ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: স্বদেশকে কর্তৃত্ববাদের কবল থেকে রক্ষা করতে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ শক্তি ভারতের শরণাপন্ন হওয়ার অভিজ্ঞতা যে এতটা অস্বস্তিকর হবে, তা তিনি আগে ভাবেননি। ছুটে গিয়েছিলেন দিল্লিতে। ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতৃত্বের সঙ্গে নানা পর্যায়ে যোগাযোগ, কূটনীতিকদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন মালদ্বীপের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ। একসময়ে ভারতের ভূমিকার প্রকাশ্য সমালোচক, এবারে যে শুধু দেশটির হস্তক্ষেপ চাইলেন তা-ই নয়, তিনি চেয়েছিলেন ভারত যেন মালেতে একজন দূত পাঠায়, যাঁর সঙ্গে যাবে একটি সেনা দল। দিল্লিতে তিনি ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেন। কিন্তু ভারতের প্রতিক্রিয়া যে তাঁকে হতাশ করেছিল, সে কথা প্রথমবারের মতো তাঁর মুখ থেকেই শুনতে পেলাম গত শুক্রবার সন্ধ্যায় লন্ডনের এক আয়োজনে।
সন্ত্রাসের অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত মোহাম্মদ নাশিদ চিকিৎসার জন্য ২০১৬ সালে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে আসেন এবং রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে স্বদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই সংগঠিত করেন। শনিবার নির্বাসিত জীবনের ইতি ঘটিয়ে তিনি লন্ডন ছেড়েছেন এবং কলম্বোতে সপ্তাহখানেকের যাত্রাবিরতি করে তারপর দেশে ফিরবেন। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের খলিল লেকচার থিয়েটারে দুই ঘণ্টার সেমিনারে উঠে এল অনেক চমকপ্রদ তথ্য।
আয়োজক সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট সেমিনারের শিরোনাম দিয়েছিল ডিফেন্ডিং ডেমোক্রেসি ফ্রম এক্সাইল: দ্য মালদ্বিভস অপজিশন ২০১২–২০১৮। তাঁর দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাসিত জীবনের শুরু যদিও ২০১৬ থেকে কিন্তু বিরোধী দলে তাঁর অবস্থান ২০১২–এর ফেব্রুয়ারি থেকে, যখন তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। এর আগে, প্রথম দফায় তাঁর নির্বাসিত জীবন ছিল ২০০৪ থেকে ২০০৬, যখন দেশটির শাসনক্ষমতায় ছিলেন স্বৈরশাসক হিসেবে সমালোচিত মামুন আবদুল গাইয়ুম। নিবিড় প্রশ্নোত্তরসহ প্রায় দুই ঘণ্টার আলোচনায় তাঁর মূল কথা ছিল—এবারের নির্বাচনে কর্তৃত্ববাদী ইয়ামিন সরকারের নাটকীয় এবং শোচনীয় পরাজয়ের মূল কারণ হচ্ছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিরোধীদের ব্যাপকভিত্তিক ঐক্য। মালদ্বীপের গণতন্ত্র ফেরানোর অভিযাত্রা তাঁর জবানিতে যেভাবে উঠে এসেছে সেগুলো এরকম:
১. প্রথমবারে যাঁর কারণে নাশিদকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, এবার গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের জন্য তিনি সেই গাইয়ুমেরই শরণাপন্ন হয়েছিলেন। সেখান থেকেই ঐক্যের সূচনা এবং তারই পরিণতিতে বৃহত্তর জোট ও তাদের কর্মসূচিভিত্তিক রাজনৈতিক লড়াই।
২. প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে তাঁর অনুগতদের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়ন করেন। এমনকি ভিন্নমত পোষণের জন্য তিনি তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্টকেও অপসারণ করে জেলে পাঠান।
৩. প্রধান বিচারপতি এবং জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের অস্ত্রের মুখে অপসারণ, গ্রেপ্তার এবং সুপ্রিম কোর্টের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এ ধরনের পদক্ষেপই সাধারণভাবে ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
৪. বিরোধীদলীয় সমর্থকদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য ঝাড়েমূলে গ্রেপ্তার। বিরোধী দলের নেতাদের সবাই নির্বাচনের দিনে হয় জেলে আটক ছিলেন, নয়তো বিদেশে নির্বাসনে। স্মরণ করা যেতে পারে, নির্বাচন সুষ্ঠু এবং অবাধ হবে না—এমন ধারণা থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ থেকে বিরত ছিলেন।
৫. সাধারণ নাগরিকেরাই ব্যালটের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসনের জবাব দিয়েছেন। বিরোধীদের জোটবদ্ধতা তাঁদের মধ্যে সেই আস্থা ফিরিয়ে এনেছে। ফলে ভোট পড়েছে ৯০ শতাংশ এবং বিরোধী দল পেয়েছে ৫৮ শতাংশ।
৬. নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক ট্যাবলেট ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল মোহাম্মদ নাশিদের ভাষায়, ইলেকট্রনিক উপায়ে জালিয়াতি। কিন্তু নির্বাচনী কর্মকর্তারা সেগুলো ব্যবহারে যথেষ্ট দক্ষ না হওয়ায় অধিকাংশ জায়গাতেই তা ব্যবহার করতে পারেননি। ফলে ভোটের দিনে তাঁরা প্রথাগত ব্যবস্থায় ফিরে যেতে বাধ্য হন এবং সরকারের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।
৭. মোহাম্মদ নাশিদের কথায় প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন মালদ্বীপবাসীর ওপর ‘উন্নয়ন চাপিয়ে দেওয়া’র চেষ্টা করেছেন, উন্নয়নের সরকারি ভাষ্য বা ধারণা মানুষের ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এই উন্নয়নের জন্য চীনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ২৩০ কোটি ডলার। তাঁর মতে, এই ঋণের কতটা অংশ দেশে এসেছে, তা তদন্ত করলেই বের হবে। লোহা কিংবা সিমেন্টের মতো নির্মাণসামগ্রীর আসল বাজারদর কত ছিল এবং কতটুকু কাজ হয়েছে, তার নিরীক্ষাতেই এর প্রমাণ মিলবে।
৮. প্রকল্পগুলোতে চীনা বিনিয়োগের পাশাপাশি মালদ্বীপের যতটুকু অংশীদারত্ব থাকার কথা, ততটুকু সম্পদ জোগানোর ক্ষমতাও দেশটির ছিল না। ফলে প্রকল্পে মালিকানার অংশ পরিশোধের জন্য সরকার জমির মালিকানা চীনাদের হাতে তুলে দিয়েছে। নাশিদের মতে, এই ভূমির মালিকানা হস্তান্তরের মাধ্যমেই দেশের সার্বভৌমত্বেরও কিছুটা বিসর্জন দিতে হয়েছে। ছোট ছোট অর্থনীতিগুলোর ক্ষেত্রে চীন এই নীতি অনুসরণ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে তাঁরা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ পদক্ষেপ নেবেন।
৯. জোটের রাজনৈতিক কর্মসূচির যেসব বিবরণ তিনি তুলে ধরেছেন, সেগুলোর মূল কথা হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা। তাঁদের প্রতিশ্রুত সংস্কারের দুটো দৃষ্টান্ত এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার–বিষয়ক জাতিসংঘ সনদ আইসিপিপিআর ও নারী অধিকার–বিষয়ক সনদ সিডওর অতিরিক্ত প্রটোকলেও মালদ্বীপ স্বাক্ষর করবে। তাঁর দেশের জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ হচ্ছে অভিবাসী। সেই অভিবাসীদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছেন, মালদ্বীপ অভিবাসীর অধিকার–বিষয়ক জাতিসংঘ সনদও অনুমোদন করবে।
১০. বিচার বিভাগের সংস্কারে বিরোধী জোট অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে, তা সময়সাপেক্ষ হবে বলেও তিনি জানান।
১১. অতীতে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিচার প্রসঙ্গে মানবাধিকারকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে।
১২. প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের ভবিষ্যৎ কতটা নিরাপদ বা তাঁকে কোনো দায়মুক্তির নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে কি না—এই প্রশ্নে নাশিদ জানান, সে রকম কোনো গ্যারান্টি দেওয়া হয়নি। তবে, গেল সপ্তাহে তিনি তাঁর সৌদি আরব সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জানান, সৌদি কর্মকর্তাদের অনেকে বিষয়টি আলোচনায় তুললেও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। যার মানে দাঁড়ায় বিষয়টিতে সৌদি সরকারের জোরালো কোনো অনুরোধ নেই।
১৩. ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরুর পর মালদ্বীপ যে সংবিধান তৈরি করে, তাতে রাষ্ট্রধর্ম করা হয় ইসলাম। গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনে তার পরিবর্তন হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটি সম্ভব হবে না।
১৪. মালদ্বীপের প্রায় সাড়ে ৩০০ নাগরিক জঙ্গিবাদী ইসলামিক স্টেট বা আইএসের হয়ে যুদ্ধ করলেও নাশিদ মনে করেন না যে তাঁর দেশ বড় ধরনের কোনো জঙ্গি হুমকির মুখে রয়েছে। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদের হুমকিকে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চেষ্টা হয় না, সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না।
প্রতিরক্ষা ও পুলিশের শীর্ষ নেতৃত্ব এখন আর প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনকে রক্ষায় এগিয়ে আসছেন না। সুপ্রিম কোর্ট যদি নির্বাচন বাতিল না করেন, তাহলে মালদ্বীপে নতুন প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। রাজনীতিতে তাহলে মোহাম্মদ নাশিদের অবস্থান কী হবে? তিনি কি আসলে সুপার প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন, নেপথ্যে থেকে দেশ চালাবেন? মূল আলোচনার শেষে একান্তে এ কথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, বিরোধী জোটের যৌথ নেতৃত্বই ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেবে। তিনি আর রাষ্ট্রীয় কোনো পদে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিরোধীদের ঐক্য প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণা করে তিনি জানান, ২০১৬–এর কোনো এক সময়ে মালয়েশিয়ার হবু প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের মেয়ে নূর ইব্রাহিম লন্ডনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার বিরোধী দল তখন পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। নাশিদ তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর বাবার দুর্ভোগের শুরু যাঁর আমলে, সেই মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে মিলে বৃহত্তর ঐক্য করতে পারলেই দেশটিতে গণতন্ত্র ও সুশাসন ফেরানো যাবে। মালদ্বীপের আগেই মালয়েশিয়ায় সেই পরিবর্তন ঘটে গেছে।