রংপুরে নদী পুনঃখননে বছরে ১২৫ কোটি টাকা মূল্যের অতিরিক্ত আমন ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা

বৃহত্তর রংপুরে খাল ও নদী পুনঃখননের ফলে ১০,০০০ হেক্টর জমি থেকে প্রতি বছর ১২৫ কোটি টাকা মূল্যের ৫০,০০০ টন অতিরিক্ত আমন ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।সরকারি সূত্রে বলা হয়েছে, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) উদ্যোগে ৬৬ দশমিক ৮০ কিলোমিটার খাল ও নদী পুনঃখননের ফলে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার ছয়টি উপজেলায় ১০ হাজার হেক্টর জমি জলাবদ্ধতা মুক্ত হওয়ায় প্রায় চার দশক পর এ সকল জমিতে ধান উৎপাদনের এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পাঁচ বছর (২০১৯-২০২৪) মেয়াদি ”ভূউপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ” (ইআইআরপি) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বৃহত্তর রংপুর জেলায় বিএমডিএ গত দু’বছরে উক্ত পুনঃখনন কাজ বাস্তবায়ন করেছে।
এর ফলে বিলুপ্তপ্রায় খাল ও নদীগুলোতে পুনরায় সারা বছর পানি প্রবাহ প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিস্তীর্ণ জমি জলাবদ্ধতামুক্ত হয়ে চলতি বর্ষা মৌসুম থেকে আবারও চাষযোগ্য হয়ে প্রকল্প এলাকার প্রায় ১৫,০০০ কৃষক সহ ৭৫,০০০ জন মানুষ উপকৃত হয়েছেন।রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বড় বদনাপাড়া গ্রামের কৃষক মো. কায়কোবাদ বাসস’র সাথে আলাপকালে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিলুপ্ত চতরা খাল পুনঃখননের ফলে উক্ত এলাকায় বিস্তীর্ণ জমি জলাবদ্ধতা মুক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, “চার দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো এ বছর জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হওয়া দু’একর জমিতে আমি চলতি বর্ষা মৌসুমে আমন ধান চাষ করছি। এলাকার শত শত মানুষ আমন ধান চাষের পাশাপাশি এখন খালের পানিতে হাঁস পালন করছেন, পাটের গাছ জাগ দিচ্ছে এবং দেশি মাছ ধরছেন।পার্শ্ববর্তী কাঁটাদুয়ার গ্রামের মজিবুর রহমান জানান, সাম্প্রতিক খরার মতো পরিস্থিতির সময় তিনি পুনঃখনন করা চতরা খাল থেকে একটি লো-লিফট পাম্প ব্যবহার করে পানি তুলে আমন ধানের চারা রোপণের জন্য তার ফসলি জমিতে সেচ দিয়েছেন।
অন্যদের মতো একই গ্রামের সুমন শরীফ মন্ডল বলেন, বিলুপ্ত চতরা খাল পুনঃখননের ফলে চার দশকের মধ্যে প্রথমবারের মত জলাবদ্ধতামুক্ত হওয়ায় তিনি তার তিন একর জমিতে এবার আমন ধান চাষ করছেন।
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার সংকরপুর গ্রামের মশিউর রহমান জানান, বিলুপ্তপ্রায় মরা তিস্তা নদীর ১২ কিলোমিটার অংশ পুনঃখননের ফলে খালটিতে বছরব্যাপী পানির প্রবাহ পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় এর পানি বহন ক্ষমতা বেড়েছে এবং এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকার জমিগুলোকে জলাবদ্ধতা মুক্ত করেছে।
জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হওয়া তার ২.৬২ হেক্টর জমিতে এখন আমন ধান চাষ করেছেন, উল্লেখ করে তিনি বলেন, তার মত এলাকার শত শত কৃষক জলাবদ্ধতামুক্ত হওয়া তাদের জমিতে এখন বছরে আমন ধানসহ তিনটি ফসল চাষ করতে পারবেন।পার্শ্ববর্তী কামারপাড়া গ্রামের গৃহবধূ মমিনা বেগম জানান, বিলুপ্তপ্রায় মরা তিস্তা নদীর পুনঃখনন স্থানীয় হাজার হাজার কৃষকের মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে এবং মরা তিস্তা নদীর পুনঃখনন আশীর্বাদ এলাকার জন্য হয়ে উঠেছে।মমিনা বলেন, “অন্য অনেকের মতো আমিও পুনঃখননকৃত মরা তিস্তা নদীর তীরে সবজি, কলা ও নিপিয়ার ঘাস চাষ করছি এবং নদীটির বহমান পানিতে হাঁস পালন করছি।” একই উপজেলার কাজীপাড়া গ্রামের গোলাম মর্তুজা জানান, বিলুপ্তপ্রায় ঘিরনই (ঘিৃল্লাই) নদী পুনঃখননের ফলে বিস্তীর্ণ জমি জলাবদ্ধতা মুক্ত হয়েছে এবং এলাকার অনেক কৃষকের মত তিনিও চলতি মৌসুমে ১.৫০ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ করছেন।এদিকে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার মনুর ছড়া গ্রামের কৃষক এবিএম নিজাম উদ্দিন জানান, সম্প্রতি বিলুপ্তপ্রায় আলাইকুমারী নদী ও ঝিনিয়া খাল পুনঃখনন করায় শত শত হেক্টর জমি জলাবদ্ধতা মুক্ত হয়ে জমি আবারো আবাদযোগ্য হয়েছে।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মোতালেব বলেন, বিএমডিএ বিলুপ্ত বোয়ালেদারা খালের আট কিলোমিটার অংশ পুনঃখনন করায় চার দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো এলাকার ৭০০ হেক্টর জমি জলাবদ্ধতা মুক্ত হয়ে পুনরায় আবাদযোগ্য হয়েছে।তিনি বলেন, “খালটিতে পানির প্রবাহ পুনরুজ্জীবিত হওয়াার ফলে এলাকার ১,২০০ জন কৃষকসহ ১৫,০০০ জন মানুষ উপকৃত হয়েছেন। তারা এখন খালটিতে সংরক্ষিত ভূউপরিউস্থ পানি সেচ, সম্পূরক সেচ, হাঁস পালন, মাছ চাষ এবং গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করছেন।”বাসস’র সাথে আলাপকালে রংপুরের পীরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান আবু নাসের শাহ মো. মাহবুবার রহমান বলেন, বিলুপ্তপ্রায় খাল ও নদী পুনঃখননের ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা জলাবদ্ধতা মুক্ত হওয়ায় সেখানে পুনরায় আমন ধান চাষসহ বিভিন্ন ধরণের ফসল চাষের ঘনত্ব ও ফলন বাড়ানোর পথ সুগম হয়েছে।তিনি বলেন, “বিএমডিএ কর্তৃক বিলুপ্ত জলাশয়গুলি পুনঃখনন করায় উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে দ্রুত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পাশাপাশি ভূপৃষ্ঠের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ায় কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ইআইআরপি প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়িত কাজের মানের প্রশংসা করে জনৈক রহমান রংপুর অঞ্চলে টেকসই গ্রামীণ যোগাযোগ নেটওয়ার্কের জন্য বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে বাস্তবায়িত কাজের মডেল অনুসরণ করে বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের জন্য বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।ইআইআরপি প্রকল্প পরিচালক এবং বিএমডি’র রংপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান খান বলেন, আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে ২৫০.৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ বহুমাত্রিক সুবিধা ভোগ করবেন।তিনি বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই বিলুপ্তপ্রায় ৬৬.৮০ কিলোমিটার নদী ও খাল পুনঃখননের মাধ্যমে প্রকল্পের ৩৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করেছি এবং ১০,০০০ হেক্টর জমি জলাবদ্ধতামুক্ত হওয়ার ফলে ইতোমধ্যেই প্রতিবছর অতিরিক্ত ৫০,০০০ টন আমন উৎপাদনের সুযোগ সৃস্টি হয়েছে।

Advertisement