।। জুয়েল রাজ ।।
শুধু বাংলাদেশ নয়, এই উপমহাদেশের পুরনো ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের একটি দল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই পথ চলায় ৭২ বছর পাড়ি দিয়েছে সংগঠনটি। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, বাংলাদেশের নামের সাথে, রক্তের সাথে, মাটি ও মানুষের সাথে মিশে আছে সংগঠনটি। ৭২ বছরের দীর্ঘ পথচলায় বারবার হোঁচট খেয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে এবং মিথের ফিনিক্সের মতো আবার উড়েছে। বিশ্বের আর কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে আওয়ামী লীগের মতো এতো রক্ত ঝরাতে হয়নি।
ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আজকের দিনে গঠিত হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে করা হয় সাধারণ সম্পাদক। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু রাজনৈতিক নানা প্রেক্ষাপটে, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ্য হয়ে পড়লে হাল ধরেন শেখ মুজিবুর রহমান, হয়ে উঠেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৫৩ সালেই শেখ মুজিবুর রহমান ভারমুক্ত হয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে তিনি তার নেতৃত্বের যাদু দেখান, সারা দেশের মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করেন। নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয় লাভ করে যুক্তফ্রন্ট। আর শেখ মুজিবের উপহার জোটে কারাগার। সরকার প্রায় এক বছর জেলে আটকে রাখে তাঁকে।
১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর, আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেখ মুজিব দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহারের প্রস্তাব পেশ করলে, আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস, আওয়ামী লীগের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আওয়ামী লীগের ইতিহাস গণতন্ত্রের ইতিহাস, আওয়ামী লীগের ইতিহাস অসাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস, আওয়ামী লীগের ইতিহাস উন্নয়নের ইতিহাস। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলন, ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৬-দফাভিত্তিক ’৭০-এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ একটি রক্তাক্ত যুদ্ধের সূচনা, বাংলার প্রতিটি ধুলিকনায় লেখা হয়ে আছে সেই ইতিহাস।
লেখার শিরোনাম দেখে প্রথমেই প্রশ্ন আসতে পারে, আওয়ামী লীগ কোথায় হারিয়ে গেছে? আওয়ামী লীগের স্বর্ণালি সময়ে আওয়ামী লীগ তো বহাল তবিয়তে আছে তবে ফেরার প্রশ্ন আসছে কেন? দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ আওয়ামী সমর্থক ও তৃণ মূলের কর্মীদের মাঝে এক ধরণের হাহাকার পরিলক্ষিত হচ্ছে। তারা চর্বি ওয়ালা এই আওয়ামী লীগকে চিনছেন না। অচেনা লাগছে। আওয়ামী লীগের গায়ে এতো বেশী চর্বি জমেছে, যে আওয়ামী লীগকে বিপন্ন করে তুলেছে। বাজে কোলেস্টেরল যেমন হৃদ রোগের ঝুঁকি বাড়ায় , আওয়ামী লীগের ভিতরে সেই বাজে কোলেস্টরল জমে গেছে।
অনলাইন ঘাটাঘাটি করে, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী সমবায় লীগ, আওয়ামী শিশু লীগ, আওয়ামী তৃণমূল লীগ, আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, আওয়ামী মোটরচালক লীগ, আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, আওয়ামী যুব হকার্স লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎসজীবী লীগ, আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদশে আওয়ামী পর্যটন লীগ, জননেত্রী পরিষদ, দেশরত্ন পরিষদ, বঙ্গমাতা পরিষদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরিষদ, আমরা নৌকার প্রজন্ম, আওয়ামী শিশু যুবক সাংস্কৃতিক জোট, তৃণমূল লীগ, আমরা মুজিব হবো, চেতনায় মুজিব, মুক্তিযোদ্ধা তরুন লীগ, নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ছিন্নমূল মৎসজীবী লীগ, ক্ষুদ্র ব্যসায়ী লীগ, নৌকার নতুন প্রজন্ম নামের সংগঠন গুলোর খোঁজ পেয়েছি। এর বাইরে পেশাজীবি সংগঠনগুলো আসে নাই।
এই সব সংগঠন আওয়ামী লীগের বাজে কোলেস্টেরল। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে হেফাজত নামক দানবের মৃত্যু ঘটেছিল ২০১৩ সালের ৫ মে। সেই হেফাজত নানা রাজনৈতিক কৌশল কৌশল খেলা খেলে মাত্র সাত বছরে ভয়ংকর রূপে পুণর্জন্ম নিয়েছে। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ নীরব ছিল, একই অবস্থা ২০২১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়ে মামুনুল কান্ড পর্যন্ত। এরা নীরব ছিলেন। বিশেষ করে ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে যে ঝড় সামলে নিয়ে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে নতুন এক এক আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ায়।
প্রাচীন এবং বৃহৎ সংগঠন হিসাবে, সময়ে, অসময়ে নানা মতের মানুষ এসে ভীড়েছে এই সংগঠনে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। এই সুবিধাভোগী, নৈতিক বেশ্যাদের অনুপ্রবেশ রোধ করাও খুব কঠিন। প্রয়োজনে এরা নিজের মা কে ও বাজির দান ধরতে পারে। এইসব নৈতিক বেশ্যাদের, প্ররোচনা, দলের ভিতর প্রভাব বিস্তার করা, অর্থ বিত্ত পদ পদবী নিয়ে সংগঠনের মৌলিক আদর্শের জায়গায় পঁচন সৃষ্টি করেছে। মাঝে মাঝে কিছু নেতা কর্মীর কারণে এই আওয়ামী লীগকে অচেনা মনে হয় মাঝে মাঝে । ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলের নেতা আর আওয়ামী লীগের নেতার মধ্যে কোন পার্থক্য করা যায় না।
এক ছোটভাই সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল আমি এখনো কি ভাবে বিশ্বাস করি যে, আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ধারণ করে? উত্তরে বলেছিলাম কাগজে কলমে হউক, অথবা বিশ্বাসে হউক, আওয়ামী লীগের মূল শক্তি এই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি। আওয়ামী লীগ যদি এই চেতনা থেকে সরে যায়, তবে আওয়ামী লীগ দলটাই নিশ্চহ্ন হয়ে যাবে।
১৯৭২ সালে, কলকাতার যুগান্তর পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, অসাম্প্রদায়িকতার একটি চারাগাছ আমি রোপন করেছি বাংলাদেশে, কেউ যদি এই চারাগাছটি উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে, বাংলাদেশের অস্থিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে।
স্বাধীনতার ঠিক ৫০ বছর পর সেই বিপন্ন অবস্থায় বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ যদি হারে, বাংলাদেশ হেরে যাবে, আওয়ামী লীগই শেষ ভরসার জায়গা। বাংলাদেশের শেষ ঠিকানা। আওয়ামী লীগের সামনে আর কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে আর কোন রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নেই, আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করার। দুটি ধারায় বিভক্ত বাংলাদেশ এক ধারায় প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক বাহক আওয়ামী লীগ, অন্য ধারায় আওয়ামী বিরোধী সব সংগঠন। সেখানে ডান বাম মধ্যপন্থা সব এক জায়গায় মিলিত হয়েছেন। যে বাম সংগঠনগুলো নিজেদের প্রগতিশীল দাবী করতো, তারা ও হেফাজতের সাথে ভীড় জমিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় তারাই প্রথম রাজপথে নেমেছিল। হেফাজত পরে যার ফায়দা উঠিয়েছে।
৭৩ বছরে পদার্পণকারী সংগঠন আওয়ামী লীগ তার আদর্শিক জায়গায় অটুট থাকুক। নৈতিক বেশ্যাদের কাছে যেন জিম্মি না হয়। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শে বিশ্বাসীদের হাতে যেন নৌকার বৈঠা থাকে। যার হাল ধরে আছেন শেখ হাসিনা। এতো এতো উন্নয়ন, এতো সাফল্য, কিন্ত দল হিসাবে মাঠ পর্যায়ে এক বিক্ষিপ্ত আওয়ামী লীগকেই আমরা দেখছি। সরকারের সাফল্যে, সংগঠন আওয়ামী লীগ ভাগ বসাতে পারছে না। সেখানে সেই উন্নয়নে ভাগ বসাচ্ছে প্রশাসন আমলারা। স্থানীয় নেতা কর্মীরা অনেকটাই ম্লান। আওয়ামী লীগের প্রাণ এর মাঠ পর্যায়ের তৃণমূলের নেতাকর্মী। বারবার এরাই রক্ত ঝরায়, প্রাণ দেয়। আওয়ামী লীগের জন্য, বঙ্গবন্ধুর জন্য, শেখ হাসিনার জন্য বুক পেতে দেয়। আওয়ামী লীগকে সেই তৃণমূলে ফিরতে হবে। ১৯৫৫ সালের অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগে ফিরতে হবে। দলছুট সুবিদাভোগী মানুষ যুগে যুগে ছিল, এরা আছে, ভবিষ্যতে ও থাকবে, পলাশীতে যেমন ছিল মীরজাফর, ৭৫ এ ছিল খন্দকার মোশতাক, শেখ হাসিনা ও ১৯৮০ সালের পর থেকে এইসব অনেক মুখের সাথে পরিচিত।
একটা গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাইছি।
এক রাজার পায়ের কাছে এক বানর বসে থাকত, রাজা প্রতিদিন দরবারে প্রবেশ করে মসনদে বসার আগে বানর কে একটি লাত্থি মেরে গিয়ে সিংহাসনে বসতেন। অনেক দিন পর সভাসদরা বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষা শুরু করলেন। এর মধ্যে আবার অবলা প্রাণীকে এইভাবে কারণ ছাড়া প্রতিদিন লাথ দেয়ার জন্য ও তাদের মন পুড়তে থাকে। তখন তো আর এখনকার মতো প্রাণী অধিকার সংগঠন ছিল না।
তারা একদিন সাহস করে মহারাজকে জিজ্ঞাসা করলেন নিরীহ বানরটিকে প্রতিদিন লাথি দেয়ার কারণ কী?
মহারাজ কোন উত্তর দিলেন না। পরের দিন থেকে বানরকে লাথ দেয়া বাদ দিয়ে দিলেন, সভাসদগণ ও খুশি, দুইদিন পরেই দেখা যায় বানর মহারাজের সিংহাসনের হাতলে উঠে বসে আছে। তৃতীয় দিন দেখা গেল বানরটি মহারাজের কাঁধের উপড় বসে আছে। পরের দিন মহারাজ দরবারে এসেই আবার বানরের পাছায় লাথি দিয়ে গিয়ে সিংহাসনে বসলেন। দেখা গেল বানরটি মহারাজের পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে বসে থাকল।
মহারাজ সভাসদদের উদ্দ্যেশ্য বললেন আশা করি আপনারা উত্তরটা পেয়ে গেছেন। সভাসদ সবাই চুপ।
লেখক : ব্রিটেন প্রবাসী সাংবাদিক কলামিস্ট