৪০ ডলারের মাস্ক, প্রশ্নবিদ্ধ চুক্তি ও চালচোর

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মতো করোনা ভাইরাস (কভিড-১৯) কলম্বিয়ায় হানা দেয়ার পর সেখানেও লকডাউন জারি হয়। সিজার রাজ্য সরকার করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন। স্থানীয় আইনপ্রণেতা রিকার্দো কুইন্তেরো খেয়াল করেন, ওইসব ত্রাণ সামগ্রীর দাম অতিমাত্রায় বেশি। আতঙ্কিত হয়ে স্থানীয় একটি দোকান থেকে ওই একই জিনিসগুলো কিনতে যান তিনি। সেখান থেকে অর্ধেক দামে ওই ত্রাণ সামগ্রীগুলো কিনতে পারেন কুইন্তেরো। করোনা মহামারির সময় দুর্নীতির অভিযোগে ১৪টি অপরাধ তদন্ত চালু করেছে কলম্বিয়া। তার মধ্যে রয়েছে, ত্রাণ সামগ্রীগুলোর দামের পার্থক্য খতিয়ে দেখার তদন্তও। বৈশ্বিক মহামারির এ সময়ে বিশ্বের বহু দেশে এমন দুর্নীতি দেখা গেছে।

কুইন্তেরো বলেন, দুর্নিতী সবসময়ই খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে, সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপারটা হচ্ছে, এমন সময়ে এটা দেখতে হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে করোনার সংক্রমণ ঘটেছে প্রায় ২০০ দেশ বা অঞ্চলে। দেশে দেশে ভাইরাসটি মোকাবিলা করতে লাখ লাখ কোটি ডলার খরচ করছে সরকারগুলো। খাদ্য থেকে মাস্ক জোগাড়ে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতায় নামছে তারা। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতার চেয়ে দ্রুততার দিকেই বেশি জোড় দেয়া হচ্ছে। মহামারির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেককিছুতেই ছাড় দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো দেশ একেবারে উপায়হারা। বিশেষ করে যেসব দেশে মহামারিটি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে তাদের অবস্থা বেশি বেগতিক। সেখানে পরিস্থিতি এমন যে- হয়তো দ্রুত জিনিস কেনো নয়তো কোটি মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলো। তবে এমন পরিস্থিতি জনগণের অর্থ দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা, অসাধু ঠিকাদার ও অপরাধ সংগঠনের পকেটে চলে যাওয়া নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে।
দুর্নীতিবিরোধী পর্যবেক্ষক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান ম্যাক্স হেউড বলেন, এই মুহূর্তে দুর্নীতি হচ্ছে। সিস্টেমের নানা ফাঁকফোকর ও করোনা মোকাবিলায় ব্যয় করা অর্থের পরিমাণ বিবেচনায় এটা বলা যায় যে, আমরা খুবই উদ্বিগ্ন।
সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি দেখা গেছে কাজ হারানো শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত খাদ্য সহায়তার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ সরকার চলতি মাসে দরিদ্রদের জন্য চাল বিতরণের ব্যবস্থা করলে প্রায় ৬ লাখ পাউন্ড চাল উধাও হয়ে যায়। সরকারি আমলাসহ অন্তত ৫০ জন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চাল মজুত করে সরকারি মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এমন একটি জাতীয় সংকটের সময় মানুষের সমানুভূতি ও সংহতির মতো ভালো দিক বের হয়ে আসার কথা। কিন্তু আফসোস ও লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে, একইসঙ্গে মানুষের সবচেয়ে নিকৃষ্ট দিকও বের হয়ে এসেছে।
কলম্বিয়ার ইন্সপেক্টর জেনারেল ফারনান্দো ক্যারিলো জানান, দেশটিতে করোনার সময়ে দুর্নীতি নিয়ে চালু হওয়া ১৪টি তদন্তের বেশিরভাগই উচ্চমূল্য সংক্রান্ত। এর মধ্যে কুইন্তেরোর সিজার রাজ্যে উচ্চমূল্যে ত্রাণ সামগ্রী বিক্রয়ের ঘটনাও রয়েছে। কুইন্তেরোর অভিযোগ, সিজার রাজ্যের গভর্নর লুইস আলবার্তো মনসালভো নেক্কোর অধীনে করা খাদ্য চুক্তিগুলোয় দাম বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি তথ্য অনুসারে, ২৫০ গ্রাম কফির জন্য নেক্কো সরবরাহকারীদের ২.৮১ ডলার পরিশোধ করছিল। যেখানে স্থানীয় দোকানগুলোয় ১.২০ ডলারেই ওই কফি কিনতে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জনান তিনি।
মাস্ক ও ভেন্টিলেটরের মতো জিনিসের চড়া দাম বাজারের অর্থনীতি বিবেচনায় ব্যাখ্যা করা যায়: ঘাটতি ও উচ্চ চাহিদার কারণে এগুলোর দাম বেড়েছে। এখানে প্রশ্ন উঠে সরকারি চুক্তিগুলোয় জিনিসপত্রগুলোর উচ্চমূল্য ও সরবরাহকারীদের ব্যাকগ্রাউন্ড।
রোমানিয়ায় কেউ যেন জিনিসপত্র মজুদ না করতে পারে সেজন্য দামাদামির প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, এতে বেড়েছে অসাধু চুক্তির হার। রোমওয়াইন অ্যান্ড কফি এসআরএল নামের তামাক ও মদ প্রস্তুতকারী একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ১ কোটি ২৬ লাখ ডলার মূল্যের মাস্ক তৈরির চুক্তি পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাজারমূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ দামে সরকারের কাছে মাস্ক বিক্রি করছে। রোমওয়াইন অ্যান্ড কফি এসআরএলের এই চুক্তি পাওয়ার পেছনে রয়েছে মেডিক্যাল সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্যানিমেড ইন্টারন্যাশনালের হাত। এই প্রতিষ্ঠানটির কাছে সরকার কাছে বিশাল অঙ্কের কর পাওনা। তাই নিজ থেকে সরকারি চুক্তি করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি রোমওয়াইনের সঙ্গে তাদের একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। তাদের হয়ে রোমওয়াইন ওই চুক্তি করে। স্যানিমেডের মালিক কাতালিন হিদেগ বলেন, এরকম চুক্তি অস্বাভাবিক নয়। বিশ্বজুড়েই বড় প্রতিষ্ঠানই চুক্তির জন্য ছোট প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে। তিনি বলেন, এমন ঘটনাও আছে যে, তিন জন কর্মী ও তিনটি ল্যাপটপ নিয়ে গঠিত কোনো প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি ইউরো মূল্যের চুক্তি পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় জরুরি ব্যবস্থাপনা সংস্থা (এফইএমএ) ডেলওয়ার-ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার মূল্যের মাস্ক তৈরির চুক্তি বুঝিয়ে দিয়েছে। যদিও, এর আগে প্রতিষ্ঠানটির মাস্ক বা অন্যকোনো মেডিক্যাল সরঞ্জাম তৈরির কোনো ইতিহাস নেই। এদিকে, প্রতিযোগিতামূলক নিলামে না গিয়ে প্যান্থেরা ওয়ার্ল্ডওয়াইডকে দেয়া হয়েছে লোভনীয় এক চুক্তি। প্রতি মাস্কের জন্য প্রতিষ্ঠানটি পাচ্ছে ৫.৫০ ডলার করে। এর মালিকানা প্রতিষ্ঠান গত বর্ষায় দেউলিয়া হওয়ার আবেদন করেছিল। প্রতিষ্ঠানটির এক নির্বাহী পরিচালক জেমস পুনেলি জানান, বিগত বছরগুলোয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মেডিক্যাল প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ করেছে তারা। মাস্ক তৈরির চুক্তির জন্য নানা সামরিক সূত্র ব্যবহার করছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নজরদারি না থাকলে বিশাল পরিমাণে জালিয়াতি হতে পারে। ইউএস গভর্নমেন্ট একাউন্টাবিলিটি অফিসের ২০১৪ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ঘূর্ণিঝড় কাটরিনা ও রিটার পর এফইএমএ’র খরচ করা ২২ শতাংশ অর্থই জালিয়াতির শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল। এরপর থেকে অর্থ নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয় এফইএমএ। ২০১২ সালে ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির সময় অর্থ জালিয়াতি হওয়ার ঝুঁকির হার ২.৭ শতাংশে নেমে আসে।
(ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সংক্ষেপিত অনুবাদ।)

Advertisement