স্মরণে বরন : রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান

স্মরনে বর্রন : রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান

:: মাহবুবা জেবিন ::

“উদয়ের পথে শুনি কার বানী ভয় নাই ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয়নাই তার ক্ষয়নাই”

যুগে যুগে মহৎ কর্ম মানুষকে অমর করে রেখেছে । কাজের মাধ্যমে তাঁরা স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন । তেমনি সাহসিকতা, নির্ভীক দেশপ্রেম আর জনকল্যাণমূলক কাজের জন্যই বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে আছেন প্রয়াত রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান ।

১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর সিলেটের বিরাহিমপুরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম হয় এক নক্ষত্রের । আহমেদ আলী খান ও জুবাইদা খানমের কোল আলোকিত করা মাহবুব আলী খান আমৃত্যু তার এই আলো ছড়িয়ে গেছেন । তাঁর শৈশবের বেশির ভাগ কাটে সিলেট এবং অবিভক্ত ভারতের প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার পিতার কর্মস্থল কোলকাতায় । সেখানেই শুরু হয় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন । পরবর্তীতে চলে আসেন ঢাকায় । ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন । সারাজীবনে শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি কখনো দ্বিতীয় হননি । ১৯৫২ সালে ক্যাডেট হিসাবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যের দরমাউথে রয়্যাল নেভাল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন । ১৯৬৩ সালে মাহবুব আলী খানকে ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করেন ।

১৯৭১ সাল । মাহবুব আলী খান তখন কর্মস্থল করাচীতে । পাকিস্তানিরা তখন বাঙালি অফিসারদেরকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ করতে থাকে । মাহবুব আলী খান যখন দেশ মাতৃকার টানে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক তখনই তাঁকে সপরিবারে নজরবন্দী করা হয় ক্যান্টনমেন্টে। সাজানো সংসারের সব কিছু ফেলে এক কাপড়ে চলে আসার সময় স্ত্রী আফসোস করলে তিনি প্রিয়তমা স্ত্রী কে বলেন, ‘আমি যে তোমাকে স্বাধীনতা দেব’। এরপর প্রথম সুযোগ পেয়েই দেশের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেন । সাথে নারী ও শিশুদের নিয়ে কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও খচ্চরের পিঠে চড়ে পৌঁছান আফগানিস্তান । সেখান থেকে ভারত হয়ে অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে ফিরে আসেন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে।

দেশে ফিরেই বিধ্বস্ত দেশকে নতুন ভাবে গড়ে তোলার কাজে ঝাঁপিয়ে পরেন । প্রথম বাংলাদেশী হিসাবে চট্টগ্রামের মার্কেন্তাইল একাডেমীতে কমান্ডান্ট হিসাবে যোগ দেন মাহবুব আলী খান । ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ নেভির অ্যাসিস্ট্যান্ট চীফ অফ নেভাল স্টাফে উন্নীত হন । তিনি হন বাংলাদেশ নেভাল শিপ ‘ওমর ফারুকের’ ক্যাপ্টেন । তাঁর নেতৃতে বি এন এস ‘ওমর ফারুক’ আলজেরিয়া , যুগোস্লাভিয়া, মিশর, শ্রীলংকা, সৌদিআরব সহ পৃথিবীর বিভিন্ন নৌবন্দরে ভ্রমন করে এবং বাংলাদেশের নৌশক্তিকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন । ১৭৭৯ সালে তিনি চীফ অফ নেভাল স্টাফ হন । ১৯৮০ সালে রিয়ার অ্যাডমিরাল পদমর্যাদা লাভ করেন মাহবুব আলী খান ।

দানশীলতা তাঁর চরিত্রের আরেকটি গুণ । সমাজের কল্যাণ মূলক কাজে তিনি সর্বদা উৎসাহ যুগিয়েছেন । বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল স্থাপন করেছেন । সমাজের অবহেলিত শিশুদের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত ‘সুরভি’ মাহবুব আলী খান এর অনুপ্রেরণায় গড়ে উঠে । স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু এবং বড় কন্যা শাহিনা খান জামান নিজেদের উৎসর্গ করেছেন ।

পারিবারিক জীবনে মাহবুব আলী খান ছিলেন খুবই সাধারণ । স্বামী হিসাবে তিনি ছিলেন খুবই বন্ধুপ্রতিম । পরিবারের প্রত্যেকের মতামতকে খুবই গুরুত্ত দিতেন ।এমনকি ছোটদের মতামতকেও প্রাধান্য দিতেন । বড় ভাই এবং বড় বোনএর প্রতি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল । ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ায় শাশুড়িকে খুবই সম্মান করতেন ।

স্নেহময় পিতা মাহবুব আলী খান সন্তানদের নিয়মানূবর্তিতা শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতেন সবচেয়ে বেশী । তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষার পাশাপাশি নিয়ম মেনে চলা সুন্দর চরিত্র গঠনে সহায়তা করে । তাই সমাজ কল্যাণে তাঁর কন্যাদের ছোটবেলা থেকেই উৎসাহিত করতেন তিনি । তিনি বলতেন –‘বড় কিছু পাওয়া মানে অহংকারী না হওয়া’ । বিনয় নম্রতা ছিল মাহবুব আলী খানএর সবচেয়ে বড় গুন । সন্তানদেরকে সর্বদা বিনয়ী হবার শিক্ষাই দিতেন । ছোট বড় সবার সাথে সমান ভাবে মিশার শিক্ষাও তিনি সন্তানদের দিয়েছেন ।
নারী শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন মাহবুব আলী খান । স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুকে বিবাহের পরেও পড়াশুনা চালিয়ে যেতে উৎসাহ যুগিয়েছেন । তাঁরই অনুপ্রেরণায় তিনি ফাইন আর্টসে পড়াশুনা শেষ করেন । শিল্প ও সঙ্গীত অনুরাগী মাহবুব আলী খানের আগ্রহে তিনি শিখেছেন পিয়ানো বাদন । আর আজও নিরলশভাবে শিল্পচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন ।

খেলাধুলার প্রতি ছিল তাঁর প্রচণ্ড আসক্তি । তরুণ বয়সে খেলেছেন ফুটবল । টেনিস আর সুইমিঙের প্রতি তাঁর ছিল আলাদা টান । মাহবুব আলী খান ছিলেন হ্যান্ডবল এসোসিয়েশনের প্রধান । বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সফল আয়োজক ছিলেন তিনি।

পড়াশুনার পাশাপাশি মাহবুব আলী খান তাঁর মেয়ে শাহিনা খান জামান ও জুবাইদা রহমানকে খেলাধুলা, সঙ্গীত চর্চায় উৎসাহ দিয়েছেন । সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু স্বাধীনভাবে সমাজ কল্যাণ মূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন । সাংসারিক কাজের পাশাপাশি জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রেসিডেন্ট , সুরভির প্রতিষ্ঠাতা ও নৌবাহিনী প্রধানের স্ত্রী হিসাবে অনেক সামাজিক দায়িত্ব পালনে নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মাহবুব আলী খান সব সময় প্রেরনা যুগিয়েছেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে নারী অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের অবদান সবচেয়ে বেশী ।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে আধুনিক করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাহবুব আলী খানের অবদান অনস্বীকার্য । বাংলাদেশের জলসীমা রক্ষা, তালপট্টি দ্বীপের দখল নিশ্চিত করা, বাংলাদেশের সমুদ্র উপকুল জলদস্যু মুক্ত করার নেতৃত্তে ছিলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান ।

১৯৮২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মাহবুব আলী খান । এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৮৪ সালে ৬ আগস্ট সকালে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষন বিমান দুর্ঘটনা তদন্তে বিমানবন্দরে গেলে কর্তব্যরত অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ব্যথা অনুভব করলে তাঁকে সি এম এইচে নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানেই চিকিৎসা রত অবস্থায় মারা যান এই ক্ষণজন্মা পুরুষ ।

বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বাংলাদেশের গর্ব রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানকে তাঁর দেশপ্রেম, বীরত্ত, সাহসিকতা, জনকল্যাণ ও মহানুভবতার জন্য বাংলাদেশের মানুষ সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করবে ।

মাহবুবা জেবিন
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক।

Advertisement