সেদিন যা ঘটেছিল হলি আর্টিজানে

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ২০১৬ সালের ১ জুলাই। রাত সাড়ে ৮টার দিকে ব্যবসায়ী আবুল হাসনাত রেজা করিম (হাসনাত করিম) মেয়ের জন্মদিন পালন করতে রাজধানীর হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় এসেছিলেন স্ত্রী শারমিনা পারভীন ও দুই সন্তানকে নিয়ে। তারা বসেছিলেন হলরুমের পেছনের অংশে।

তাহমিদ হাসিব খান, ফাইরুজ মালিহা ও তাহানা তাসমিয়া এসেছিলেন রাত ৮টা ১০ মিনিটে। লেকপাড় ঘেঁষা টালি ঘরটিতে বসেছিলেন তারা।

ভারতীয় নাগরিক সত্য প্রকাশ রাত সাড়ে ৮টায় পাস্তা অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন বন্ধু তন্ময়ের জন্য।

৯ জন ইতালীয় রেস্তোরাঁয় এসেছিলেন বিকাল সাড়ে ৫টা নাগাদ। তারা বসেছিলেন নিচতলার একেবারে সামনের টেবিলে।

ইতালীয়দের পরই রেস্তোরাঁয় ঢুকেছিলেন জাপানি নাগরিকেরা। তাদের বড় অংশই বনানীর জাইকা অফিসের কর্মকর্তা। ঢাকার ইশরাত আখন্দ বসেছিলেন তার শ্রীলঙ্কান বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে।

অন্য দিনের মতোই সবকিছু চলছিল স্বাভাবিক। হাসি-আনন্দে মুখর হোল আর্টিজানের সন্ধ্যাবেলা। সবার মধ্যে খুশির আমেজ। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেল রাত পৌনে ৯ টার দিকে।

ওই সময় পাঁচ তরুণকে রেস্তোরাঁয় ঢুকেন। তারা সদস্য দুটি দলে বিভক্ত হয়ে বসুন্ধরার বাসা থেকে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার উদ্দেশে রওনা হয় বিকাল ৫ টায়।

২০১৬ সালের ১ জুলাই বিকাল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার দিকে কাঁধে থাকা ব্যাগে অস্ত্র-গুলি, গ্রেনেড, চাকু নিয়ে বের হয়ে রাত ৮টা ৪২ মিনিটের দিকে সেখানে পৌঁছে।

প্রথমে নিবরাস ইসলাম ও মীর সামেহ মোবাশ্বের এবং একটু পর রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম বাঁধন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হলি আর্টিজানের মেইন গেটে যায়।

গেটের নিরাপত্তাকর্মী নূর ইসলাম তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে নিবরাস নিরাপত্তাকর্মীর ডান চোখের নিচে ঘুষি মেরে তারা হলি আর্টিজানের ভেতর ঢুকে যায়। ঢুকেই গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

৩০ মিনিটের মধ্যেই পাঁচ জঙ্গির কাছে থাকা অস্ত্র-গুলি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে দেশি-বিদেশিদের হত্যা করে। বিভিন্ন রুম, টয়লেট, চিলারঘর, হিমঘর ইত্যাদি স্থান থেকে বিদেশিদের বের করে এনে তারা এই হত্যাযজ্ঞ চালায়।

একপর্যায়ে তারা দেশি-বিদেশিদের গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের আদেশক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও র‌্যাব সহযোগী সম্মিলিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়।

সকাল ৭টার দিকে প্যারা কমান্ডো হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট রেকি করে। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা শুরু হয়।

প্যারা কমান্ডো সদস্যরা ক্রলিং করতে করতে সামনে দিকে এগোতে থাকে এবং গুলি ছুড়তে থাকে পদাতিক ডিভিশন ও স্লাইপার টিম। এ সময় জঙ্গিরাও গুলি ছুড়তে থাকে।

১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যে সব সন্ত্রাসী নির্মূল করে প্যারা কমান্ডো টার্গেট এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। পরে অপারেশনের অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে সকাল সাড়ে ৮টায় অভিযানের সমাপ্তি ঘটে।

হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি ২২ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা।

এদের মধ্যে নয়জন ইতালির নাগরিক, সাতজন জাপানের নাগরিক, একজন ভারতীয় নাগরিক, একজন বাংলাদেশ-আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক, দু’জন বাংলাদেশি নাগরিক ও দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন।

এছাড়া পরবর্তীকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের দু’জন স্টাফ মারা যান। নিহত ইতালির নয় নাগরিক হলেন- মার্কো টোনডাট, ভিনজেনজো ডি’অ্যালেস্ট্রো, সিমোনা মন্টি, মারিয়া রিবোলি, নাদিয়া বেনেভেট্ট, অ্যাডেলে পুগলিসি, ক্লদিও ক্যাপেলি, ক্রিশ্চিয়ান রসি ও ক্লদিয়া মারিয়া ডি’অ্যান্টোনা।

জাপানের সাত নাগরিক হলেন- হিডেকি হাশিমোটা, কোয়া ওগাসাওয়ারা, মাকোটো ওকামুরা, হেরোশি তানাকা, ইয়োকি সাকাই, নোবুহিরো কোরুসাকি ও রুই শিমোডাইরা।

ভারতীয় নাগরিক তারিশি জৈন, বাংলাদেশ-আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক অবিন্তা কবির, বাংলাদেশি দুই নাগরিক ইশরাত জাহান আখন্দ ও ফারাজ আইয়াজ হোসেন এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. রবিউল করিম ও পুলিশ পরিদর্শক সালাউদ্দিন আহম্মেদ খান ভয়াবহ ওই হামলায় নিহত হন। পরে হলি আর্টিজানের দু’জন স্টাফ সাইফুল চৌকিদার ও জাকির হোসেন শাওন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এছাড়া ওই হামলায় ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন।

হলি আর্টিজান বেকারিতে সেই জঙ্গি হামলা মামলায় ৭ জনের ফাঁসির রায় ঘোষণা করেছে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। একজনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।

Advertisement