিক ও রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে কাজে লাগাতে উৎসাহী হলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও অভিবাসন নীতি এখন তাতে নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের ইস্পাত আমদানির ওপর আরোপিত নতুন শুল্ক ভারতকে ক্ষুব্ধ করেছে। দিল্লিও পাল্টা ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পণ্যে নতুন শুল্ক বসানোর ঘোষণা দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতীয় পেশাজীবীদের জন্য বিশেষ ভিসা দেওয়ার নীতি সংশোধন, যার ফলে হাজার হাজার ভারতীয়ের অভিবাসনের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

তবে স্পষ্টতই বন্ধুর সুখে-দুঃখে পাশে থাকার ওয়াদা থেকে বাংলাদেশ বিচ্যুত হয়নি। তিস্তার পানি নিয়ে যত হাহাকারই থাকুক না কেন কিংবা উল্টো আবদারে আত্রাইয়ের পানির ভাগ দাবি করা হোক না কেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠতা অর্জনের দৌড়ে মগ্ন। ভারতীয় বিমান কোম্পানিটির বিজ্ঞাপন তা যথার্থই তুলে এনেছে।

Advertisement