ভূ-রাজনীতির টানাপোড়ন : মর্যাদাবান স্বাবলম্বী জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নাকি তোষণের প্রতিযোগিতা

॥ ডক্টর এম মুজিবুর রহমান ॥

প্রথম পর্ব .

চীন ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনা তৎপরবর্তীবাংলাদেশ, ভারত নেপালের বিভিন্ন  মিডিয়াতে ব্যাপারে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হচ্ছে করোনাকালীন অর্থনীতির চাপ এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পপুলিস্ট ভোট বাড়াতে ট্রাম্পের চিরাচরিত মেঠোবক্তৃতা এই পালে নতুন হাওয়া দিচ্ছে। আঞ্চলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পূর্ব দক্ষিনপূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম মধ্যপ্রাচ্যের মাঝামাঝি পর্যায়ে অবস্থিত ফলে বহি:বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রের কাছে বিশেষ করে ভারত চীনের নিকট ভূরাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ  কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চীনভারতের সীমান্ত সংঘাত এবং এই অঞ্চলে বিভিন্ন দেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে চীনের কৌশলগত অংশীদারিত্ব (স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ) শক্তি দুটিই বৃদ্ধির ফলে সাধারণ উপলব্ধির (জেনারেল পার্সেপশন) পাশাপাশি কিছু সচেতন মানুষের (অবচেতন মনে) মধ্যেও বাংলাদেশের কূটনীতি এক ধরণের জটিলতা টানাপোড়নে চলছে বলে ধারণা পোষণ করছেন আবার বিশ্লেষকদের অনেকেই ক্ষমতাসীনদের সাথে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সম্পর্কের মাত্রা দায়বদ্ধতার হিসেবে একে বিভ্রান্তি প্রবল ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টের বিপরীতে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা বলছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের টেলিফোন এবং তৎপরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের পরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য, ভারতীয় কিছু সাংবাদিক ও মিডিয়ার রিপোর্ট, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান নিয়ে সাবেক এক উচ্চপদস্থ আর্মি কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার সব মিলিয়ে বাংলাদেশের কূটনীতি ভারতের থেকে সরে গিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকছে বলে প্রচারের একটা চেষ্টা যে চলছে তা হয়তো অস্বীকার করা যাবে না

কূটনীতিতে যোগান প্রাপ্তির ব্যবধান এবং অভ্যন্তরীণ চাপে টানাপোড়ন চলে মিডিয়াতে পুস্তকীয় কথা বলা হলেও অন্তরালে দর কষাকষির হিসেব নিকেশ চলে মান অভিমান ভাঙাতে নানারকম চটকদার কথাও বলা হয়ে থাকে তাই পর্দার অন্তরালের ও বাইরের কূটনীতি এবং বাস্তবে এর প্রয়োগ আলোচনা করতে হলে কিছু মানদন্ড বা নির্ণায়ক চিন্তায় রাখা জরুরি

বৃহ প্রতিবেশীর পাশে থাকা একটি সম্ভাবনাময় দেশের ক্ষেত্রে তার অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে একটি মর্যাদাবান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাজনীতি, অর্থনীতি সমর্নীতিতে চিরাচরিত নিয়মেই কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অগ্রসর হতে হয়। সময় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের পুস্তকীয় উদাহরণ এক্ষেত্রে কতটুকু বাস্তবসম্মত তা বিশদ আলোচনার দাবি রাখে

আবেগ পপুলিস্ট চিন্তা চেতনার বাইরে এসে বাস্তবতার নিরিখে আলোচনার ক্ষেত্রে কতগুলো বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। আঞ্চলিক ভুরাজনীতি, বৃহ প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ জাতি স্বত্তার আকাঙ্খা ভৌগলিক অবস্থান, রাজনীতি কূটনীতির অতীত ও চলমান ধারাবাহিকতা,  আঞ্চলিক বৈশ্বিক রাজনীতির ঝোঁক, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাহিদা, রাজনৈতিক দল জোটের প্যাটার্ন, ধর্ম সংস্কৃতির প্রভাব, জবাবদিহিতা সুশাসনের দায় অঙ্গীকার, রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগ্যতা দূরদর্শিতা, রাজনীতিতে সহনশীলতা, সামরিক বাহিনীর আকাঙ্খা, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্রোধ বা জিগাংসা, সার্বিক সততা  দেশপ্রেম, সর্বোপরি মেধা মননে পরিবর্তিত বিশ্বকে ধারণ করার মানসিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলো চিন্তায় রেখে আলোচনা করা না হলে সাময়িক সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিল বা উত্তেজনা সৃষ্টি ছাড়া  কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দুস্কর হতে পারে বিষয়গুলো নিয়ে নির্মোহ ও গঠনমূলক বিস্তর আলোচনা জরুরি এখানে মোটা দাগে কিছু বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণের প্রয়াস মাত্র

সম্প্রতি লাদাখে চীন ভারতের সীমান্ত উত্তেজনা পরবর্তী এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি, কূটনীতি সমরনীতি নিয়ে দেশ বিদেশের গণমাধ্যমে আলোচনা চলছে। করোনা জীবাণু সংক্রমণে চীনের দায় এবং ট্রাম্প প্রশাসনের চীন বিরোধী প্রচারণার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত লাদাখে সামরিক ঘাঁটি শক্ত করতে চেয়েছিলো। ঐতিহাসিকভাবে লাদাখ কাশ্মীরের অংশ এর বিভিন্ন অংশের উপর চীন, ভারত পাকিস্তানের দাবি রয়েছে লাদাখের কিছু অংশ ভারত  বাকি অংশ চীনের দখলে লাদাখ যদি ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে সিয়াচিন হিমবাহকে সম্পূর্ণ নিরাপদ রাখতে পারে আর সিয়াচিন থেকে কারাকোরাম হাইওয়ের কুন্জেরা পাস মাত্র ২৪০ কিলোমিটার দূরে এখান দিয়েই পাকিস্তান থেকে কারাকোরাম হাইওয়ে চীনে প্রবেশ করেছে চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) এর একমাত্র প্রবেশদ্বার এটি বিশ্লেষকরা মনে করেন ভারতের উদ্দেশ্য এই কারাকোরাম নিয়ন্ত্রণে রাখা

ভারতের এই খায়েশ সম্পর্কে চীন পাকিস্তান ওয়াকিফহাল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই অঞ্চল ঘিরে প্রায় চীনের লক্ষ ট্রেনিং প্রাপ্ত সৈন্য কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে এখানে উল্লেখ্য, সম্প্রতি কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন বাতিল করে ভারতের বিজেপি কেন্দ্রের শাসন কায়েম করে এর পর থেকে ভারতের বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং অন্য নেতারা আজাদ কাশ্মীর দখলেরও হুমকি দেন লাদাখে ভারতের সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর মূল রহস্য হলো কারাকোরাম হাইওয়েকে তাদের সামরিক রেঞ্জে রাখা কারাকোরাম হাইওয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ভারত তার অখন্ড নীতি বাস্তবায়নে অনেক এগিয়ে যেতে পারে

ভারতের অভিলাসী উচ্চাকাঙ্খাকে চীন দমিয়ে দিয়েছে ভারত চতুরতার সাথে চীন পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা দিতেচায় এতে হিতে বিপরীত হয়েছে বাস্তবিক অর্থে বড় যুদ্ধ হয়তো হবেনা কারণ ছোট ছোট সংঘাতের মাধ্যমে শক্তির জানান দিয়ে সবাই যার যার জ্বালানি মালামাল পরিবহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইবে প্যাসিফিক অঞ্চলে খবরদারি নিরাপত্তার স্বার্থে আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এক সাথে কাজ করলেও ভারতের পক্ষে একমাত্র ট্রাম্প ছাড়া অন্য কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলেনি এছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশগুলো একমাত্র ভুটান ছাড়া অন্য কারো থেকেও ভারত কোনো ধরণের সাহায্য পাওয়ার অবস্থায় নেই নেপাল শ্রীলংকা এখন চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় সহযোগী নেপাল ভারতের দিক থেকে বলতে গেলে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চীনের সহযোগিতায় অর্থনৈতিক সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হতে চাইছে শ্রীলংকার দক্ষিণাঞ্চলীয় হাম্বানটোটায় গভীর সমুদ্রব ন্দরের নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়নের জন্য চীনের সাথে একটি চুক্তি করেছে দেশটির সরকার। আঞ্চলিক ভুকৌশলগত স্ট্রাটেজিসহ ভারত মহাসাগরের এই হাম্বানটোটা বন্দরটি চীনের বেল্ট এন্ড রোড পরিকল্পনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবে অন্যদিকে, চীনের সঙ্গে ইরানের সম্প্রতি ৪০০ বিলিয়ন ডলারের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং দিল্লিতেও পর্যবেক্ষকরাও অনেকেই মনে করছেন, ভারতের তৈরি চাবাহার বন্দরেও এখন চীনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হল। ইরানের উপকূলে যে চাবাহার বন্দর নির্মাণে ভারত খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, সেটি আফগানিস্তান মধ্য এশিয়ায় স্থলপথে অ্যাকসেসের জন্য ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরা হয়চুক্তির সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু এখনো প্রকাশ করা না হলেও এই চুক্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রথম সরাসরি চীনা সামরিক উপস্থিতির সম্ভাবনাও তৈরি হবে তুরস্কের সাথেও চীনের বাণিজ্যিক কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে এই অঞ্চলে বাকি থাকলো বাংলাদেশ আর এটাই আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু

চীনভারতের অর্থনৈতিক এবং ভূরাজনীতির কৌশলগত প্রতিযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে একটি মর্যাদাবান অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নাকি নিজেদের উন্নয়ন ক্ষমতাকেন্দ্রিক আপোষকামিতা তোষণের প্রতিযোগিতা? দেশের রাজনীতিবিদ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারী প্রতিষ্ঠানকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন পথে অগ্রসর হবেন তবে রাজনীতি কূটনীতি পর্যবেক্ষকদের মতে একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মেধাহীন বাকসর্বস্ব রাজনীতির বিপরীতে জ্ঞানভিত্তিক মানবিক সমাজ এবং আত্মমর্যাদাশীল স্বাবলম্বী জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সর্বাগ্রে প্রয়োজন সহনশীলতা লিভ এন্ড লেট লিভর রাজনৈতিক অঙ্গীকার রাষ্ট্রের অংশীদারগণ কোন পথটি বেঁচে নেন, এটাই এখন দেখার বিষয় (চলবে ….)

লেখক : ডক্টর এম মুজিবুর রহমান

সংবাদ বিশ্লেষক সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

লন্ডন, আগস্ট ২০২০ ।

Advertisement