:: ব্যারিস্টার নাজির আহমদ ::
১.
“সামাজিক দূরত্ব” না “শারীরিক দূরত্ব”
করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী মহামারী শুরু হওয়ার পর “সোসাল ডিস্টেন্সিং” বা “সামাজিক দূরত্ব” বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও উচ্চারিত টার্মস। একজন থেকে আরেকজন অন্তত: দুই মিটার দূরত্বে অবস্থান বুঝাতে এই টার্মস ব্যবহার করা হয়। তবে আমার মতে “সোসাল ডিস্টেন্সিং” বা “সামাজিক দূরত্ব” অনেকটা কন্ফিজিং বা বিভ্রান্তিমূলক টার্মস। সঠিক টার্মস হবে “ফিজিক্যাল ডিস্টেন্সিং” বা “শারীরিক দূরত্ব”।
মনে করেন, একজন ব্যক্তি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ ক্রয় করতে গিয়ে দোকানে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ালেন বা ব্যাংকে দীর্ঘ অপেক্ষমাণ সারিতে খাড়া হলেন। এখন যদি তিনি তার পাড়ার কোন ব্যক্তিকে বা তার নিকট আত্মীয়কে দেখে কোন কথাই বললেন না, কিন্তু একেবারে গাঁ ঘেঁষে দাঁড়ালেন তাকে আপনি কি বলবেন? সে ব্যক্তি “সোসাল ডিস্টেন্সিং” বা “সামাজিক দূরত্ব” মেনটেইন করলেন বটে, কেননা একেবারে পাশে পেয়েও বা দাঁড়েয়েও কোন কথা বললেন না বা এমনকি কুশলাদিও জিজ্ঞেস করলেন না! কিন্তু “ফিজিক্যাল ডিস্টেন্সিং” বা “শারীরিক দূরত্ব” মোটেই মেনটেইন করলেন না, কেননা একেবারে গাঁ ঘেঁষে দাঁড়ালেন। এতে করে করোনা ভাইরাসের মহামারীর গাইডলাইন ফলো করে কি লাভ হলো? বরং তিনি যদি “সামাজিক দূরত্ব” মেনটেইন না করে অর্থাৎ কথাবার্তা বলেও যদি “শারীরিক দূরত্ব” মেনটেইন করতেন অর্থাৎ দু মিটার দুরত্বে দাঁড়াতেন, তখন উভয় এবং সবার জন্য তা ভাল হতো। একইভাবে এলাকা বা অন্চলের সাথে “সামাজিক দূরত্ব” বজায় রাখলেন ঠিকই কিন্তু পাড়ার লোকদের সাথে বা প্রতিবেশীদের সাথে একসাথে কাছাকাছি বসে গাঁর সাথে গাঁ লাগিয়ে গল্প করলেন বা খেলাধুলা করলেন তখন? এভাবে ভূরিভূরি উদাহরণ দেয়া যাবে। এ জন্য সঠিক টার্মস হবে “ফিজিক্যাল ডিস্টেন্সিং” বা “শারীরিক দূরত্ব”।
২.
কভিড-১৯ না হয়ে হওয়া উচিত ছিল কভিড-২০
করোনা ভাইরাসের ছোঁয়াছে রোগ সংক্রান্ত বিশ্বব্যাপী মহামারীকে সংক্ষেপে কভিড-১৯ বলা ও লিখা হয়ে থাকে। এটির এই নাম দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা। এটাও অনেকটা কন্ফিজিং বা বিভ্রান্তিমূলক টার্ম। যদিও করোনা ভাইরাস প্রথম ধরা পড়েছে চীনের ওহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের একেবারে শেষের দিকে, কিন্তু সেটা ছিল এলাকাভিত্তিক (local based) ও স্থানীয় রোগ (local endemic)। এটা বিশ্বাপী ছড়িয়ে পড়ে ২০২০ সালে। বস্তুত: ২০২০ সালের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা পেনডেমিক বা বিশ্বমহামারী হিসেবে ঘোষনা করে। সে হিসেবে কভিড-১৯ না বলে বলা উচিত ছিল কভিড-২০। বিশ্ব মহামারী ঘোষনার সঠিক বছর ব্যবহারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। আজ থেকে ১০০, ২০০ বা হাজার বছর পর যখন বিশ্বের জনগন করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী মহামারীর ইতিহাস পড়বে তারা যেন তখন সঠিক ইতিহাস পড়ে।
৩.
সব “পজিটিভ” ভালো নয়!
সব সময়, সব জায়গায় “পজিটিভ” ওয়ার্ড বা শব্দ কিন্তু ভাল নয়। অন্তত: করোনা ভাইরাস বিশ্বকে এ কথা জানান দিল! জীবনে বক্তৃতায় ও লেখায় কতবার যে নিজে বলেছি পজিটিভলী চিন্তা করতে, পজিটিভ ধারনা রাখতে ও পজিটিভলী কাজ করতে। কিন্তু এখন দেখছি চিকিৎসা বিজ্ঞানের টেস্টে “পজিটিভ” এক মারাত্মক ব্যাপার! করোনা ভাইরাসের টেস্টে পজিটিভ হওয়া মানে এক মারাত্মক আতংক, শংকার বিষয়। কোন ব্যক্তিকে যখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কি না পরীক্ষা করা হয়, তখন তার টেস্টের নেগেটিভ রেজাল্ট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও আশে পাশে সবার জন্য স্বস্তি ও আনন্দের কারন হয়। কিন্তু পজিটিভ হলে? এজন্য সব জায়গায় “পজিটিভ“ চাইতে নেই!
৪.
চীনের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা দরকার
করোনা ভাইরাস চীনের খাদ্যাভ্যাসকে বিশ্বে ভাল করে এক্সপোজ করেছে। আগে হয়তো কিছু মানুষ জানত কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রাক্কালে সোসাল মিডিয়ার কল্যানে এখন তা ঘরে ঘরে পৌছিয়ে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন যে বাদুর থেকে সৃষ্ঠ করোনা ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে থাকতে পারে। আর বাদুর হচ্ছে চীনের জনগনের অন্যতম খাবার। শুধু কি বাদুর? জীবিত/মৃত/অর্ধমৃত বিষাক্ত সাপ, কুকুর, পোকামাকড, বিড়াল ও ইঁদুর চীনের জনগনের সাধারন খাবার। এগুলো চীনে অপেন মার্কেট বিক্রি হয়। রক্তমাংসের মানুষ এগুলো কিভাবে খেতে পারে? তাই চীনের খাদ্যাভ্যাস জরুরীভিত্তিতে পরিবর্তন করা দরকার। আন-ন্যাচারেল (অপ্রাকৃতিক/অস্বাভাবিক) কিছু করতে গেলে খোদ্ ন্যাচারই তার জবাব দিয়ে দেয়।
৫.
সুপার পাওয়ার” কন্সেপ্টকে এক প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়েছে!
করোনা ভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা (আজকের হিসেবে: ০৬/০৫/২০২০) প্রায় ৭২,০০০ এবং আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সোয়া এক মিলিয়ন তথা সাড়ে বার লাখ। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দীর্ঘ যুদ্ধে ভিয়েতনামে যত মার্কিনীরা মারা গেছেন তারচেয়েও সংখ্যায় এ পর্যন্ত বেশী নিহত হয়েছেন করোনা ভাইরাসে। চিন্তা করতে পারেন! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর একমাত্র সুপার পাওয়ার। পিস্ টাইমে কোন আক্রমনে বা ঘটনায় এত মার্কিন জনগন মারা গেলে কি হতো চিন্তা করা যায়! যে বা যারা এমন কাজ করত তাদেরকে তছনছ করে দেয়া হতো। অথচ একমাত্র সুপার পাওয়ার আজ এক অদৃশ্য শক্তির কাছে কত অসহায়! করোনা ভাইরাস যেন বিশ্বে অনেক দিন ধরে চলে আসা “সুপার পাওয়ার” কন্সেপ্টকে এক প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়েছে!
৬.
কখনও করোনা ভাইরাসের রোগীকে ঘৃনা করতে নেই।
করোনা ভাইরাস যে কাউকে আক্রমণ করতে পারে। যে কেউ আক্রান্ত ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসবে তাকেই সংক্রামিত করবে। ধনী-গরীব বা উঁচু বংশ-নিচু বংশ বা কাল-সাদা বলে সংক্রামন করতে করোনা ভাইরাস কোন বৈষম্য বা খাতির করবে না। এটা এইড বা এইচআইভি পজিটিভ রোগীর মত নয় যে বিশেষ কারনে বা ব্যক্তির দোষে এ রোগ হয়েছে। তাই করোনা ভাইরাসের রোগীকে কখনও ঘৃনা বা অবজ্ঞা করতে নেই। বরং নিজে নিরাপদ থেকে যথাসম্ভব সেবা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির হাত বাড়িতে দিতে হবে। কে না জানে কাল আপনিওতো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন!
৭
প্রতি বছর এক সপ্তাহের জন্য বিশ্বকে লকডাউন করে রাখা যায় না?
গোটা বিশ্ব আজ লকডাউন এবং তা চলছে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে। করোনা ভাইরাস বিশ্বের অচিন্তনীয় ক্ষতি করেছে। লক্ষ লক্ষ লোকের জীবন নিয়েছে। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পাউন্ডের অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে। এই অভাবনীয় ক্ষতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ জানে না। আবার লকডাউনের ওপর পিঠ দেখেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বে কোন যুদ্ধ-বিগ্রহ নেই, নেই কোন বোমা হামলা। রাস্ট্রীয়ভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্গনের ঘটনার হারে একবারে কমে এসেছে। বলা যায় অনেকটা শুন্যের কোঠায়। সব পাপাচারালয় (যেমন: মদ বার, জুয়ার ঘর, হাউজি, বেশ্যাখানা প্রভৃতি) বন্ধ। সবচেয়ে বড় কথা প্রকৃতি ও জলবায়ু হাফ ছেড়েছে। কয়েক দিন আগে আমেরিকায় বসবাসরত সেখানকার হাসপাতালে কর্মরত আমার এক বন্ধুর সাথে আলাপ হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে সেই বন্ধু বললো “আমরা বারো মাসের মধ্যে এক মাস না খেয়ে সিয়াম সাধনা করে অনেক কিছুর মধ্যে খাওয়া-দাওয়া, ক্ষুধা ও অভূক্ত থাকার গুরুত্ব বুঝি। করোনা-উত্তর প্রতি বছর যদি অন্তত: এক সপ্তাহ গোটা পৃথিবীকে লকডাউন করে রাখা যেত তাহলে গোটা বিশ্ব অনেক কিছু অনুধাবন করতে পারত। প্রকৃতিও হাফ ছেড়ে বাচঁত।” বন্ধুটির কথা কি একবারে ফেলে দেয়ার মত?
৮.
করোনা ভাইরাস তিনটি জিনিস নিয়ে এসেছে!
দৃশ্যত করোনা ভাইরাস মানুষের জন্য তিন ধরনের জিনিষ নিয়ে এসেছে। কারো জন্য সুসংবাদ, কারো জন্য শাস্তি বা চরম ক্ষতি, আবার কারো জন্য পরীক্ষা বা সতর্কবানী। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিহত হওয়াও অনেকের জন্য সুসংবাদ হতে পারে। কেননা আমাদের প্রিয় নবী (সা:) বলেছেন “শহীদের মর্যাদা ঐ ব্যক্তিও লাভ করবে যে মহামারী চলাকালীন আক্রান্ত এলাকায় সওয়াবের নিয়তে ধৈর্য্য ধরে অবস্থান করে এবং সে সময় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে।” (সহিহ বুখারি ১/১৬২পৃ: হা: ৬৫৩)।
সুতরাং করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী মহামারীর এ যাত্রায় যদি আমরা বেঁচে যাই তাহলে আসুন এটাকে আমাদের জন্য পরীক্ষা ও ওয়ার্নিং (সতর্ক বার্তা) হিসেবে নিয়ে নিজে সংশোধিত হয়ে এমন একটি পৃথিবী গড়ার প্রত্যয় নেই যার ভিত্তি হবে পারস্পরিক কল্যানকামিতা, পূন্যময় কাজ ও সর্বত্র সুবিচার/ন্যায় বিচার নিশ্চিতের সর্বোচ্চ মাত্রা।
লেখক : বৃটেনের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, কমিউনিটির সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, গবেষক, চিন্তাবিদ, নিউহ্যাম বারার ডেপুটি স্পিকার।