সুসম্পর্ক আরো এগিয়ে নেওয়ার বার্তা ভারতের

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) মহামারির মধ্যে ঢাকা সফরে এসে সম্পর্ক আরো জোরদারের বার্তা দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভারতের পক্ষ থেকে তিনি এই বার্তা জানান।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের এই সফর অনানুষ্ঠানিক। মহামারির কারণে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান স্থগিত হওয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গত মার্চ মাসের সফরও স্থগিত হয়েছে। এর পরও দুই দেশে শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ ও আগামী দিনগুলোতে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করতেই মোদি সরকার তার পররাষ্ট্রসচিবকে ঢাকায় পাঠিয়েছে।

ভারতীয় এক কূটনীতিক বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক খুব ভালো। কভিডের মধ্যেও তাঁরা যোগাযোগ রাখতে চান। কারণ প্রধানমন্ত্রী তো আসতে পারলেন না, মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান স্থগিত হলো। সে জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করার জন্য এটি তাঁদের প্রধানমন্ত্রীর একটি উদ্যোগ।

ভারতীয় ওই কূটনীতিক বলেন, ভারতের এই উদ্যোগের জোরালো প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মহামারির মধ্যে এই প্রথম তিনি কোনো বিদেশি প্রতিনিধিকে সাক্ষাৎ দিলেন।

মুজিববর্ষে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করবে ভারত : সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের উন্নয়ন অংশীদারি, কানেক্টিভিটি জোরদার, কভিড-পরবর্তী অর্থনীতি পুনর্জাগ্রতকরণ, কভিডের প্রভাব মোকাবেলায় সহযোগিতা, থেরাপিউটিক ও ভ্যাকসিনসহ কভিড মোকাবেলায় সহযোগিতা এবং যৌথভাবে মুজিববর্ষ উদ্যাপন নিয়ে কথা হয়েছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভারত একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করবে।

জানা গেছে, দুই দেশের জন্য সুবিধাজনক সময়ে দ্রুত পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নেতৃত্বে যৌথ পরামর্শক কমিশনের বৈঠক আয়োজনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই কমিশনের সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে। পরবর্তী বৈঠকে ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পর্যালোচনা, বিশেষ করে প্রকল্পগুলো খুব বিশদভাবে দেখতে চায়।

ভারতীয় এক কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশ সে দেশের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার। বিশ্বে বাংলাদেশকেই সবচেয়ে বেশি ঋণ সুবিধা দিয়েছে ভারত। সম্প্রতি বাংলাদেশকে রেলের ১০টি লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই খুশি হয়েছেন। এগুলো বাংলাদেশে রেলের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে কাজে আসবে।

‘ট্রাভেল বাবল’ : ভারতীয় কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, গতকাল ভারতের পক্ষ থেকে ব্যবসা, সরকারি কাজ ও চিকিৎসার প্রয়োজনে ভ্রমণের জন্য ‘ট্রাভেল বাবল’-এর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ‘ট্রাভেল বাবল’ মানে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যে ফ্লাইট পরিচালনা। এর সঙ্গে তৃতীয় কোনো দেশ সম্পৃক্ত নয়।

জানা গেছে, ভারত করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ফ্রান্স, জার্মানি, মালদ্বীপ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ‘ট্রাভেল বাবল’ চালু করেছে। এতে দুই দেশের অনেক মানুষের সুবিধা হবে। ভারত বর্তমানে সীমিত পরিসরে ও আকাশপথে যাতায়াতের জন্য বিজনেস ও মেডিক্যাল ভিসা দিচ্ছে। ‘ট্রাভেল বাবল’ চালু হলে অনেকে যাতায়াত করতে পারবে।

রোহিঙ্গা ইস্যু : জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিয়ে কথা বলেছেন। এই ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান হলো রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ, সুরক্ষিত ও টেকসই প্রত্যাবাসন।

ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার আলোকে সফর : কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার আলোকে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ঢাকা সফরে এসেছেন। কভিড মহামারির মধ্যেও দুই দেশের সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। পণ্যবাহী ট্রেনগুলো চলছে। প্রতি সপ্তাহেই দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন কোনো না কোনো অগ্রগতি হয়েছে। প্রথমে রেক, মিনি রেক, সাইডডোর কনটেইনার, ফুল ফ্লেজড কনটেইনার চলাচল করেছে। কভিড মহামারির মধ্যেও ট্রেনে করে পোশাকশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাপড় ও সুতা এসেছে ভারত থেকে। এগুলো নিয়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শ্রিংলা আলোচনা করেছেন।

ভারত তার ত্রিপুরা রাজ্যে গোমতী রুটে পণ্যবাহী যানের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু করতে চায়। ওই রুট দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য যাবে ত্রিপুরা। সেখানে বাংলাদেশি পণ্যের বড় চাহিদা আছে।

মুক্তিযুদ্ধ ও কূটনৈতিক সম্পর্কের বার্ষিকী উদ্যাপনে জোর : সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে আগামী বছর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন বিষয়ে। এ ছাড়া ভারত মুজিববর্ষের বেশ কিছু অনুষ্ঠান যৌথভাবে আয়োজন করতে চায়। গত কয়েক দিনে ভারতের পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

সম্পর্কে কোনো টানাপড়েন নেই : চীনকে ঘিরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েনের শঙ্কা নাকচ করেছেন ভারতীয় কূটনীতিকরা। তাঁরা বলেন, আগামী কয়েক বছরের জন্য বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের রূপরেখার অপেক্ষায় আছি।

করোনার টিকা নিয়ে আজ আলোচনা : কভিড মোকাবেলায় অক্সফোর্ডের সম্ভাব্য ভ্যাকসিন ও ভারতীয় ভ্যাকসিন নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসছে বাংলাদেশ। আজ বুধবার ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের বৈঠকে এই আলোচনা হবে। অক্সফোর্ডের সম্ভাব্য ভ্যাকসিন বাংলাদেশে ‘ট্রায়ালের’ (পরীক্ষা) সুযোগ আছে কি না, তাও দেখছে ঢাকা। এর আগে চীনের ভ্যাকসিন বাংলাদেশে ট্রায়ালের বিষয়ে কথা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠক বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গতকাল দুপুরে বলেন, ‘আমরা অফার করব, আমাদের এখানেও যদি ট্রায়ালের সুযোগ থাকে, অক্সফোর্ডেরটার কম্পানি যেটা কাজ করছে, তাদের সঙ্গে আমরা লন্ডন মারফত যোগাযোগ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘এখন ইন্ডিয়ান বিভিন্ন ভ্যাকসিন প্রডিউসার, তারা এটার এই মুহূর্তে ব্যাবসায়িক দিকটা দেখছে। সুতরাং আমাদের একটা প্রচেষ্টা আছে যে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যেসব ভ্যাকসিন ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে বা চালু হচ্ছে, সেগুলো পাওয়ার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করা।’

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরটিসহ অন্য টিকাগুলো বাংলাদেশ যাতে দ্রুত পেতে পারে, সে বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত রাখা হচ্ছে বলেও জানান পররাষ্ট্রসচিব। তিনি বলেন, ‘সেটা আমেরিকানদেরটা হোক, অক্সফোর্ডেরটাই হোক—তারা ইন্ডিয়ায় ট্রায়াল দিচ্ছে; এগুলোর সবগুলো কিভাবে এক্সেস আমরা পেতে পারি, দ্রুত, সে ব্যাপারে সবার সঙ্গে আমাদের আলাপ-আলোচনা চলছে। তো সেটার পার্ট হিসেবে তাদের সঙ্গে আমরা আলাপ করব।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আলাপ-আলোচনা করব, আমরা কিভাবে সবার সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারি। সুতরাং আমাদের যেটা সবচেয়ে সেফ (নিরাপদ) মনে হবে বা সবচেয়ে বেশি ইউজফুল (কার্যকর) মনে হবে, আমরা সেদিকেই যাব। সুতরাং সব অপশনই আমাদের জন্য থাকা উচিত।’

Advertisement