বুলবুল হাসানের অনবদ্য প্রয়াস

দি ক্যাফে

অনাবাসী বাঙালির যাপিত জীবনের গল্প

নিঝুম মজুমদার

আমি কেমন, আমরা কেমন, আমাদের ভাবনা কেমন? আমরা যখন সেসবের ভেতরে থাকি, তখন আসলে সেটি অনুধাবন করা যায় না। আর তা যায় না বলেই আমরা যখন ঠিক আমাদের সামনেই ওই একই কাজটি করতে দেখি—তখন আমাদের অস্বস্তি হয়। ‘দি ক্যাফে’ নাটকটিও অনেকের মনে জন্ম দিতে পারে এই অস্বস্তি। পূর্ব লন্ডনের ব্র্যাডি আর্ট সেন্টার নভেম্বরের প্রথম উইকএন্ডে মঞ্চায়িত হওয়া বাংলা নাটক ‘দি ক্যাফে’র সার্থকতাও এখানে।

‘দি ক্যাফে’ নাটকটি মূলত বিলেতে বাঙালি কমিউনিটির যাপিত জীবনের গল্প।
এর রচয়িতা বুলবুল হাসান, নির্দেশনা দিয়েছেন সৈয়দা সায়মা আহমেদ রিচি।
কাহিনির সংক্ষিপ্তরূপ এরকম : পূর্ব লন্ডনের একটি ক্যাফেতে প্রতিদিন বিকেলবেলায় জড়ো হন একদল মানুষ। এদের মধ্যে কেউ আছেন ফেসবুকে আসক্ত গৃহবধূ, কেউ আবার হাউজ হাজবেন্ড—টুকটাক কাজ করেন, তবে তা ডিক্লেয়ার না করে বেনিফিটের ওপরই ভরসা রাখেন; আর ‘বাংলাদেশটা যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে’—এমন সব বিষয়ে মতামত প্রদান করে থাকেন। ক্যাফেতে কবি সাহিত্যিকরাও আসেন। বিলেতের কবি মেহেরজান, মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হেলেন, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার অর্ণব, সংস্কৃতি কর্মী, সাংবাদিক থেকে শুরু করে অনেকেরই আনাগোনা দ্য ক্যাফেতে।
মোটা দাগে, পৃথিবীর সমসাময়িক পরিবর্তনগুলোকে বাঙালি কমিউনিটি কোন চোখে দেখেন—তারই এক স্যাটায়ারধর্মী পরিবেশনা দ্য ক্যাফে। এই নাটকের চরিত্রগুলোর ভেতরে দর্শকরা তাদের পরিচিত অনেক টিভি উপস্থাপক, ফেসবুক সেলিব্রিটি কিংবা ‘গা জ্বালা ধরা’ সংস্কৃতি কর্মীকে খুঁজে পাবেন—যারা আমন্ত্রণ ছাড়াই কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে সেলফি তোলেন, আর নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবে সুখ পান।
নাটকটির প্রতিটি মুহূর্তে বার বার করে মনে হচ্ছিল, এর ওই চরিত্রটি আমি কিংবা ওই চরিত্রটি আমার পরিচিত ব্যক্তি। এই মনে হওয়াটা অতিরঞ্জন নয়, কারণ নাটকের বিভিন্ন চরিত্রনির্মাণে নাট্যকার এই চরিত্রগুলোর সঙ্গে বছরের পর বছর মিশেছেন, কথা বলেছেন এবং তাঁদের সঙ্গে নানাবিধ সামাজিকতায় একাত্ম হয়েছেন।
মঞ্চনাটকের জনরা অর্থাত্ রীতি, ধারা বা প্রকার নিয়ে এই নাটকের সঙ্গে মিশাতে চাইলে প্রথমে বিভ্রান্ত হতে হয়। এই মঞ্চনাটক একদিকে যেমন সংলাপধর্মী, অন্যদিকে ছিল মিউজিকাল ফ্লেভার। আবার অন্যদিকে এতে রয়েছে প্রচণ্ড সারকাস্টিক মিশেলের কমেডি।
এই নাটকের মধ্যে কিছু অন্তর্বিরতি ছিল যার প্রতিটিকে একটি একটি করে আলাদা দিন দেখানো হয়েছে। প্রতিটি দিনের শেষভাগে, মানে, ক্যাফে বন্ধ হবার সময় কিংবা সংলাপের কোনো পর্যায়ে নির্দেশক বিভিন্ন ঘরানার সংগীতকে তুলে ধরে পেছনের পটভূমিকে সে মূর্ছনায় বাজিয়েছেন।
এমনও মুহূর্তে গেছে এই নাটকের যেখানে শিল্পীরা কথা না বলে নির্বাক থেকেছেন, কিন্তু কথা বলে গেছে আবহ সংগীতের কিবোর্ডের রিড কিংবা সুরের করুণ মূর্ছনা।
লন্ডনের ব্যস্ততম জীবনে সবাই মিলে বাংলা নাটক ‘দি ক্যাফে’ দেখতে আসাটা বিস্ময়কর বটে। লন্ডনের বাংলা কমিউনিটির কাছে সুপরিচিত সাংবাদিক বুলবুল হাসান প্রথমবারের মত নাটক লিখেছেন।

সাংবাদিক বুলবুল হাসানের খ্যাতি ও পরিচিতি লন্ডনে কয়েকটি স্তরে। তিনি ভালো বক্তা, ভালো লেখেন, বাংলাদেশের ডিবেটের বিকাশের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে অঙ্গাঙ্গিভাবে। নাট্যনির্দেশক সায়মা আহমেদ দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে বাংলা সংস্কৃতির প্রচার, প্রসার ও উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। সমপ্রতি তাঁর নির্দেশনায় ও নাট্যরূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ‘জুতা আবিষ্কার’ যুক্তরাজ্যের শিশু কিশোরদের জন্য মঞ্চায়িত হয়েছিল।

অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে লন্ডনের দর্শকদের মাঝে।
দি ক্যাফে নাটকের শেষে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে নাট্যকারের কাছে এক দর্শক প্রশ্ন করেন—কেন তিনি এই নাটকে বাংলাদেশের মানুষদের এইভাবে দেখালেন? নাট্যকার বুলবুল হাসান জানিয়েছেন যে—আমরা যা করি, আমরা যা ভাবি, আমরা যা দেখাই সেই চর্চার সঙ্গে আমাদের শুধু তিনি নতুনভাবে পরিচয় করে দিয়েছেন। যে সমাজকে তিনি এতটা বছর ধরে প্রত্যক্ষ করেছেন নিবিড়ভাবে, সেটি তার ভাবনায় আসবে। আর এই ভাবনার সঙ্গে তিনি প্রতারণা না করে বরং সত্ থাকতে চেয়েছেন।
আমরা যখন স্বচ্ছ দর্পণে অনেকদিন পর অকস্মাত্ নিজের অবয়ব দেখি, তখন অনেক সময় আমাদের অস্বস্তি হয়। প্রশ্ন আসতে পারে, কেন অস্বস্তি হয়? তাহলে কি আমার কৃত কর্মকাণ্ডটি কিংবা চিন্তার প্যাটার্ন নিয়ে আমরা সংকুচিত কিংবা বিব্রত? নির্দেশক, নাট্যকার, অভিনয় শিল্পীরা তাঁদের চমত্কার মুন্সিয়ানা দিয়ে সেসব আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
একটা সমাজের আকার ঠিক যেভাবে ধারণ করে ‘এটাই স্বাভাবিক’ জাতীয় হয়ে যায়, দি ক্যাফে সেই বিবর্তিত সমাজের গল্প। এখন সেটিকে আমরা নিতে পারব কি পারব না, কিংবা পারছি কি পারছি না—তা নির্ভর করবে ব্যক্তির নিজস্ব ধারণ ক্ষমতার ওপর। আমরা আমাদের চরিত্রকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে এবং তা দেখে অস্বতি পেয়ে এবং তা দেখে নিজেকে চিনতে পেরে সেটি থেকে পালাতে চাইতেই পারি।
দি ক্যাফে এভাবেই পূর্ব লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটির একটি বৃহত্ অংশের আয়না হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। এই নাটকে নিজের সঙ্গে নিজের কিংবা আমাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছে। আমরা কেউ কেউ চিনেছি, কেউ কেউ অস্বীকার করেছি।
নিঝুম মজুমদার লেখক ও ব্লগার
কৃতজ্ঞতা: ইত্তেফাক
Advertisement