সময় এখন কাজের

শওকত হোসেন :: টানা তিন মেয়াদ। দল একই, মন্ত্রিসভায় একঝাঁক নতুন মুখ। দলের ইশতেহারে অসংখ্য অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। মূলত সুশাসনেরই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এমনিতে টানা তিন মেয়াদে একই দলের সরকার দেখার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের নেই। আবার পরপর দুটি নির্বাচনের মান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। বিশেষ করে গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনামুখর পশ্চিমা গণমাধ্যম। সমালোচনা আছে দেশের ভেতরেও। মনে করা হচ্ছে, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের সমালোচনার বিপরীতেই আওয়ামী লীগ সরকার সুশাসনের প্রশ্নটি জোরেশোরে সামনে নিয়ে এসেছে।

যথেষ্ট পরিমাণ উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও দৃশ্যমান উন্নয়ন হলেও গত ১০ বছরে সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন ছিল বিভিন্ন সময়ে। দুর্নীতি, বিচারহীনতা, জবাবদিহির অভাব, সম্পদের অপচয়, ব্যয় বৃদ্ধি, অর্থ পাচার, মতপ্রকাশে বাধা—এ নিয়ে সোচ্চার ছিল দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। নতুন সরকারের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুশাসনের এসব ঘাটতি দূর করা। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিশ্রুতি পূরণের কর্মপদ্ধতি কী হবে?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ধার করে বলা যায়, ‘পুরাতন দলই হউন আর নূতন দলই হউন…প্রমাণ করুন যে, দেশের ভার তাঁহারা লইতে পারেন। তাঁহাদের মত কী সে তো বারংবার শুনিয়াছি, তাঁহাদের কাজ কী কেবল সেইটেই দেখা হইল না।’ সুতরাং আগামী পাঁচ বছরের জন্য এই সরকারের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কাজ দেখানো।

এ নিয়ে কথা হচ্ছিল সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এটা কাটাতে নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নকেই নতুন সরকারের বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এ জন্য এখনই একটি কর্মপরিকল্পনা করা দরকার। তা ছাড়া দুর্নীতি দমনের পাশাপাশি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন দিয়ে এটা কতটা সম্ভব, তা বিবেচনায় আনতে হবে।

প্রশাসন নিয়ে কেন প্রশ্ন

একাদশ জাতীয় সংসদ বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা। নির্বাচনে ফলাফলকে অবিশ্বাস্য বলছে অনেকেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এই নির্বাচনকে বলেছে ‘প্রহসনের নির্বাচন’। বিবিসি বলেছে, একটি অভিনব বিষয় হলো ভোটে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা সবাই জানি, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এই রাষ্ট্রযন্ত্রের সব পক্ষের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

গত ১০ বছরে সরকারি খাতের বেতনকাঠামোতে দুবার বড় ধরনের বৃদ্ধির পাশাপাশি আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে দুর্নীতি কমেছে, তা বলছে না কেউ। প্রধানমন্ত্রীও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এত বেতন বাড়িয়েছি, তাহলে দুর্নীতি কেন?’ আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করাই এই মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে যে মাত্রায় প্রশাসন, পুলিশ বাহিনীসহ অন্যদের ব্যবহার করা হয়েছে, এরপরও কি তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে? এ নিয়ে কথা হয়েছে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে। একজন সুপরিচিত সাবেক আমলা স্পষ্ট করেই বলেন, এই নির্বাচনের পর তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। বরং আরও সুযোগ-সুবিধার চাপ আসতে পারে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি মনে করেন, স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় সদস্যদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে পারে।
কারণ, নির্বাচনের পর তাঁদের অনেকের কাছেই মনে হবে, এই প্রশাসনের সবাই তো তাঁদের পক্ষের। এই অবস্থায় প্রশাসনের সবাইকে নিজ নিজ মূল
কাজে ফিরিয়ে আনাটাই হবে এই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

অর্থনীতির স্বস্তি-অস্বস্তি

উন্নয়নের স্লোগান ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান অস্ত্র। নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা থাকলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো উন্নয়নকে অস্বীকার করেনি। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, সামাজিক সূচকেও এগোচ্ছে দেশ। সূচকের মাপকাঠিতে অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ। তবে সূচকে ধরা পড়ে না, এমন অনেক বিষয়ও আছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। যেমন বৈষম্য বৃদ্ধি।

তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা ও ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমানো। নির্বাচনের আগে সব ধরনের ব্যবসায়ীদের প্রকাশ্য সমর্থন পেয়েছে এই সরকার। নীতির ধারাবাহিকতা যেমন তাঁদের আকাঙ্ক্ষা, কিন্তু বড় দাবি সহজে ব্যবসা করার নিশ্চয়তা। তবে এর চেয়ে কঠিন কাজ ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম অবশ্য মনে করেন, অর্থনীতিতে নতুন সরকারের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো বেসরকারি বিনিয়োগ আনা। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচনের আগে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি অর্জনে জিডিপির ৪১ শতাংশের সমান বিনিয়োগ লাগবে। কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ কয়েক বছর ধরেই স্থবির হয়ে আছে। বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটাতে অবকাঠামো, জমি ও জ্বালানিসংকট দূর করতে হবে।

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম অবশ্য হতাশা নিয়েই বলেন, বেশ কিছু খাতে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। যেমন সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ব্যবসা পরিচালনা সহজ করা এবং ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য। এমনকি ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলা দূর করার কোনো উদ্যোগও দেখা যায়নি। চ্যালেঞ্জ এখানেও।

অঙ্গীকারের লম্বা তালিকা

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের নাম ছিল সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ। এই ইশতেহারে ২২টা বিশেষ অঙ্গীকারের কথা বলা আছে। যেমন প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ; তরুণ-যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর; কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা; দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স; নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গসমতা ও শিশুকল্যাণ; পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা; সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূল; মেগা প্রকল্পের দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন; গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করা; দারিদ্র্য নির্মূল; শিক্ষার মান বৃদ্ধি; বিনিয়োগ বৃদ্ধি; মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা; ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার; বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা; আধুনিক কৃষিব্যবস্থার জন্য যান্ত্রিকীকরণ; দক্ষ ও সেবামুখী জনপ্রশাসন; জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা; সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন এবং নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা।

এবার দেখা যাক কেমন ছিল বছরের শুরুটা। প্রথম দিনেই মালিবাগে বাসের চাকায় প্রাণ যায় দুই পোশাকশ্রমিকের, চালকের লাইসেন্স ছিল না। মজুরি বাড়ানোর দাবিতে সাত দিন রাস্তায় ছিলেন পোশাকশ্রমিকেরা, এখন তাঁরা মামলা আর ছাঁটাই-আতঙ্কে। ঘটছে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা। হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ইশতেহারের অঙ্গীকারগুলো যেমন পুরোনো, তেমনি নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তার সবই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনিয়ম-অবস্থার ফল। এই অবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার না হলে সামগ্রিক সুশাসন আনা যাবে না। কারণ, বিদ্যমান কাঠামোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জায়গা খুবই সংকুচিত।

একটা ইচ্ছা-তালিকা করা যাক

কথা হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বললেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ বললেই হবে না, কাজ করে দেখাতে হবে। আর এ জন্য ছোট দুর্নীতিবাজদের ধরার পাশাপাশি উদাহরণ সৃষ্টি করার মতো এমন কাউকেও ধরতে হবে।

ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যাংকমালিকদের কথায় নয়, ব্যাংক চলবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কথায়, বড় বড় ঋণখেলাপিকে দিতে হবে শাস্তি। একজন তরুণ ব্যাংকার বলেন তাঁর এই প্রত্যাশার কথা। এ ছাড়া সরকারি ব্যাংক তদারকিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগ রাখার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন বহুদিনের।

অঙ্গীকার শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা, অথচ বরাদ্দ প্রতিবেশী সব দেশের চেয়ে কম। শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ ব্যয় করে জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে কম ব্যয় করে শুধু কম্বোডিয়া। আর স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপির শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ, যা ৫ বছর আগেও ছিল ১ দশমিক ১ শতাংশ। সুতরাং বরাদ্দ যদি দ্বিগুণ বাড়ে, কেবল তাহলেই বলা যাবে সরকারের সদিচ্ছা আছে।

প্রথম আলোর তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১৯৫ জন। যানজট এখনো প্রতিদিনকার সমস্যা। গণপরিবহন বিশৃঙ্খল। অথচ নিরাপদ সড়কের দাবিতে গত বছরই সাধারণ শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন এক আন্দোলন দেখেছে দেশ। এরপর অনেক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বদল হয়নি কিছুই। এমনকি সেতুমন্ত্রীর কথাবার্তাও। আইনের প্রয়োগ, সাধারণ মানুষের জন্য গণপরিবহনের ব্যবস্থা, জনসচেতনতা—এসবের জন্য পুরো কাঠামোর বড় ধরনের পরিবর্তন আনাটা খুব জরুরি।

কিছুদিন হঠাৎ করে জয় গোস্বামীর ‘আমাদের সমস্ত কথায়’ কবিতাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কেউ একজন তুলে দিলেন। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল কবিতাটি। সেই কবিতার শেষ কটি লাইন হচ্ছে, ‘হে সুভদ্র নাগরিকগণ, জেনে নিন/ এ গণতান্ত্রিক দেশে আজ/ আমাদের সমস্ত কথায়/ হ্যাঁ বলাই আপনাদের একমাত্র কাজ’।

পুরোনো এই কবিতা হঠাৎ ফেসবুকে এত জনপ্রিয় হওয়ার কারণ কী? গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের ব্যাখ্যা এ রকম—কবিতাটিতে বাক্‌স্বাধীনতার অভাবের দিকটিই তুলে ধরা হয়েছে ব্যঙ্গাত্মকভাবে। আমাদের দেশেও এ রকম একটি পরিস্থিতি অনুভূত হচ্ছে। দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা ভারতীয় কবির কবিতা খুঁজে বের করে ভাইরাল করে ফেলেছেন। কারণ, কবিতাটি ব্যবহারকারী তথা সাধারণ জনতার স্বাধীনভাবে চিন্তা প্রকাশ করতে না পারার কারণে সৃষ্ট মনের বিষাদ ও ব্যাকুলতাকে ধারণ করছে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে অভিযোগ অনেক দিনের। বরং দিনে দিনে তা আরও সংকুচিত হচ্ছে। করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নতুন নতুন বিধিনিষেধ। ‘বিপুল’ ভোটে জয়ের পর ‘ভোটের মর্যাদা’ রক্ষার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই অবস্থায় ভোটারদের কথা বলার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়াটাও সরকারের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।

সব মিলিয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি অনেক। তবে কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, এখন সময় হচ্ছে কাজ দেখানোর। আমরা তারই অপেক্ষায়।

Advertisement