মেয়াদোত্তীর্ণ ১০৯ কমিটিতে চলছে ছাত্রলীগ

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতে চলছে ছাত্রলীগের ১০৯ সাংগঠনিক জেলা। এর মধ্যে অন্তত ৩৭টি শাখার মেয়াদ শেষ হয়েছে ৪ থেকে ৯ বছর আগে। ৭২টি চলছে ২ থেকে ৩ বছরের পুরনোদের নিয়ে। কয়েকটিতে কোনো কমিটিই নেই। ফলে এসব জেলায় নেতৃত্বের জট তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে তৃণমূলে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। নিয়মিত নতুন কমিটি না হওয়ায় অছাত্ররা নেতা হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। দলের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে গ্রুপিং, কোন্দল। বয়স্করা ছাত্রনেতা হওয়ায় তাদের মধ্যে অর্থ আয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোকে তারা টাকা আয়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন। যা মূল দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে দারুণভাবে। এছাড়া সেশনজট, ছাত্রলীগের বয়সসীমা, শিক্ষাজীবনের সমাপ্তির কারণে কমিটির গুরুত্ব পদে না গিয়ে ছাত্রত্ব শেষ করছেন সংগঠনটির কয়েক লাখ ত্যাগী কর্মী।

ছাত্রলীগের মোট ১১১টি সাংগঠনিক জেলা আছে। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ দুই বছর এবং জেলা ইউনিটের মেয়াদ এক বছর। সেই হিসেবে বর্তমান কমিটি দুই বছর মেয়াদের এক বছর দুই মাস পার করেছে। এই ১৪ মাসে শোভন-রাব্বানী ছাত্রলীগের মোট ১১১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র দুটিতে কমিটি দিয়েছে। বাকি ১০৯টির কমিটি ভেঙে দেয়া, নতুনভাবে সম্মেলন বা কমিটি কিছুই করেনি। ফলে তৃণমূল সংগঠনে এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় সংগঠনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সিনিয়র সহসভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় বলেন, আমাদের হাতে ১০ মাস সময় আছে, এর মধ্যে পর্যায়ক্রমে মেয়াদোত্তীর্ণ সবগুলো কমিটি করার চেষ্টা করব। নেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) নির্দেশনা, আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজটি কীভাবে সহজ করা যায় সেটি ঠিক করব। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে যে ধরনের প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে সেগুলো নিয়ে সংগঠনের মধ্যে আলোচনা হবে। আশা করছি, ধারাবাহিকভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ জায়গায় নতুন কমিটি দিতে পারব। যেসব ইউনিটে নেতৃত্ব নেই সেগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখা হবে। নেতৃত্বজট যাতে তৈরি না হয়, সে বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকব।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের শাখা কমিটি গঠনে সদিচ্ছা ও সঠিক কর্মপরিকল্পনার অভাব তীব্র। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের হস্তক্ষেপ, দীর্ঘদিনের গ্রুপিং মেয়াদোত্তীর্ণ শাখাগুলোতে কমিটি দিতে না পারার প্রধান কারণ। তবে সাবেক নেতাদের কয়েকজন বলেন, তাদের সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারা যদি অযাচিত হস্তক্ষেপের চেষ্টা করতেন, তখন তারা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সহায়তা নিতেন। অনেক সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে পরামর্শ করে কমিটি দিতেন তারা। ছাত্রলীগের নতুন ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্বকেও এ বিষয়গুলো মেনে চলার পরামর্শ দেন।

গত বছরের ১১ ও ১২ মে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন ছাড়াই ছাত্রলীগের দুই দিনব্যাপী ২৯তম জাতীয় সম্মেলন শেষ হয়। ৩১ জুলাই রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি এবং গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ২৮তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সাইফুর রহমান সোহাগ ও এসএম জাকির হোসেন। ২০১৫ সালের ২৬ ও ২৭ জুলাই সম্মেলনের মাধ্যমে তারা নির্বাচিত হন। এর আগে ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। আর ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন মাহমুদ হাসান রিপন ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন। অতীতে কেন্দ্রীয় কমিটিও সময়মতো পরিবর্তন হয়নি।

ছাত্রলীগ সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের সংগঠনিক জেলা ছিল ১০৯টি। শোভন-রাব্বানীর সময় দুটি ইউনিট বৃদ্ধি করায় সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১১। এক যুগের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও রিপন-রোটনের সময়ে দেয়া অনেক কমিটি এখনও ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ে বিদ্যমান। যেমন বরিশাল জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়েছে ২০১১ সালের ৯ জুলাই। সেই কমিটি এখনও বহাল। বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় কেবল সভাপতি দিয়েই চলছে শাখাটি। বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন ইউনিটেও এ ধরনের চিত্র বিদ্যমান বলে জানান নেতাকর্মীরা।

ছাত্রলীগের সোহাগ-জাকির কমিটির সূত্র জানায়, তাদের সময়ে ১০৯টি ইউনিটের ৩৭টিতে নতুন কমিটি দিতে পারেননি। সেই শাখাগুলোতে শোভন-রাব্বানী এসেও কমিটি দেয়নি। ফলে ৪-৯ বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে ওইসব ইউনিট। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের রয়েছে ৫টি শাখা। এগুলো হচ্ছে- বরিশাল জেলা ও মহানগর, ঝালকাঠি, ভোলা, বরগুনা শাখা। রংপুর বিভাগের চারটি শাখায় কমিটি হয়নি। রংপুর জেলা ও মহানগর, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও। চট্টগ্রাম জেলায় ৮টি শাখায় কমিটি হয়নি। শাখাগুলো হল- চট্টগ্রাম মহানগর, কুমিল্লা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, ফেনী, কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলা (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান)। খুলনা বিভাগের বাগেরহাট ও খুলনা মহানগর কমিটি দিতে পারেনি সোহাগ-জাকির।

সোহাগ-জাকিরের কমিটিতে রাজশাহী বিভাগের ৫টি শাখায় কমিটি হয়নি। সেগুলো হল- রাজশাহী জেলা ও মহানগর, নাটোর, বগুড়া, জয়পুরহাট। সিলেট বিভাগের ৩টি শাখায় কমিটি হয়নি। শাখাগুলো হল- সিলেট জেলা ও মহানগর এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটি ভাঙা হলেও চলছে নতুন নেতৃত্ব ছাড়া। ঢাকা বিভাগের ৮টি ইউনিটে নতুন কমিটি দিতে পারেনি। এগুলো হচ্ছে- কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর জেলা ও মহানগর। এর মধ্যে গাজীপুর মহানগরের সম্মেলন হয়েছে, কমিটি হয়নি। ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনা, জামালপুরেও সোহাগ-জাকিরের সময় কমিটি হয়নি।

হিসাব অনুযায়ী, সাবেক সভাপতি সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক জাকিরের সময় ১০৯টি ইউনিটের মধ্যে তারা মোট ৭২টি কমিটি দিতে পেরেছিল। তার দায়িত্বে ছিল প্রায় তিন বছর। ফলে তারা যেসব শাখায় কমিটি দিতে পারেনি তার মেয়াদ এখন চার বছরের বেশি। আর সোহাগ নাজমুল কমিটি প্রায় সাড়ে চার বছর দায়িত্বে থেকে সাংগঠনিক জেলার কমিটি দিয়েছে ৮৫টির মতো। আর শোভন-রাব্বানীর কমিটি এক বছর দুই মাস দায়িত্ব পালন করে মাত্র দুটি শাখায় কমিটি দিয়েছে। তবে তারা কেন্দ্র থেকে বেশ কয়েকটি উপজেলা কমিটি করেছে। নিকট-অতীতে কোনো সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে কেন্দ্র থেকে এই পরিমাণে উপজেলা কমিটি করতে দেখা যায়নি।

এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজসহ কয়েকটি শাখায় সম্মেলন এবং কয়েকটি শাখায় কমিটি ভেঙে দিয়েও নতুন কমিটি করতে পারেনি শোভন-রাব্বানী। যে দুটি শাখায় (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়) কমিটি হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। ছাত্রলীগের প্রধান ইউনিট বলে বিবেচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ‘প্রাণ’ ১৮টি হল কমিটি গঠনেও শোভন-রাব্বানীর মধ্যে ছিল এক ধরনের উদাসীনতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের হল কমিটিগুলো হয়েছে ২০১৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর। সেই হিসেবে এই কমিটি প্রায় তিন বছর (দুই বছর নয় মাস) অতিবাহিত করেছে। এ সময়ে শাখাগুলোতে নতুন নেতৃত্ব না আসায় নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। এই হল শাখাগুলোর অধিকাংশ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে পদ পেয়েছেন। ফলে হলগুলোতে এক ধরনের সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। একেকটি হলে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ঘিরে ৪ থেকে ১০টি গ্রুপ ও সাবগ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে।

নেতাকর্মীরা বলছেন, কমিটি গঠনে বিলম্বের ফলে নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা রাজনীতি করেন তাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত বা নিুমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। যদি নিয়মিত কমিটি হয় সেক্ষেত্রে পদ না পেলে তারা পড়াশোনায় মনোনিবেশ করার সুযোগ পান। কিন্তু অনিয়মিত কমিটি হলে পদ না পেলে একদিকে পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে ছাত্রলীগের বেঁধে দেয়া ২৯ বছর বয়সের সময়সীমার কারণে পরবর্তী কমিটিতে রাজনীতি করারও আর সুযোগ থাকে না। হারিয়ে যায় সরকারি চাকরিতে যোগদানের বয়স। এতে করে পদ ছাড়া ছাত্র রাজনীতি শেষ করতে হয়। ফলে লবিং-তদবিরের পরিবর্তে যোগ্য ও মেধাবীদের দিয়ে নিয়মিত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন তারা। স্থানীয় পর্যায়ে কমিটিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবিও রয়েছে তাদের।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র ও ছাত্রলীগের সাবেক কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন বলেন, ছাত্র রাজনীতির মূল কথা নেতাকে ছাত্র হতে হবে। যদি অনিয়মিত সম্মেলন হয়, তখন অছাত্রদের কমিটিতে পদ পাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এর ফলে তারা ছাত্রদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেন না। সেজন্যই ছাত্রলীগে নির্দিষ্ট একটি বয়স দিয়ে আমাদের নেত্রী নিয়মিত ছাত্রদের নেতৃত্বে আনার নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ তার নির্দেশনা সেভাবে মানা হয় না। যদি নিয়মিত সম্মেলন হয়, তখন একজন ছাত্র তার ক্যারিয়ার নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। হতাশায় পড়তে হয় না। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণে মেধাবী শিক্ষার্থীদের দিয়ে নিয়মিত কমিটি হতেই হবে। কারও সুপারিশে পদ দেয়া চলবে না। যোগ্যতা ও ত্যাগের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে। এতে করে নেত্রীর চাওয়া অনুযায়ী ছাত্র রাজনীতি সুস্থধারায় ফিরে আসবে।

Advertisement