:: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী ::
মানুষ সামাজিক জীব এবং প্রতিটি মানুষই চায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে আর সেক্ষেত্রে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠার এক উৎকৃষ্ট পন্থা হলো দান। মানুষ দান করে আর সেই সাথে চায় তার নিজের প্রচার। মৌলানা থেকে মাস্টার কিংবা কৃষক থেকে মন্ত্রী কেউই কিন্তু প্রচার বিমুখ নয়। বেশিরভাগ মানুষই চায় তার একটা ব্যক্তিগত প্রচার। আর এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় মানুষ সমাজে দান করে তার নিজেকে প্রচার করার জন্য। খুব কম সংখ্যক মানুষ আছে যারা তা চায়না। আর এই প্রচার নিয়ে রয়েছে নানা কথা বার্তা। ইদানিং ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখি – “যিনি গোপনে দান করেন তিনি দাতা আর যিনি প্রকাশ্যে দান করেন তিনি বিজ্ঞাপন দাতা“। কথাটি আসলে ভেবে দেখার মতো একটি বিষয়।
বিজ্ঞাপন হলো মানুষকে আকৃষ্ট করে পণ্য বিক্রি করা। যে ব্যাক্তি তার কষ্টার্জিত টাকা দান করে সমাজের উপকার করে, মানুষ ও উপকৃত হয়। সেই প্রচার বিজ্ঞাপন হয় কিভাবে? তাহলে প্রশ্ন হলো কথাটি তৈরী হলো কেমন করে? আমি ব্যক্তিগতভাবে কথাটির সাথে সম্পূর্ণ একমত হতে পারিনি।আমার মনে হয়েছে কথাটি তৈরী হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রথমত নেতিবাচক প্রচরণা, যেমন দরুন আমরা সবাই যাকাত প্রদান করি। এটা আমাদের ঈমানী দ্বায়িত্ব বোধ থেকে করি। কিন্ত যিনি নিলেন, সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরবর্তীতে দেখা যায় অনেক সময় তাকে কিংবা তার পরিবারকে অপবাদের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়। এক্ষেত্রে গ্রহীতার পরিচিতি প্রকাশ কখনোই কাম্য নয়। গ্রহীতার পরিচিতি প্রকাশ না করে কেউ যদি যাকাত প্রদান করে এবং তা প্রচার করে, এতে আমি দোষের কিছু দেখিনা। সুতরাং আমাদের সামাজিক এই নেতিবাচক প্রচারণা থেকে সরে আসতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ব্যাক্তিগত ভাবে নিজের টাকা অনেকে সমাজে দান করেন এবং তা প্রচার করেন এতে আমি দোষের কিছু দেখিনা। তবে দানের খবর নিয়ে অনেক সময় অতিরঞ্জিত করা হয়। যেমন যিনি দান নিচ্ছেন তার ছবি প্রকাশ করা। যা মোটেই সঠিক নয়। কারণ সোশ্যালমিডিয়ার যুগে এই ছবিগুলো একসময় ইতিহাস হয়ে যাবে এবং পরবর্তীতে গ্রহীতার কিংবা তার পরিবারের জন্য সেটা কাল হয়ে যাবে।সুতরাং দানের কথা প্রচার করতে আপত্তি নাই তবে দান গ্রহীতার ছবি কিংবা পরিচিতি প্রচারের আমি বিপক্ষে।
তৃতীয়ত, অনেক জনপ্রতিনিধি সরকারি কোষাগারের টাকা জনগণের মাঝে বিলি করে ছবি দেন। সেক্ষেত্রে আমার আপত্তি আছে। জনগণের টাকা জনগণের কাছে বিলি করা উনার নৈতিক দ্বায়িত্ব। আর এটা উনার দৈনন্দিন কাজেরও একটি অংশ। এখানে ছবি প্রকাশ করে বাহাবা নেয়ার কিছু নেই। ঐ সমস্ত দান সমাজে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ঐ ক্ষেত্রেও দাতা এবং গ্রহীতা কারো ছবি প্রকাশ মোটেই কাম্য নয়। এসকল প্রচারণা পুরোপুরি বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে পড়ে।
উপরের তিনটি বিষয় ছাড়াও আরো একটি বিষয় রয়েছে যা দানের বা দাতার খবর প্রচার না করতে উৎসাহিত করে তা হলো – হিংসা। সমাজে অনেক মানুষ আছে তার টাকা আছে কিন্ত দান করবেনা। আবার অন্যকে দান করতে দেখলে তার গা জ্বলে। অন্যের প্রচার সে সহ্য করতে পারেনা। এই মানুষগুলোও দাতাদের বিজ্ঞাপন দাতা বানানোতে প্রচারণা করে।
সুতরাং সকল দাতাকে বিজ্ঞাপনদাতা বলা সঠিক নয়। এতে সঠিক দাতারা নিরুৎসাহিত হবে এবং সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দান প্রচারের রকমই বলে দেবে কোনজন দাতা আর কোনজন বিজ্ঞাপনদাতা। আমাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে, “যে সমাজে জ্ঞানীর কদর নেই, সেই সমাজে জ্ঞানী তৈরী হয়না“। ঠিক তদ্রুপ “যে সমাজে দাতারসম্মান থাকে না, সেই সমাজে দাতা তৈরীও হয়না“। অর্থাৎ যে সমাজে দান করবে তাকে সম্মান দেখানো উচিত। পাশাপাশি দাতাদের প্রতি ও অনুরোধ দানের খবর প্রচার করুন এবং দান গ্রহীতার খবর কিংবা পরিচিতি প্রচার থেকে বিরত থাকুন।
লেখক:
ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
কন্ট্রিবিউটর, ব্রিট বাংলা২৪ এবং প্রিন্সিপাল সলিসিটার, কেসি সলিসিটর্স, লন্ডন।