মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ড ঘিরে কিছু প্রশ্ন

।। একেএম শামসুদ্দিন।।

বাংলাদেশ পুলিশের কতিপয় সদস্যের ওপর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যে নিয়ন্ত্রণ নেই, তা ৩১ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হল।
মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে এখন দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় চলছে। এ ঘটনা দেশের মেইনস্ট্রিম পত্রিকা ও বেসরকারি টেলিভিশনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ভেতর যে হতাশা দেখা দিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। সেনা সদস্যদের সঙ্গে পুলিশের এমন আচরণ এটাই প্রথম নয়। ইতঃপূর্বে প্রতিটি ঘটনার পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও তাদের এ আচরণের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
বরং দিন দিন যেন এর মাত্রা বেড়েই চলেছে। ১৯৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) ওবায়দুর রহমান দু’জন ট্রাফিক সার্জেন্টের সহায়তায় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন গিয়াসকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা, ২০১৮ সালের ১ মে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের চন্দ্রার মোড়ে মেজর মুনিরকে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে লাঞ্ছিত করা, তার ঠিক দু’দিন পর ৩ মে রাজশাহীর মতিহার থানার এএসআই আশরাফ কর্তৃক সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার শাহ আলম ও তার পুত্র সৈনিক আমিনুল ইসলামকে লাঞ্ছিত করা ইত্যাদি ঘটনা সেনা সদস্যদের সঙ্গে পুলিশের কতিপয় সদস্যের ধারাবাহিক খারাপ আচরণেরই অংশ। ভাবতে অবাক লাগে-পুলিশ প্রশাসন এখন পর্যন্ত এমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি, যার মাধ্যমে এসব অবাঞ্ছিত ঘটনা বন্ধ করা যায়।
এ কথা সত্য, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ড অতীতের সব ঘটনাকে ছাপিয়ে গেছে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের ভেতর যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে, মেজর (অব.) সিনহা একজন তরুণ চৌকশ সেনা কর্মকর্তা ছিলেন।
তিনি সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। তার বয়সী অধিকাংশ তরুণ কর্মকর্তাই এখন সেনাবাহিনীর সৈনিকদের সরাসরি কমান্ড করছেন।
সিনহার মৃত্যুতে সেসব সৈনিকের ভেতরও যে হতাশা তৈরি হয়েছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষের ভেতরও এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সবাই এ ঘটনায় ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারও দাবি করেছেন তারা। কিন্তু সবার মনে একটাই সংশয়- পুলিশের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু বিচার হবে তো? মানুষের মনে এ সংশয়ের কারণও আছে। আমরা জানি, হত্যার পর ঘটনাটিকে জায়েজ করার জন্য পুলিশ মেজর (অব.) সিনহার চরিত্র স্খলনেরও চেষ্টা করেছে।
অথচ সেদিনের ঘটনার পর প্রতক্ষ্যদর্শীদের বক্তব্যে ধীরে ধীরে সত্য কাহিনী বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। পুলিশ দাবি করেছে, এসআই লিয়াকত মেজর সিনহার গাড়ি তল্লাশি করতে চাইলে সিনহা নিজের ব্যক্তিগত পিস্তল বের করার চেষ্টা করেন। এ সময় আত্মরক্ষায় লিয়াকত গুলি চালায়।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন অন্য কথা। তারা বলেন, সিনহাকে যখন গাড়ি থেকে বের হতে বলা হয়েছিল, তখন তিনি হাত উঁচু করে বেরিয়ে আসেন। বেরিয়ে আসার পরই এসআই লিয়াকত তাকে সরাসরি গুলি করেন।
গুলির আঘাতের পরও সিনহা বেঁচে ছিলেন। পুলিশ গুলি করেই বসে থাকেনি, গুলি খেয়ে সিনহা রাস্তায় পড়ে যাওয়ার ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান এবং আহত সিনহাকে বেশ কয়কটি লাথি মারেন, যা কোনো বাহিনীর সভ্য সদস্যের কাজ হতে পারে না। মেজর (অব.) সিনহার সঙ্গে এসআই লিয়াকত এবং ওসি প্রদীপ কুমার যে ব্যবহার করেছে, তা সেনাবাহিনীর প্রতি কতিপয় পুলিশ সদস্যের হিংসা ও বিদ্বেষেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
তাদের এ আচরণ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গেই কেবল তুলনীয়। এ ঘটনার পর কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার মাসুদও মিডিয়ার কাছে হতাশাব্যঞ্জক বক্তব্য দিয়েছেন।
তিনি লিয়াকতের পক্ষেই সাফাই গেয়ে মেজর (অব.) সিনহার চরিত্র স্খলনের চেষ্টা করেছেন। অথচ এসপি মাসুদ ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির সঙ্গে রামু সেনানিবাসে ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে সেখানে সম্পূর্ণ অন্য কথা বলে এসেছেন।
তিনি বলেছেন, এ মর্মান্তিক ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং এ ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের অপরাধের দায়ভার পুলিশ বাহিনী বহন করবে না। এখন প্রশ্ন হল, ইতঃপূর্বে এ ঘটনা সম্পর্কে এসপি মাসুদ যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেই অবস্থান থেকে তিনি কি তাহলে সরে এসেছেন?
এতদিন এ ধরনের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। তখন বলা হতো ব্যক্তিপর্যায়ে এ ঘটনা ঘটেছে। এখনও সে চেষ্টা অব্যাহত আছে; কিন্তু একের পর এক ধারাবাহিক এসব ঘটনার পর পুলিশ এখন তাদের দায় এড়াতে পারে না। দায়িত্বশীল যে কোনো পর্যায় থেকে যতই বলা হোক না কেন ‘এ ঘটনার জন্য ব্যক্তি দায়ী, সংগঠন দায়ী নয়।’ আমরা কিন্তু তা মনে করি না।
কারণ, এ কথাটি এখন আর খাটে না। মেজর (অব.) সিনহাকে হত্যার পর অন্তত এমন কথা বলার কোনো সুযোগ নেই! প্রশ্ন হল- সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আর কত ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটলে পুলিশ কর্তৃপক্ষ এসবের দায়িত্ব নেবে?
কতিপয় পুলিশ সদস্য কর্তৃক ইতঃপূর্বে সংঘটিত বেশ কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশেষ বিবেচনায় পুলিশ বাহিনীতে যোগদানকারী সদস্যরাই এসব ঘটনার মূল নায়ক।
এ পুলিশ সদস্যদের অতীতের রাজনৈতিক পরিচয়ই এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় সাহস জুগিয়ে থাকে। আলোচিত হত্যাকাণ্ডে জড়িত এসআই লিয়াকতেরও তেমন একটি অতীত রাজনৈতিক পরিচয় আছে বলে জানা গেছে।
এ ধরনের পুলিশ সদস্যই প্রজাতন্ত্রের আইনকানুনের ধার ধারে না। এদের অনেকেই নিজেকে সাবেক ছাত্রনেতা পরিচয় দিতে পছন্দ করে, অনেকেই আবার বড় নেতার আত্মীয় পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দবোধ করে, যা অনাকাক্সিক্ষত। সম্ভবত এ কারণেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বাহিনীর এসব সদস্যের ভেতর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। ৫ আগস্ট কক্সবাজার সফরে গিয়ে পুলিশের আইজি বলেছেন, কোনো উসকানিই সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে বিভেদ ঘটাতে পারবে না। উসকানি বলতে কী বুঝিয়েছেন তিনিই তা ভালো বলতে পারবেন। তবে এ কথা স্পষ্ট করে বলা যায়, সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে পুলিশের এহেন আচরণই বাহিনী দুটির মধ্যে বিভেদ তৈরির জন্য যথেষ্ট। এর জন্য কারও উসকানির প্রয়োজন পড়বে না। তবে আমরা মনে করি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধই সব সম্পর্কোন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।
মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশের প্রতিনিধিসহ সরকার চার সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। আশা করি, এ কমিটি প্রভাবমুক্তভাবেই তাদের কাজ করে যাবে। অপরদিকে মেজর সিনহার (অব.) পরিবারের পক্ষে আদালতে একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে।
আদালত র‌্যাবকে এ মামলার তদন্তের জন্য আদেশ দিয়েছেন। র‌্যাবও সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্তভাবে তদন্ত করবেন বলে আশা করি। হত্যাকাণ্ডের পরপর পুলিশের পক্ষ থেকেও দুটি মামলা করা হয়েছে।
পত্রিকার মারফত জেনেছি, সেই মামলায় হত্যার দায় সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাতের ওপর চাপিয়েছে পুলিশ। অথচ সিফাতই হল এ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ ও মূল সাক্ষী। বর্তমানে সিফাত পুলিশ কাস্টডিতে আছে।
পুলিশ কাস্টডিতে থাকা সিফাতের জীবনহানি হতে পারে বলে মনে করে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখেছি একটি বিশেষ এজেন্সির লোকজন ইতোমধ্যে নাকি সিফাতের আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। সিনহা হত্যাকাণ্ডের আরও কিছু স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যও আমরা শুনেছি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।
মিডিয়ায় তাদের বক্তব্য প্রকাশের পরই দেশবাসী মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কাহিনী জানতে পেরেছে বলে মনে হয়, যা পুলিশের ভাষ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। তদন্তকালে এসব সাক্ষীর বক্তব্য বিশেষ ভূমিকা রাখবে সন্দেহ নেই।
বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে নতুন যোগ দেয়া এসআই জাহাঙ্গীর ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় ইয়াবা দিয়ে আনোয়ার নামে এক প্রত্যক্ষদর্শীকে গ্রেফতার করতে গেলে স্থানীয়দের বাধার মুখে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
আশা করি, যথাযথ কর্তৃপক্ষ সেদিকে গভীরভাবে নজর রাখবেন। মনে রাখতে হবে, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে দেশের জনগণের কাছে এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা প্রকাশ পাবে।
ঈদের ছুটির মধ্যেও অতি দ্রুত উচ্চপর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠন করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাধুবাদ পেতেই পারে। এ বিষয়ে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও শুনেছি। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সাংবাদিকরা তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি তদন্তকাজে প্রভাব পড়তে পারে বলে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।
আমরা এতদিন শুনে এসেছি, বিচারকার্য চলাকালে কথা বলা উচিত নয়; কিন্তু তদন্তকালেও যে কথা বলা ঠিক নয়, মন্ত্রী মহোদয়ের কাছ থেকে এই প্রথম আমরা জানতে পারলাম! তবে একটি বিষয় অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি, তার অধীনস্থ একটি বাহিনীর সদস্য কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে মেজর (অব.) সিনহা মারা যাওয়ার পরও তিনি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি এতটুকুও সহানুভূতি প্রকাশ করলেন না। আমার মনে হয়, তিনি যদি সেই কাজটি করতেন তাহলে তদন্তকাজে এর কোনো প্রভাব পড়ত না বরং তাকে আরও মানবিক মনে হতো।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

Advertisement