ভোট গ্রহণের দিনের নিরাপত্তার প্রশ্নটি যে কত বড় হতে পারে, সেটা পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলের আরজি কবুল করে নতুন এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন আদালত কলকাতা হাইকোর্ট। যদি নির্বাচন বা রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টের কোনো রায় বা পর্যবেক্ষণ হয়, তাহলে তা তো কলকাতাকেন্দ্রিক আমাদের ঐতিহাসিক কুটুম্বতাই সর্বাগ্রে মনে করিয়ে দেবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সদর্প পদচারণ এখনো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়নি। এর আগের লেখায় আমরা মুখ্যমন্ত্রী মমতার ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা যুদ্ধে নির্বাচনে জেতা এবং অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের বৈধতার বিষয় নিয়ে লিখেছিলাম। এবার নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা।
নিরাপত্তার প্রশ্নটি বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচনে অনেক বড় জ্বলন্ত ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। অংশগ্রহণমূলক হলে এক রকম, না হলে অন্য রকম, কিন্তু হিংসাশ্রয়ী হওয়ার সব রকম আশঙ্কা থাকবে। উপরন্তু বিএনপি বা মুখ্য বিরোধী দল বা দলগুলোকে প্রচারণার সুযোগ ৪৫ দিন তো দিতেই হবে। এই ৪৫ দিনের প্রচারাভিযান তারা কতটা ভালোভাবে করতে পারে কিংবা কতটা অবাধে করতে দেওয়া হয়, সেটা একটা বড় বিবেচ্য। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন একটা চিন্তা করেছিল যে জনসভার অনুমতি চেয়ে চিঠি পাঠানোর তিন দিনের মধ্যে যদি কোনো উত্তর না আসে, তাহলে অনুমতি পাওয়া গেছে ধরে নিতে হবে। কিন্তু ধারণা করা হয়, সরকারি দলের অতিশয় শীতল মনোভাব টের পেয়ে ইসি এ বিষয়ে তেমন উচ্চবাচ্য না-ও করতে পারে।
কিন্তু খুলনার ‘শান্তিপূর্ণ কারচুপির মডেল’ বাস্তবায়ন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কত সদস্য লেগেছে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। খুলনায় সিটি নির্বাচন একটিমাত্র সংসদীয় আসনের সমান। সেখানে খুলনার পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র নির্বাচনের দিন প্রায় ১০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েনের কথা বলেছেন। প্রতি ৩০ জন ভোটারের জন্য একজন প্রহরী দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ৩০০ আসনের জন্য নিশ্চয়ই ৩০ লাখ নিরাপত্তাকর্মী মিলবে না। সুতরাং আমাদের এক দিনের আসন্ন গণতন্ত্র উৎসবের দিনটির নিরাপত্তার বিষয় কী হবে, সে বিষয়ে ইসির রোডম্যাপটা প্রকাশ পাওয়ার দাবি রাখে। ধরে নিতে হবে, ইসি একান্ত অপরিহার্য বলেই খুলনায় ১০ হাজার জনশক্তি ব্যবহার করেছে। একটি সংসদীয় আসনে ১০ হাজার লাগলে ৩০০ আসনে কেন একই মানদণ্ডে বিপুলসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মীর দরকার পড়বে না, তা অংশীজনদের কাছে তাকে এখনই স্পষ্ট করতে হবে।
কলকাতা হাইকোর্ট সম্প্রতি অল্প সময়ের ব্যবধানে এত বেশিবার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ বা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যা আগে দেখা যায়নি। হাইকোর্টের বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার ও বিচারপতি অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের দ্বৈত বেঞ্চ প্রদেশ কংগ্রেসের দায়ের করা মামলায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁকে কার্যত ‘তুলাধোনা’ করেছেন বলে আনন্দবাজার পত্রিকায় রিপোর্ট পড়লাম। উচ্চ আদালত ইসির ব্যর্থতা বিষয়ে কী ভাষায় কতটা মন্তব্য করতে পারেন, সে বিষয়ে আমরা একটা পাঠ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। সত্যিই তো, হাইকোর্টের পক্ষে কোনো পর্যবেক্ষণ কখন রাজনৈতিক, কখন নৈতিক, কখন আইনি বা কখন এর সব কটির মিশেলে হতে পারে, তা কম গোলমেলে ব্যাপার নয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের ইসিকে আদালতের তিরস্কার করার একটা মডেল আমরা অগ্রাহ্য করতে পারব না।
এটাও লক্ষণীয়, আদালতের তিরস্কার বিরোধী দল যাতে তাদের সংকীর্ণ নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার না করতে পারে, সে জন্য সতর্কবার্তা জুড়ে দিয়েছে যে, তারা তাদের পর্যবেক্ষণ নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করতে পারবে না। বাংলাদেশে ইসির বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করার বিষয়টিতে একটা দয়াদাক্ষিণ্যের ছাপ পড়ে। কিন্তু কলকাতার হাইকোর্টে এমন বিষয় নিয়েও যে দরখাস্ত পড়তে পারে, তা ভাবতেও মন কেমন করছে। বিচারপতি সুব্রত তালুকদারের একক বেঞ্চে প্রথমে একটি মামলা করেছে বাম দল। একই ইস্যুতে এই বেঞ্চে আরেকটি মামলা করেছে পিডিএস। দুই দলেরই অভিযোগ, হাইকোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন বিরোধী দলের সঙ্গে বৈঠক না করেই একতরফাভাবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। বিশেষ করে রাজ্যের ভোটারদের নিরাপত্তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনার বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। বিচারপতি তালুকদার ইসিকে নির্দেশ দিয়েছেন, ভোট নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে হবে। কমিশনকে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, বিরোধীদের অভিযোগ শুনে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। আমরা মমতাকে কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরতান্ত্রিক বলছি বটে, কিন্তু আদালত তাঁর এই অ্যাক্টিভিজমের জন্য এখনো টার্গেট হননি।
আমরা এটা শুনতে অভ্যস্ত, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন কখন কীভাবে হবে, তা সরকারের বিষয়, ইসি শুধু খেলাটা খেলানোর ব্যবস্থা করে। এখানেও আদালতের কথা থাকতে পারে। হাইকোর্ট বলেন, ভোট প্রক্রিয়ায় রাজ্যের হস্তক্ষেপ বৈধ হলেও যে কারণ দেখানো হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনো সময় নতুন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করার ক্ষমতা ইসি রাখে।
বোঝাই যাচ্ছে, মমতার সরকার যখন বিরোধী দলের ‘গণতন্ত্র বিধ্বংসী’ কর্মকাণ্ডে একেবারে ত্যক্তবিরক্ত এবং দেশ ও দশের কল্যাণে বিরোধী দলকে আশকারা না দেওয়ার নীতিতে পণ করেছে, আর ইসিও তাতে পাল তুলেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে, তখনই আমরা দেখছি যে আদালত সংক্ষুব্ধ বিরোধী দলের একটা ভরসার স্থল হয়ে উঠেছেন। ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এটাই হয়তো অন্তর্নিহিত শক্তি। একটি দুটি অঙ্গ ভারসাম্যহীন আচরণ করলে অন্য অঙ্গ এসে প্রতিসাম্য তৈরি করে। এমনকি খাস সরকারি কর্মচারীরাও যে রিট করতে পারেন, তারও নজির তৈরি হলো এবার। ভোটের কাজে নিয়োজিত সরকারি কর্মীদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি কী? তাই ভোটকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার দাবি তুলে হাইকোর্টে গেছে সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন ‘রাজ্য সরকারি কর্মচারী পরিষদ’। আমরা কি এমন একটি রিট বাংলাদেশে কল্পনাও করতে পারি? পশ্চিমবঙ্গ কি ইউরোপ হয়ে গেছে? ওপারের বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতি এতটাই উন্নত হয়ে গেল? সংবেদনশীলতা বা বাধার জায়গাটি তাহলে কোথায়? জনতায়, নেতায়, নাকি ব্যবস্থায়? একটি উত্তর হয়তো এ রকম: বিচারক নিয়োগে মেধা, সততা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার সুফল পাচ্ছে ওপার বাংলা।
বিরোধী দল ইসিকে যখন ক্ষমতাসীন দলের তাঁবেদার আখ্যা দিচ্ছে, তখন কলকাতা হাইকোর্টের তীব্র ভর্ৎসনামূলক দুটি পর্যবেক্ষণ প্রণিধানযোগ্য। প্রথমটি হলো, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কমিশন তার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। পঞ্চায়েত ভোটের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে নির্বাচন কমিশন বারবার এমন সব কাজ করেছে, যাতে তার দিকে অভিযোগের আঙুল উঠতে বাধ্য। স্বচ্ছতার সঙ্গে নিজের কাজ করতে গিয়ে নাকানিচুবানি খেয়েছে কমিশন। তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।’ দ্বিতীয়টি এ রকম: ‘নির্বাচন প্রক্রিয়া চালু হয়ে গেলে আদালত তাতে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে চান। তবে কমিশন যা খুশি তা-ই করবে এবং তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না, ব্যাপারটি এমনও নয়। তাহলে বিচারব্যবস্থাই হাসির খোরাক হয়ে উঠবে। উপযুক্ত ক্ষেত্রে আদালত সর্বদাই হস্তক্ষেপ করতে পারেন।’
এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে তুলনা করা চলে আমাদের নির্বাচন কমিশনগুলো আদালতের তরফে সবশেষ এ রকম চাঁছাছোলা মন্তব্য কবে হজম করেছিল, তা স্মরণ করতে পারি না। অবশ্য ইসির তরফে একটা যুক্তি এ রকম যে এমন কোনো নির্বাচনের কথা তারা তো স্মরণেই আনতে পারে না, যেখানে মনোনয়নপত্র দাখিলে বিজ্ঞপ্তি জারির পর তারা কস্মিনকালে এমন কিছু করেছে, যাতে তাদের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠতে পারে!
মূল প্রসঙ্গ হলো, নিরাপত্তা পরিস্থিতি, বুথের চরিত্র (ভালনারেবিলিটি রিপোর্ট) কী হবে, সে বিষয়ে ইসিকে হাইকোর্টকে সন্তুষ্ট করতে হয়েছে। বিরোধী দলের সঙ্গে ‘অর্থবহ আলোচনার’ পর গৃহীত ব্যবস্থা নিয়েও ইসিকে হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে রিপোর্ট পেশ করতে হয়েছে। কালক্ষেপণ করা, ক্ষমতাসীনদের জন্য বিব্রতকর হতে পারে, এমন বিষয়ে শুনানি ফেলে রাখার মতো ঘটনা কলকাতায় নেই। আমরা এই উদারনৈতিক জুডিশিয়াল অ্যাক্টিভিজমের বিশেষ প্রেক্ষাপট মনে রাখব, যার সার কথা হলো, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতাসীন দলটি ক্রমশ স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠছে। সে কারণে কলকাতার স্বাধীন গণমাধ্যমগুলো তাঁর সমালোচনায় মুখর হতে দেখা যাচ্ছে। আর তার বিপরীতে মমতার তৃণমূল নেতারা যেকোনো মূল্যে নির্বাচন জেতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক