Dr. Zaki Rezwana Anwar FRSA
একটি বাই ইলেকশনের ফলাফল দিয়ে আমরা সাধারণত পুরো দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করি না বা করা যায় না। কারণ একটি বাই ইলেকশনের ফলাফল হচ্ছে ঐ এলাকার স্থানীয় রাজনীতির মুডের প্রতিফলন। কিন্তু সত্যিই কি এবারের হার্টলেপুলের বাই ইলেকশনটি এ ধরনেরই একটি বাই ইলেকশন যার ফলাফলকে আমলে না নিয়ে পারা যায়?
মাত্র দু’দিন আগে বৃটেনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বেশ কয়েকটি নির্বাচন: ওয়েলশ ও স্কটিশ ইলেকশন, ইল্যান্ডের লোকাল কাউন্সিল ইলেকশন, লন্ডন মেয়রাল ইলেকশন এবং হার্টলেপুলের বাই ইলেকশন। এই লিখায় হার্টলেপুল থেকে শুরু কোরে তারপর বাদবাকী বৃটেনের দিকে নজর দিতে চাই।
যৌন হয়রানির অভিযোগ আনার পর মার্চ মাসে লেবার এমপি মাইক হীল পদত্যাগ করায় হার্টলেপুলের আসনটি শূন্য হয়। ২০১৯ সালের নির্বাচনে মাইক হীল শতকরা ৩৮ ভাগ ভোট পেয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেখানে টোরী প্রতিদ্বন্দ্বী ২৯% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল আর তখনকার ব্রেক্সিট পার্টি পেয়েছিল ২৬%। অথচ মাত্র দুবছরের মাথায় এবারকার নির্বাচনে এ সংখ্যা উল্টে গিয়ে টোরী পার্টি পেয়েছে ৫২%, লেবারের ভোট গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৯%-এ, আর স্বতন্ত্র প্রার্থী সামান্থা লী পেয়েছ ১০% ভোট। এটাকে লেবারের ভরাডুবি হয়েছে শুধু এটুকু বলে শেষ করে দেওয়া যাবেনা, ভরাডুবির মাত্রাটাও আমাদের একটু দেখা প্রয়োজন।
এবার হার্টলেপুলে টোরী ২৩ পয়েন্ট মার্জিনে জিতেছে। পার্লামেন্টে যখন টোরীর সংখ্যা গরিষ্ঠতা তখন হার্টলেপুল টোরীর জন্যে একটি মাত্র আসনের বিজয় হলেও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রাজনীতিবিদরা যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে আরেকটি কারণে।
ইতিহাস আমাদের সাধারণভাবে বলে যে বাই ইলেকশনে সরকারী দলের প্রার্থী সাধারণত এতটা ভাল করে না। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে বাই ইলেকশনে সরকারী দলের পক্ষে ভোট সুইং এতটা হয় না। গত ৭৬ বছরের ইংল্যান্ডের নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করলে আমরা দেখব বাই ইলেকশনে সরকারী প্রার্থীর পক্ষে সর্ববৃহৎ ভোট সুইং হয়েছিল ১৯৪৫ সালে বোর্নমাথে এবং সেটি ছিল ১২%। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে বাই ইলেকশনে সরকারী দলের পক্ষে এবারকার ভোট সুইং ১৯৪৫ সালের সুইং এর প্রায় দ্বিগুণ! তাহলে লেবারের এমন ধ্বস হল কেন?
যেহেতু হার্টলেপুলের এমপিকে যৌন হয়রানির অভিযোগে পদত্যাগ করতে হয়েছিল তাই সঙ্গত কারণেই এ বিষয়টিতে স্থানীয় লেবার পার্টি একটু অস্বস্তিকর অবস্থাতে পড়ে গিয়েছিল। তাছাড়া পল উইলিয়ামস যে লেবারের পক্ষে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী ছিলেন এমনটিও বলা হয় না। লেবার পার্টি এমন একজন প্রার্থী দিয়েছে যিনি পার্শ্ববর্তী এলাকা স্টকটন সাউথ থেকে ২০১৭ সালে এমপি নির্বাচিত হলেও রিমেইনার হিসেবে সেকেন্ড রেফারেন্ডমের পক্ষে প্রচারনা চালিয়ে ২০১৯ সালে তার আসন খুইয়েছিলেন। ২০১৬ তে যেখানে হার্টলেপুলের ৭০% লোক ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছিল সেখানে দু’বছর আগে পার্শ্ববর্তী এলাকাতে হেরে যাওয়া একজন রিমেইনারকে প্রার্থী নির্বাচিত করে লেবার পার্টি প্রমাণ করেছে যে লেবার দলে (অন্তত ঐ তল্লাটে) উপযুক্ত প্রার্থী নেই অথবা ঐ উপযুক্ত প্রার্থীকে জায়গা দেওয়া হচ্ছে না।
এর উপর লেবার প্রার্থী পল উইলিয়ামসের সামাজিক মাধ্যমের ঘটনাবলীও কিছু লোকের হাসি বা বিরক্তির কারণ ছিল। এছাড়া হার্টলেপুলের ভরাডুবির আরো একটি ছোট কারণ হল ঐ একই দিনে ছিল টীস ভ্যালির মেয়রাল ইলেকশন। টীস ভ্যালির বর্তমান মেয়র টোরীর বেন হাচিন ঐ এলাকায় খুবই জনপ্রিয়। এমনও হতে পারে যে বেন হাচিনকে ভোট দেওয়ার জন্যে অনেক টোরী সমর্থক ভোট দিতে এসেছিল সুতরাং তাদের ভোটটিগুলো মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হয়েছিল হার্টলেপুলের টোরী প্রার্থী জিল মর্টিমারের পক্ষেও।
এগুলো হচ্ছে হার্টলেপুলের চিত্রের বিশ্লেষণ। হার্টলেপুলের সাধারণ নির্বাচন থেকে ধীরে ধীরে দৃষ্টির বৃত্তটা বাড়ালে আমরা কি দেখতে পাই? হার্টলেপুলের সাথে কি বাদবাকী ইল্যান্ডের কোনো মিল বা অমিল রয়েছে?
আমি আবারও বলি যে, সাধারণত একটি বাই ইলেকশনের ফলাফল দিয়ে আমরা পুরো দেশের পরিস্থিতি বুঝি না বা একটি বাই ইলেকশনের ফলাফল এতটা তাৎপর্যপূর্ণ নয় এমনটি আমাদের মনে হতেই পারে কিন্তু সরকারী দলের প্রার্থী হিসেবে টোরীর ২৩% পয়েন্ট লিড নেওয়া এবং একই সঙ্গে বহু সংখ্যক লোকাল কাউন্সিলের আসন লেবার দলের হাত থেকে খসে পড়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ । কাজেই আর দশটা বাই ইলেকশনের চাইতে এই ফলাফল ভিন্ন গুরুত্বের দাবী রাখে।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকে দেখা গেছে সর্বত্র টোরীর এই জয় জয়াকারের মূল কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন ভ্যাকসিন রোল আউটকে। সেই সঙ্গে একথাও বলা হচ্ছে যে ব্র্যাক্সিটের কারণেই বৃটেনে ভ্যাকসিন রোল আউট সম্ভব হয়েছে। খোদ হেলথ সেক্রেটারি ম্যাট হেনকক ফাইজার-বায়োনটেককে বিশ্বে প্রথম অনুমোদন দেওয়ার দিন ব্র্যাক্সিটের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে এবং ব্র্যাক্সিটের কারণে বৃটেনে ভ্যাকসিন রোল আউট শুরু হচ্ছে – এসব বলে এম এইচ আর এ-র কাছে ধরা খেয়েছিলেন।
মূল তথ্যটি হচ্ছে, এম এইচ আর এ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা ইউ আইনের মধ্যে থেকেই নেওয়া সম্ভব হয়েছে। কারণ ইউ-র আইনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যদি কোনো সংক্রমণ ব্যাধি প্রকটভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে সদস্য দেশগুলো যে কোনো মেডিকেল প্রোডাক্টকে অস্থায়ী অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
ভ্যাকসিনের ব্যাপারে বৃটেন যা যা করেছে ইউ-র যে কোনো দেশ চাইলে তা করতে পারত, এতে কোনো আইনগত বাধা ছিল না বা নেই। ইউ-র সদস্য দেশগুলো যে বৃটেনের মত বলিষ্ঠ ভূমিকা নেয় নি তার কারণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত – আইনগত নয় মোটেও। এমন কি ইউ-র জয়েন্ট ভ্যাকসিন প্রোকিওরমেন্ট স্কীমে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে কোনো সদস্য দেশের প্রতি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ইউ দেশগুলো স্বেচ্ছায় এই স্কীমে এক সাথে থেকেছে। যদি ইউভুক্ত একটি দেশ বা একাধিক দেশ বৃটেন যেভাবে ভ্যাকসিন যোগাড় করেছে সেভাবে নিজেদের ভ্যাকসিন যোগাড় করতো তাহলে কোনো আইনী ক্ষমতায় সে দেশকে থামানো যেতো না। মোদ্দা কথা হচ্ছে, পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্যের উপর ইইউ ট্রিটির বাধ্যবাধকতা খুবই নগণ্য।
এটি সত্যি যে ভ্যাকসিন বাউন্স ও করোনায় অর্থনৈতিক প্রনোদোনা – ভোটের ব্যাপারে টোরীর পক্ষে গিয়েছে, এমন কি ভ্যাকসিন সফলতা জনগণের মন থেকে সরকারের করোনা মোকাবেলায় প্রথম দিকের ব্যর্থতাকেও ভুলিয়ে দিয়েছে। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ‘All’s well that ends well.’
তবে ভ্যাকসিন বাউন্সের বাইরেও যে কথাটি বলতেই হয় তা হচ্ছে, টোরী খুব সফলভাবে ব্রেক্সিট পার্টীর ভোটগুলো মোনোপলাইজ করতে সক্ষম হয়েছে। খুব সহজ অঙ্ক কোরে যদি আমরা দেখি, ২০১৯ সালের টোরী এবং ব্রেক্সিট পার্টির ভোট যোগ করলে হয় ৫৫% যা প্রায় এ বছরে টোরীর ভোট সংখ্যা। তবে এটাও ঠিক যে আমরা একেবারে সঠিক কোরে জানিনা যে টোরীর নতুন ভোটগুলোর সবই সরাসরি ব্রেক্সিট পার্টি থেকে আসা কিনা। তবে আন্দাজ করা যায় যে ব্রেক্সিট ভোটারদের একটি বিরাট অংশ চলে গেছে টৌরী পার্টির কাছে।
গত সপ্তাহের সার্ভেশন পোলে দেখা গেছে হার্টলেপুলের শতকরা ৭৭ ভাগ ব্রেক্সিট ভোটার চলে গেছে টোরীর কাছে আর শতকরা ৫ ভাগ গিয়েছে লেবারের কাছে। জাতীয় ভাবে যদি এই হয় অবস্থা তাহলে আগামী সাধারণ নির্বাচনে লেবারের ম্যনুভারিং প্সেস খুব একটা থাকবেনা। লেবারের জন্যে তার চাইতেও বড় যে অশনি সংকেত আমি দেখতে পাচ্ছি তা হচ্ছে, আগামী সাধারণ নির্বাচনে এই ‘প্রাক্তন ব্রেক্সিট ভোটাররা’ লেবারের কয়েকজন হেভিওয়েট এমপিদের রাজনীতির রিং থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে খুব সহজেই । এতে যদি এড মিলিব্যান্ড, ইভেট কুপার ও জন হিলিও ছিটকে পড়েন তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা।
শুধু তাই নয় বহু লোকাল কাউন্সিলে লেবারের ভোট নিয়ে গিয়েছে লিবডেম । উদাহরণস্বরূপ স্যান্ডারল্যান্ডের হেনডনে শতকরা ৩০ ভাগ ভোট সুইং হয়েছে লেবার থেকে লিবডেমে। অবশ্যই কাউন্সিলের ইলেকশন এমন কোনো বড় ব্যাপার নয় কারণ এটি মাত্র কয়েক হাজার লোকের ভোটের ব্যাপার। – এটুকু বলে কি সব কিছু শেষ করে দেওয়া যায়? অন্তত এটুকু বলা যায় কার ষ্টারমারের এবার ব্রেক্সিট ভোটারদের কাছে ভোট ভিক্ষা কোনোই কাজে আসে নি। সেই সাথে লেবারের ছোট ছোট দল (লিবডেম ছাড়া) যেমন গ্রীণ পার্টির কাছে হেরে যাওয়া লেবার দলের ও নেতার সমস্যার দিকটাই আবারও প্রকাশ করেছে।
আর এর সব কিছুই বরিস জনসনের রাজনীতির স্ফীত মূলধনকে আরও স্ফীত করবে – বলা যায় এগুলো হবে বরিস জনসনের জন্যে ডাইরেক্ট ডিভিডেন্ট আর ইনডাইরেক্ট ডিভিডেন্টের সমষ্টি। ফলশ্রুতিতে টোরীর ব্যাক ব্যান্চার এমপি যারা বরিস জনসনের লক ডাউন সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ও ফ্ল্যাট রেনোভেশন নিয়ে মাঝে মধ্যে সুর তুলতেন তারাও এখন মোটামুটিভাবে তাদের গলার আওয়াজ একটু সুমিষ্ট কোরে রাখবেন। শত হলেও বরিস জনসনকে দিয়ে যদি ভোটে বিজয় আনা যায় তবে তো তাদের চাকরি সুরক্ষিত!
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী। মা ও শিশু বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র কমিউনিটি এক্টিভিস্ট।
Advertisement