রেলের টিকিট চেকার থেকে ভারতের সর্বকালের সফল অধিনায়ক

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হওয়া। কিন্তু ব্যাটে-বলে মিলছিল না। পারিবারিক কারণে যোগ দেন রেলের চাকরিতে। কিন্তু যাকে ক্রিকেট টানছে, সে কি আর চাকরির বেড়াজালে নিজেকে বন্দি রাখতে পারে? তখনই জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্তটি নেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। রেলের টিকিট পরীক্ষকের চাকরিটা ছেড়ে দেন। আবারও ফিরে আসেন ক্রিকেটে। এরপর হয়ে ওঠেন ভারতের সর্বকালের সফলতম অধিনায়ক। যার ঝুলিতে দুটি বিশ্বকাপ আর একটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।

ব্যাডমিন্টন এবং ফুটবল, দুটোই দারুণ খেলত রাঁচীর ডিএভি জওহর বিদ্যামন্দিরের কম কথা বলা ছাত্র ধোনি। বিশেষ করে ফুটবলে গোলরক্ষকের ভূমিকায় তো তার জুড়ি নেই। এক দিন তাকে অন্য এক খেলার জন্য ডেকে পাঠালেন কোচ। স্থানীয় ক্লাবে উইকেটরক্ষকের প্রয়োজন ছিল। জীবনে এক দিনও ক্রিকেট না খেলা সেই কিশোর প্রথম দিনই বাজিমাত করল উইকেটকিপিংয়ে। রাঁচীর কম্যান্ডো ক্রিকেট ক্লাবে নিজের অজান্তেই ভবিষ্যতের ইতিহাস লিখেছিল সেদিনের কিশোর ধোনি।

ধোনির আদি নিবাস উত্তরাখণ্ডের আলমোরা জেলার। তার বাবা কর্মসূত্রে চলে এসেছিলেন রাঁচীতে। ১৯৮১ সালের ৭ জুলাই সেখানেই তার জন্ম হয়। ক্লাব ও জেলাস্তরের ফুটবল ও ব্যাডমিন্টনে ধোনি ছিলেন উদীয়মান খেলোয়াড়। কিন্তু দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে পছন্দের ঝোঁক ঘুরে যায় ক্রিকেটের দিকে। শচীন-গিলক্রিস্টের পাশাপাশি আরও এক তারকার ভক্ত ছিলেন ধোনি। তিনি বলিউড তারকা জন আব্রাহাম। তাকে দেখেই নিত্যনতুন হেয়ারকাট করাতেন তিনি। জনের প্রতি ভালোবাসা থেকেই বাইকের প্রতি তার অনুরাগ জন্মায়।

উদীয়মান ক্রিকেটার হিসেবে ধোনিকে চিহ্নিত করেন সাবেক ক্রিকেটার প্রকাশ পোদ্দার। বাংলা ও রাজস্থানের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা প্রকাশ ২০০৩ সালে প্রথম ধোনিকে খেলতে দেখেন। জামশেদপুরে ধোনি তখন খেলছিলেন ঝাড়খণ্ডের হয়ে। ছোট শহর থেকে প্রতিশ্রুতিমান ক্রিকেটারদের চিহ্নিত করার জন্য ষাটের দশকে বাংলার হয়ে অধিনায়কত্ব করা প্রকাশকে দায়িত্ব দিয়েছিল বিসিসিআই। তিনি ধোনি সম্পর্কে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিকে জানান। ২০০৩-০৪ মৌসুমে ধোনি চোখে পড়ে যান তখনকার অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীর। সে সময় তিনি ভারত সালে দলের হয়ে জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া সফর করছিলেন। ৬ ইনিংসে ৩৬২ রান করে ধোনি হয়ে ওঠেন জাতীয় দলে খেলার প্রধান দাবিদার।

২০০৪-০৫ মৌসুমে ধোনি প্রথম সুযোগ পান বাংলাদেশ সফরের ওয়ানডে দলে। প্রথম ম্যাচেই ০ রানে রানআউট। মাঝারি মানের সফরের পরেও ধোনি সুযোগ পান পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে। সাবেক উইকেটকিপার সৈয়দ কিরমানির সমালোচনা সত্ত্বেও ধোনি ধীরে ধীরে দলে স্থায়ী জায়গা করে নেন। সে সময়কার অন্য উইকেটকিপার পার্থিব পটেল এবং দীনেশ কার্তিককে পিছনে ফেলে ধোনি-ই হয়ে ওঠেন প্রধান উইকেটরক্ষক।

২০০৭ সালে বাংলাদেশের কাছে হেরে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম রাউন্ডেই ছিটকে যায় ভারত। সে সময় দেশ জুড়ে চরম সমালোচনার মুখে পড়েন ধোনি। প্রতিযোগিতায় তার সংগ্রহ ছিল মাত্র ২৯ রান। ক্যারিয়ারের এই ছন্দপতনকে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেননি এম এস। বিশ্বকাপ বিপর্যয়ের পরে দ্রুত ছন্দে ফেরেন তিনি। ২০০৭ সালে ইংল্যান্ড সফরে রাহুল দ্রাবিড়ের অধিনায়কত্বে থাকা ভারতীয় দলের সহ অধিনায়ক নির্বাচিত হন। সে বছরই সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে পেয়ে যান অধিনায়কত্বের দায়িত্ব।

ধোনির ক্যারিয়ারে অন্যতম মাইলফলক ২০১১ বিশ্বকাপ ক্রিকেট। যদিও ব্যক্তিগত ভাবে এই প্রতিযোগিতায় ধোনি খুব বেশি রান করতে পারেননি। ৭ ইনিংসে তার সংগ্রহ ছিল মাত্র ১৫০ রান। কিন্তু এই টুর্নামেন্ট থেকেই ধোনির নামের পাশে জুড়ে যায় ‘ফিনিশার’ পরিচয়। কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া এবং সেমিফাইলানে পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইলানে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হয় ভারত। ২৭৫ রান তাড়া করতে নেমে ভারতকে জয় তথা বিশ্বকাপ এনে দেয় গম্ভীর, ধোনি এবং যুবরাজের ইনিংস। ৯১ রানে অপরাজিত ধোনি ছক্কা মেরে দলকে বিশ্বকাপ জিতেয়ে দেন।

ক্রিকেটপ্রেমী অনেকেরই মত, দলের ভিত নিজের হাতে তৈরি করেও ২০০৩ বিশ্বকাপে শেষ হাসি হাসতে পারেননি সৌরভ গাঙ্গুলী। তার তৈরি জমিতেই পরে ধোনি সোনার ফসল ফলিয়েছেন। আবার অনেকের মতে, ভারতীয় দলের সাফল্যের পিছনে ক্যাপ্টেন কুলের অবদান অনস্বীকার্য। পরিসংখ্যানের দিক থেকেও অধিনায়ক হিসেবে ২৭টি টেস্ট জয় করে তিনি ছাপিয়ে গিয়েছেন সৌরভের ২১ টেস্ট জয়ের কৃতিত্বকে। তার নেতৃত্বেই ১১০ টি ওয়ানডে এবং ৪১ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে জয়ী হয়েছে ভারত। ২০১১ বিশ্বকাপের পরে ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিরল কৃতিত্বের ভাগীদার হন ধোনি। তার নেতৃত্বে টি২০ বিশ্বকাপও জেতে ভারত।

পৃথিবীতে একমাত্র ক্রিকেট অধিনায়ক হিসেবে আইসিসির সব ট্রফি জেতার রেকর্ড রয়েছে শুধুমাত্র তার পকেটেই। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে সীমিত ওভারে ম্যাচে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন ধোনি। তার আগে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ছেড়ে দেন টেস্ট ক্রিকেট। ২০১৯ সালে তিনি বিরাট কোহলির নেতৃ্ত্বে খেলেন বিশ্বকাপে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালে হেরে বিদায় নেয় ভারত। ৯ জুলাই খেলা ওই ম্যাচই ধোনির ক্যারিয়ারের ৩৫০ তম তথা শেষ ওয়ানডে। গতকাল সোশ্যাল সাইটে পোস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দিয়েছেন ধোনি।

এই ক্রিকেট খেলার সুবাদেই তিনি একসময় চাকরি পেয়েছিলেন ভারতীয় রেলে। খড়গপুর স্টেশনে ২ বছর টিকিট পরীক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন। সহকর্মীরা তাকে চিনতেন সৎ ও পরিশ্রমী হিসেবে। টিটিই সালের কালো কোট থেকে ভারতের জাতীয় দলে যাত্রাপথে বার বার তিনি সবাইকে বিস্মিত করেছেন। ২০১৮ সালে তিনি পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন। বর্ণময় ক্যারিয়ারে বার বার ধোনির নাম জড়িয়েছে বলিউড তারকাদের সঙ্গে। দীপিকা পাড়ুকোন, রাই লক্ষ্মী থেকে আসিনসহ কয়েকজনের নাম শোনা গেছে। তবে সব গুঞ্জন বন্ধ করে ২০১০ সালের জুলাই মাসে ধোনি সাতপাকে বাঁধা পড়েন সাক্ষী সিং রাওয়াতের সঙ্গে।

জীবনসঙ্গী সাক্ষীর সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে। দেহরাদূনের মেয়ে সাক্ষী সেখানে ট্রেনি ছিলেন। চিনতে না পেরে তিনি ধোনির কাছে পরিচয়পত্র দেখতে চেয়েছিলেন। নিজের কর্তব্যের প্রতি অবিচল থাকা এই তরুণীই মন জয় করে নিয়েছিলেন তারকা ক্রিকেটারের। রেলের টিকিট পরীক্ষক থেকে ভারতের অন্যতম সফল অধিনায়ক হওয়ার যাত্রাপথে লুকিয়ে আছেন আরও এক জন। তিনি ধোনির প্রথম প্রেমিকা। তরুণীর নাম ছিল প্রিয়ঙ্কা ঝা। তার সঙ্গেই বাকি জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন ধোনি। কিন্তু ধোনি বিদেশ সফরে থাকা অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। ধোনির এই জীবনী যিনি সিনেমার পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন, সেই সুশান্ত সিং রাজপুত কিছুদিন আগে আত্মহত্যা করেছেন।

Advertisement