বিলেতে বঙ্গবন্ধু -৪

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রতিহত করতে প্রবাসীদের শেখ মুজিব ডিফেন্স ফান্ড

আ স ম মাসুম:সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঠেকাতে ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের সফরটি সংক্ষিপ্ত করে বঙ্গবন্ধু দেশে চলে যান।

এরপর দীর্ঘ ৫ বছর ব্রিটেনে আসা হয়নি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তবে ততদিনে তিনিই হয়ে উঠেন বাংলা মুক্তির মঞ্চের প্রধান চরিত্র। ব্রিটেনের ৫০ বা ৬০ এর দশকে আসা প্রবাসী বাঙ্গালীরাও যে সশস্ত্র সংগ্রামের চিন্তা করতেন দেশ স্বাধীনের জন্য বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন সেই চিন্তার নিয়ামক শক্তি।

আর তাইতো যখন ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারী অখন্ড পাকিস্থানের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয় তখন প্রবাসের ছাত্র, খেটে খাওয়া মানুষ সবাই ফুসে উঠেন। ততদিনে ইষ্ট পাকিস্থান হাউস সকল আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাড়িয়েছে।

শুরুতে যেসব বাঙ্গালী ছাত্র ইষ্ট পাকিস্থান হাউস প্রতিষ্টায় ছিলো তাদের অনেকেই লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফেরত গিয়ে দেশ স্বাধীনের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছেন। অনেকেই জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে ১৯৬৮ সালের ৬ এপ্রিল পাকিস্থান ছাত্র ফেডারেশন লন্ডনের হাইড পার্কের পার্ক স্পিকার্স কর্নারে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল আহবান করেন।

সভাটি মূলত ছাত্রদের ডাকে হলেও এতে পাকিস্থান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, পাকিস্থান ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন ইত্যাদি সংগঠনের উদ্যোগে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর থেকে সাত-আট হাজার বাঙ্গালী ছাত্র-জনতা যোগ দেন সভায়।

সভা শেষে একটি মিছিল নিয়ে স্মারক লিপি প্রদানের জন্য লাউন্ডস স্কোয়ারে পাকিস্থান হাই কমিশনে যায় সবাই। স্মারকলিপি প্রদানের এক পর্যায়ে জাকারিয়া খান চৌধুরী, বর্তমান যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগ সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরীফ, বিবিসি উর্দু বিভাগের উপস্থাপক শিবগাতুল্লাহ কাদরী প্রমুখ পাকিস্তান হাই কমিশনের সামরিক শাখা দখল করে নেন। তারা হাই কমিশনের ৩য় তলার বারান্দায় দাড়িয়ে আইয়ূব খানের ছবিতে অগ্নি সংযোগ করে। উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা জানিয়ে তার মুক্তি দাবি করেন। পরে পুলিশ এসে সবাইকে সরিয়ে দেয়।

ঘটনাটি ব্রিটিশ মূলধারায় মারাত্নক প্রভাব ফেলে। বিবিসি রাত ১০টার প্রধান সংবাদে গুরুত্ব সহকারে প্রতিবেদন প্রচার করে। পরেরদিন ৭ এপ্রিল আইয়ূব খানের ছবিতে অগ্নি সংযোগের ছবি প্রথম পাতায় বড় করে প্রকাশ করে লন্ডন টাইমস পত্রিকা। পাকিস্থান সরকার বিরোধী তখন পর্যন্ত এটাই ছিলো ব্রিটেন প্রবাসী বাঙ্গালীদের সবচেয়ে বড় মিছিল ও সমাবেশ।

এই সমাবেশের কারণে বড় যে কাজটি হয় সেটি হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান তখন প্রবাসী বাঙ্গালীদের ঘরে ঘরে এক অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন।
১৯৬৮ সালের ২৭ মে ব্রিটেন থেকে সদ্য পাশ করা পূর্ব পাকিস্থানে ফেরত তরুন ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ ও বিখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির প্রবাসী নেতা মিনহাজ উদ্দিনের কাছে চিঠি লিখেন।

উল্লেখ্য ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ ও আলমগীর কবির এই দুজনই ইষ্ট পাকিস্থান হাউজ প্রতিষ্টার পেছনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন ১৯৬৩/৬৪ সালে।

মিনহাজ উদ্দিনের কাছে পাঠানো চিঠিতে তারা দুজনেই শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আইনী সহায়তা প্রদানের জন্য লন্ডনের কয়েকজন খ্যাতনামা আইনজীবির সাথে আলোচনা করার অনুরোধ জানান।
২৮ মে জাকারিয়া খান চৌধুরী ও মিনহাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে ইষ্ট পাকিস্থান হাউস সংস্লিষ্ট ছাত্র-জনতা অত্যন্ত গোপনে অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় বিখ্যাত আইনজীবি প্রতিষ্ঠান বার্নার্ড সেরিডান এর মাধ্যমে টমাস উইলিয়াম ( পরবর্তীকালে স্যার টমাস ) কিউ সি এমপিকে মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়।

৫ জুন নিয়োগ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতার শেষ হয়। এ সময় সর্বস্থরের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারনের জন্য প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ৪ নং হ্যাসল ষ্ট্রিট লন্ডন ইওয়ান ঠিকানায় অবস্থিত হাফিজ মজির উদ্দিনের মুসলিম হালাল বুচার শপে।

দ্বিতীয় সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ১০ জুন আব্দুল মান্না ছানু মিয়ার লন্ডনের অভিজাত এলাকা আর্লস কোর্ট ২৭৫ ওল্ড ব্রম্পটন রোডে অবস্থিত গ্রীন মাস্ক রেস্তোরার বেইসমেন্টে।
এই সভা সম্পর্কে মিনহাজ উদ্দিন স্মৃতিচারনে বলেন, এই গোপন সভাগুলোতে বিস্তারিত আলাপ আলোচনার পর শেখ মুজিবের পক্ষে আইনি সহযোগিতা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এ উপলক্ষে ১০ জুনের সভায় আব্দুল মান্নান ছানু মিয়াকে সভাপতি, আমাকে সাধারন সম্পাদক এবং হাফিজ মজির উদ্দিনকে ট্রেজারার করে গঠিত হয় ১২ সদস্যের শেখ মুজিব ডিফেন্স ফান্ড কমিটি।
এই সভাতেই কেনসিংটন হাই ষ্ট্রিট এলাকার আইয়ূব আলীর মালিকানাধীন তাজমহল রেষ্টুরেন্টে স্থাপন করা হয় শেখ মুজিব ডিফেন্স কমিটির অফিস।

বর্তমান যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগ সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরীফ অফিস পরিচালনার দায়িত্ব নেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব ডিফেন্স ফান্ড নামে যৌথ দস্তখতের একটি একাউন্ট খোলা হয়।

খুব অল্প সময়ের মধ্যে একাউন্টে ৮১০ পাউন্ড চাদা জমা হয়।
২০ জুন বিশেষ ট্রাইবুনালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার হওয়ার কথা ছিলো। তাই ১৩ জুন মিনহাজ উদ্দিন, জাকারিয়া খান চৌধুরী, আব্দুল মান্নান ছানু মিয়া, হাফিজ মজির উদ্দিন ও আব্দুর রকিব হাউস অব কমন্সে গিয়ে টম উইলিয়ামের সাথে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন।
সিদ্ধান্ত হয় ১৭ জুন সকালের ফ্লাইটে টম উইলিয়াম পূর্ব পাকিস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবেন।

কিন্তু ১৬ জুন ঢাকা থেকে খবর আসে ২০ জুনের বিশেষ ট্রাইবুনালে লন্ডন থেকে ডিফেন্স কাউন্সিলের উপস্থিত থাকার প্রয়োজন নেই।

তথ্যসূত্র : বিলেতে বাংলার রাজনীতি, লেখক : ফারুক আহমদ

Advertisement