মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন

:: আবু সাঈদ খান  ::

স্বাধীনতার পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাও পরিবর্তিত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া কবে কীভাবে শেষ হবে, জানি না। আমি বিষয়টি দেখতে চাই ভিন্ন চোখে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের ফসল। একাত্তরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়ে ছাত্ররা কলম ছেড়ে অস্ত্র ধরেছিলেন। কৃষান যুবকের যে হাতে কাস্তে থাকত, সে হাতে তারা রাইফেল নিয়ে লড়েছিলেন। প্রতিটি কৃষকের গৃহ পরিণত হয়েছিল একেকটি দুর্গে- যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে অবস্থান করতেন, তাদের চোখে চোখে আগলে রাখতেন কৃষকরাই। যার কিছু করার সঙ্গতি ছিল না, তারাও স্বাধীনতার জন্য দু’হাত তুলে প্রার্থনা করতেন। যারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, তারাও সীমান্তের ওপারে শরণার্থী ক্যাম্পে বসে স্বাধীনতার জন্য আরাধনা করতেন।

মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান একাকার হয়েছিল। বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী এ লড়াইয়ের সূচনা করলেও তা বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। গারো, সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খাসিয়া, মণিপুরিসহ সব জাতিগোষ্ঠীই মুক্তির কাফেলায় একাত্ম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বে ছিল ‘৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ। দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছিল। তবে মুক্তিকামী অপর সব দল- ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্‌ফর), কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিংহ) ও কংগ্রেস যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। এসব দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। একাত্তর ছিল সব দলের, সব ধর্মের, সব জাতির, সব মানুষের যুদ্ধ- জনযুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষও ছিল। তারা সংখ্যায় সামান্য। ধর্মান্ধ পাকিস্তানপন্থি দল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ ও পিডিপি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল এবং তাদের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল শান্তি কমিটি-রাজাকার-আলবদর-আলশামস। যারা ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর, হত্যা-ধর্ষণসহ নানা অপকর্মের হোতা ও অনুঘটক। স্বাধীনতা-উত্তর তাদের চিহ্নিতকরণ ও বিচার দুই-ই জরুরি ছিল। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর কিছু যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে, বেশিরভাগ যুদ্ধাপরাধী আড়ালেই থেকে গেছে।

এই দেশদ্রোহী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী ছাড়া একাত্তরের প্রজন্মই মুক্তিযোদ্ধা। এই সময়ের আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ধারণ করতে পারে। তবে অস্ত্র হাতে যারা যুদ্ধ করেছেন, গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন; তাদের বিশিষ্টতা নিয়ে বিতর্ক নেই। তখন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হতে পারত, তাদের দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত করা যেত- এসব ভাবা হয়েছিল, বাস্তবায়ন হয়নি।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান প্রশাসন দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু হয়। আর ওই প্রশাসনের বড় অংশ ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী। তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। বরং বিরূপ মনোভাবই পোষণ করত। এমন বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন দুই-ই উপেক্ষিত হয়। ফলে যারা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা আনলেন, তারাই হয়ে পড়লেন এক মর্যাদাহীন প্রজাতি।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে সক্রিয় যোদ্ধাদের একাংশ, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ছাত্র, সেনা, পুলিশ, বিডিআর, আনসার, সরকারি কর্মচারীসহ পেশাজীবীরা নিজ নিজ পেশায় ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সবার কাজে ফেরার সুযোগ ছিল না। অনেকে চাকরি বা কাজ হারিয়েছিলেন। অনেকের বাড়িঘরও পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বা তাদের দোসর রাজাকাররা। সবারই জানা, এসব মুক্তিযোদ্ধার বড় অংশ ছিল কৃষক ও ক্ষেতমজুর। আর মুসলিম লীগাররা ছিল প্রভাবশালী, জমির মালিক। তাদের জমিতে যারা কাজ করতেন বা বর্গাচাষি ছিলেন; এমন অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর এসব মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে প্রতিপক্ষ মুসলিম লীগের নেতাদের জমিতে কাজ করার মতো বাস্তবতা ছিল না। বর্গাজমিও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এসব মুক্তিযোদ্ধাকে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। শক্তিশালী ও ধনবান প্রতিপক্ষের সঙ্গে অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না। তদুপরি স্বাধীনতা-উত্তর মুক্তিযোদ্ধারা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিভাজিত হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাদের মধ্যে যে বন্ধন ছিল, তা টুটে যায়। ধনী মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে গরিব মুক্তিযোদ্ধার শ্রেণিগত দূরত্ব তৈরি হয়-যা মুক্তিযুদ্ধকালীন ছিল না। তখন একাত্তরের মতো একে অন্যের পাশে আর দাঁড়ায় না। ‘৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হয়রানির মাত্রা বেড়ে যায়। তখন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ই হয়ে ওঠে তাদের জন্য সমূহ বিপদ। ফলে অনেককে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়। যাদের ঠাঁই হয় শহরের বস্তিতে, টংঘরে। তারা রিকশা চালানোসহ নানা ধরনের পরিশ্রমের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কর্মক্ষমতা হারিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করেছেন- এমন দৃষ্টান্তও আমাদের জানা আছে।

পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের নামে যা কিছু হয়েছে তা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্মানজনক ছিল না। হাট-ঘাটের ইজারা দেওয়া হয়েছে, তোলা আদায়ের কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে। এমনও হয়েছে, যে জলমহাল জেলেদের ইজারা দেওয়ার কথা, তা মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের নামে দেওয়া হয়েছে। এমন সব উদ্যোগ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এখনও দেখি- স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘটা করে কম্বল, ছাতা দেওয়া হয়, তা পত্রিকায় ছাপাও হয়। এভাবেই রাষ্ট্র ও সমাজ যেন একাত্তরের বীরদের করুণা দেখাচ্ছে।

এটি স্বীকার্য যে, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের চাকরিতে কোটা প্রবর্তনসহ কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথমে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ছিল, পরে সম্মানী ভাতা করা হয়। অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে তাদের বাসস্থানের কথা ভাবতে হবে। সরকারের এমন উদ্যোগও রয়েছে। তবে সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুরূপ সুযোগের প্রয়োজন আছে কিনা তা ভাবতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের যখন সরকারি চাকরিতে কোটা দেওয়া হয়, তখন তা প্রশংসিত হয়েছিল। সম্প্রতি কোটার সুযোগ নাতি-পুতিদের পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের প্রতি সরকারের দায় আছে। তবে সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এমন কিছু করা ঠিক নয়, যা সাধারণ জনগণের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। কারও ভুললে চলবে না, মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরে যুদ্ধ করেছিলেন সমগ্র জাতির জন্য, ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়। তাই তাদের ব্যক্তিগত চাওয়ার চেয়ে বড় চাওয়া- একাত্তরের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ।

মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তির জন্য আরেকটি ক্ষতিকর দিক, তারা রাজনৈতিকভাবেও ব্যবহূত হচ্ছে। এ কারণেই যে দল ক্ষমতায় আসছে, তারাই নতুন নতুন ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বানাচ্ছে। এ সুযোগ নিচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধীরাও। কোনো চিহ্নিত রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে- এমন খবরও নানা সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহূত হচ্ছেন নানাভাবে। নির্বাচনের সময়ে দেখি- আওয়ামীপন্থি, বিএনপিপন্থি মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের ব্যানারে ভোট চাওয়ার হিড়িক। একজন মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা যে কোনো দল করতে পারেন, নিজ নিজ দলের জন্য ভোটও চাইতে পারেন, তা নিয়ে কথা নেই। কিন্তু দলীয় স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধাদের সামষ্টিক পরিচয় ব্যবহার করা কতটুকু যৌক্তিক? এমনও দেখা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের ব্যানারে রাজাকারের জন্য ভোট চাওয়া হয়। তবে রাজাকার প্রার্থীদের ঠেকানোর জন্য সঙ্গতভাবেই মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হতে পারেন। সেটি আপত্তির নয়, বরং জরুরি।

তবে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে- রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটছে কিনা- তা খতিয়ে দেখা। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন মুক্তিযোদ্ধারা বা মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন দলের অনুসারী হতে পারেন, যে কোনো প্রার্থীকে সমর্থনও করতে পারেন; তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে নয়।

এটি বলার অপেক্ষা রাখে না-মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ মানে মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভাজন থাকবে না। সামাজিক-অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, নিশ্চিত হবে বাক-ব্যক্তির স্বাধীনতা।

Advertisement