ষাটের দশকে যখন সমাজতান্ত্রিক আদর্শের রাজনীতি দেশে এবং তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বে, এমনকি ইউরোপে জনপ্রিয় ধারা, তখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দক্ষিণপন্থা থেকে সরে বামপন্থার দিকে ঝুঁকেছিল। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অঙ্গন মিলে যে বৃহত্তর জাতীয় প্রেক্ষাপট, তাতে বামপন্থার জোয়ারে আওয়ামী লীগও অংশীদার হয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে তার এ অংশীদারত্ব আরও জোরদার হয়েছিল।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা যখন ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন, তখনো রাজনীতিতে ষাটের দশকে সৃষ্ট জোয়ারের রেশ মিলিয়ে যায়নি। তাঁকে এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন দলকে সিপিবিসহ বামদের মিত্র হিসেবেই দেখা গেছে। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, বার্লিন দেয়ালের ভাঙন, পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পরেও ঘাতক-দালাল নির্মূল আন্দোলনসহ অতীতের প্রগতিমুখী চেতনার কার্যক্রমে তাঁর সক্রিয় সমর্থন ছিল। কিন্তু ১৯৯১-এর নির্বাচনে দলের পরাজয় শেখ হাসিনার জন্য কেবল অবিশ্বাস্য আঘাতই ছিল না, তা সম্ভবত দলের রাজনীতির পুনর্মূল্যায়নেও বাধ্য করেছিল।
এটি পরিষ্কার ছিল যে আওয়ামী লীগবিরোধী মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের ভোটেই পার্থক্যটা গড়ে দিয়েছিল। বোঝা যাচ্ছিল ষাট-সত্তর দশকের মতো বামপন্থার আবেদন আর নাগরিক সমাজে একচেটিয়া ও সামূহিক থাকেনি। ১৯৪৬-৪৭-এ যে মুসলিম আত্মপরিচয়ের চেতনা বাঙালি মুসলমানকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় আবেগপ্রবণ করেছিল, তা তখন সাময়িক ভাবালুতার বেশি কোনো রাজনৈতিক দর্শন বা চেতনার জন্ম দেয়নি। ফলে ভাষার এবং পরে সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক প্রশ্নে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে তার অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ১৯৯১ নাগাদ দেখা যাচ্ছে ইসলামি চেতনার রাজনীতি ও মুসলিম স্বাতন্ত্র্যের দিকে সমাজের বড় অংশের ঝোঁক বেড়েছে। আর স্বাধীনতার পর থেকেই কখনো সামাজিক দায়বোধ থেকে, কখনো অত্যন্ত সচেতন রাজনৈতিক চিন্তা থেকে দেশে ব্যাপক হারে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। জামায়াত এবং তাদের সহযোগী অনেক সংগঠন এগুলোকে কেন্দ্র করে ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মসূচি প্রচার করতে সক্ষম হয়। এ ধারার সামাজিক প্রভাব ক্রমেই বেড়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও সমাজতন্ত্রের ভাটা, বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজারের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী ভূমিকা এবং যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ভারতসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অনেক দেশে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীলতার উত্থানের মধ্যে এ দেশেও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক চেতনা ও সংস্কৃতির প্রভাব বেড়েছে। ফলে আমাদের’ ৯১ পরবর্তী গণতন্ত্রের চর্চায় ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িক উদার মানবতার পরিবর্তে ধর্মীয় চেতনা ও রক্ষণশীল সংস্কৃতির প্রসার ঘটেছে।
এ সময়ে আওয়ামী লীগেও এই রূপান্তর লক্ষ করি। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে সিয়াটো-সেন্টোর মতো সাম্রাজ্যবাদী চক্র থেকে সমাজতন্ত্রের মতো জনবান্ধব চেতনায়, মার্কিন দোসর ভাবমূর্তি থেকে সোভিয়েত ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বমুখী করেছিলেন। আর কন্যা শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক দলের রাজনীতিতে ধর্মীয় চিন্তা ও সংস্কৃতির প্রকাশ জোরদার করেছেন, আদর্শের রাজনীতির অবসান ঘটতে দিয়ে বাস্তব কৌশল ও তাৎক্ষণিক প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এর ফলে দলের সম্পাদকের ভাষায়, অনেক কাউয়া ও অনেক বসন্তের কোকিল আজ আওয়ামী লীগে ভিড় করেছে।
একসময় অনেকেই বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা খাটেনি, বরং আজ দেশের উন্নয়নের প্রেক্ষাপটেও নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বাংলাদেশের পুরোনো ধারার রাজনীতির অবসান হয়েছে। প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা এই সময়ের রাজনৈতিক চাহিদা অনুধাবন করছেন কি না? নাকি কেবল ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য কৌশল, আপস ও সুবিধার পথ বেছে নিচ্ছেন। তাঁর নেতৃত্বের এই এক দশকে রাজনৈতিক অঙ্গনে বাম ও মধ্য ধারার রাজনীতির অবসান ঘটতে দেখছি। ডান ও রক্ষণশীল ধারাকে আত্তীকরণের মাধ্যমে নিস্তেজ করে তুলতে দেখেছি। আর দেখেছি রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হতে। তাঁর শাসনামলে দেশে সামাজিক নেতৃত্বও বহুলাংশে কার্যকারিতা হারিয়েছে। এর জন্য তিনিই দায়ী এমন কথা বলি না, কিন্তু এটাই হলো বাস্তবতা।
বিপরীতে এ বাস্তবতায় শূন্য রঙ্গমঞ্চে তিনিই বাংলাদেশের আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। সেখানে তিনি নিঃসঙ্গ, একাকী—পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোনো প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির নিজস্ব নিয়মে অনিবার্য নয়, তাঁর ওপর কোনো বাধ্যবাধকতা খাটে না, নিজের ইচ্ছায় তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন। একক নেতার ওপর নির্ভরশীল যে শাসনব্যবস্থা, তা ভোটে নির্বাচিত হলেও ক্রমেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং রাজনীতির অবসান ঘটাতে থাকে। তাতে সমাজের বহুত্ববাদী প্রবণতা ও নানামুখী অংশীদারত্বের সুযোগ হ্রাস পায়, সমাজবিকাশ ব্যাহত হয়।
মানুষ ও দেশের স্বার্থে আমাদের গণতন্ত্রকেই গুরুত্ব দিতে হবে। আর গণতন্ত্রের জন্য জোর দিতে হবে রাজনীতির ওপর। প্রশ্ন হলো, এই যুগোপযোগী রাজনীতি কে শুরু করবেন? শেখ হাসিনা নাকি আর কেউ? রাজনীতিবঞ্চিত তরুণ সমাজের অংশ মাঠ থেকে সাম্প্রতিক কালে কয়েকবার চলমান ব্যবস্থায় তাদের অসন্তুষ্টির জানান দিয়েছে। সেই সঙ্গে পরিবর্তনের জন্য তাদের আকুতি ও সক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়েছে।
শাসনব্যবস্থা ও সরকার পরিচালনা নিয়ে তাদের আপত্তি যেমন আছে, তেমনি করণীয় সম্পর্কে বলার মতো কথাও আছে। সুযোগ পেলে বা উপলক্ষ কাজে লাগিয়ে সুযোগ তৈরি করে তারা বারবার মাঠেও নামছে। অসংগঠিত শক্তিকে বুঝ দিয়ে, চাপ দিয়ে সাময়িকভাবে নিরস্ত করা সম্ভব। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও দেখা গেছে যে এসব স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সামাল দিতে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ আর কার্যকর নয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা হয়তো কার্যকর হচ্ছেন, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক আলোচনা-সমঝোতার প্রয়াস তাতে নেই।
আজ আর অতীতের মতো কেবল স্বপ্ন দেখিয়ে মানুষকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা যাবে না। মানুষের সামনে জীবনকে সমৃদ্ধ করার, ভোগ-উপভোগের অনেক পথ খুলে গেছে, খুলে যাচ্ছে। এখনকার মানুষ জীবন উৎসর্গের রাজনীতি করবে না, তারা করবে জীবন নির্মাণ ও জীবনকে সমৃদ্ধ করার রাজনীতি। আদর্শের বুলির চেয়ে বাস্তব কর্মসূচির মূল্যায়ন হবে বেশি। একসময় কৌশল আর জবরদস্তির রাজনীতিও অচল হয়ে পড়বে। প্রকৃত মূল্যেই নেতার মূল্যায়ন হবে—ক্ষমতা, প্রভাব খাটিয়ে, এমনকি কোনো আদর্শ বা কারও ভাবমূর্তি ধার করেও চলবে না।
এটা যে ঘটতে চলেছে তা বোঝা যাবে দুটি বাস্তব চিত্র থেকে—কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি ছাড়াই সাধারণ ছাত্রদের ভোটে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়া সম্ভব এবং পরপর একাধিক নির্বাচন থেকে বোঝা যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো গণতন্ত্রের আবশ্যিক অনুষঙ্গ পরাজয়ের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছে। অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থেকে, অনেক ষড়যন্ত্র ও পীড়নের শিকার হয়েও জনগণের শক্তিতেই গড়ে উঠেছিল ও টিকে থেকেছে। তামাদি রাজনীতির বৃত্ত ভেঙে নতুন দিনের যুগোপযোগী রাজনীতির ধারা খুঁজে নিতে হলে এসব আলামতের আরও ব্যাখ্যা ও অন্বেষণ প্রয়োজন।