আবার কে বাজাবে বিদ্রোহের সেই অগ্নি- বীণা?

।।অধ্যাপক আব্দুস সহিদ খান।।

জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, সমাজ ও মানুষের প্রতি বুকভরা ভালোবাসা জাতীয় কবি নজরুলের কবিতাকে রাঙিয়েছে নানা রঙে।মাত্র ২১ বছর বয়সে নজরুল লিখেছিলেন “বিদ্রোহী “।এর আগে এতো কম বয়সে কেউ বাংলা সাহিত্যে এতো গভীর দাগ কাটতে পারেননি।সত্যিই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাতেই নজরুল ইসলাম সমুস্হ সাহিত্য জগতের কাছ থেকে সচকিত স্বীকৃতি যেনো সবলে আদায় করে নেন।
‘বিদ্রোহী’ আসলে কী কবিতা? না কোনো আগুনের গোলা?বাঙালির শিরায় শিরায় যেনো বয়ে গেলো তরল অনল।’বিদ্রোহী’র সেই আগুন- ঝরা লাইনগুলিই তার প্রমাণ, –

মহা -বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ
ভীম রণভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।

অত্যাচারের বিরুদ্ধে,উৎপীড়নের বিরুদ্ধে, অত্যাচারীর বিরুদ্ধপে এমন ভাষায় আর কোনো বাঙালি কবি চ্যালেঞ্জ জানাননি।তখনকার রাজশক্তি এই কবিতা বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই সচকিত হয়ে উঠেছিলো। উৎপীড়ক সাম্রাজ্যবাদী রাজশক্তির বিরুদ্ধে কে এমন ভাষায় গর্জে উঠেছেন?’বিদ্রোহী’র লেখক কে? সরকারী আমলারা বেসামাল।আমলাদের সঙ্গে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন গোয়েন্দারা,সরকারী আইন-বিশারদরাও।কিন্তু কোনো আইনেই সেদিন ‘বিদ্রোহী’র বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নেওয়া গেলো না।অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখায় আমলাদের সেই অসহায় অবস্হা সুস্পষ্ট,-

“এ কবিতায় হিন্দু- মুসলমান দু’জনেরই এত পুরাণ প্রসঙ্গ ঢুকেছে যে ব্রিটিশ সরকার সরাসরি একে রাজদ্রোহ বলে চিহ্নিত করতে পারল না।কখনো ঈশান- বিষানের ওম্কাট বাজছে,কখনো বা ঈস্রাফিলের শিঙ্গা থেকে উঠেছে রণহুম্কার। কখনোবা হাতে নিয়েছে মহাদেবের ডমরু- ত্রিশূল, কখনো বা আর্ফিয়াসের বাঁশি।কখনো বাসুকীর ফণা জাপটে ধরেছে।কখনো বা জিব্রাইলের আগুনের পাখা, কখনো চড়েছে’ তাজি বোররাকে’ ( পঙ্খীরাজ ঘোড়া), কখনো বা উচ্চৈঃপ্রবায়।একে রাজদ্রোহ বলতে গেলে ধর্মের উপরে হাত দেয়া হবে।”
[জ্যৈষ্ঠের ঝড়,পৃ ১১৯]

এই ‘বিদ্রোহী’র কবি অখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের পর্ণকুঠির থেকে কলকাতার মোষের খাটালের ওপর মশায় ভরা অন্ধকার বাক্স- ঘর…খুব দীর্ঘ পথ নয়,খুব দুর পথও নয়…কিন্তু এই পথটুকুর মধ্যে,যার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এক নিঃস্ব অসহায় অশিক্ষিত গেঁয়ো ছেলে, আর এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে জীবন্ত অবস্থায় পাথরের মূর্তির মতো আমাদের সকলের কৃপাপ্রার্থী ভাগ্যহত অসহায় বাংলার শ্রেষ্টতম কবি আর সঙ্গীতকার….

তার মাঝখানে ঘটে গেছে কাব্যের ইতিহাসে, ব্যক্তিত্বের ইতিহাসে,জাতীয়তার ইতিহাসে এক পরম বিস্ময়কর বিবর্তন….

সে বিবর্তন যে কতখানি বিষ্ময়কর,কতখানি স্বতন্ত্র, কী অপরুপ তার গতির ছন্দ ও মাধুর্য… কী প্রবল তার আত্বপ্রকাশ যারা না দেখেছে- না উপলব্দি করেছে তাদের তা বোঝানো অসম্ভব।

আজ যদি ধরিত্রীর খেয়ালে শুকিয়ে যায় নায়েগ্রার জলপ্রপাত, কোন ফটোগ্রাফের ছবি থেকে বোঝানো যাবে না,সেই প্রচন্ড প্রবাহের জীবন্ত গতি-বেগ কী বিস্ময়কর ছিল…!

আজ বাংলাদেশের চোখের সামনে যাঁদের কবি বলে জানি,গায়ক বলে জানি,সুরকার বলে জানি, তাঁদের জীবনের গতি ও ধারা থেকে বোঝা যাবে না, কবি নজরুল ইসলাম কী ছিলেন….

প্রচন্ড বন্যার মতো,লেলিহান শিখার মতো, পরাধীন জাতির তিমির- ঘন অন্ধকারে,জাতির ভাগ্য- বিধাতা নজরুলকে সম্পূর্ণ এক স্বতন্ত্র ছাঁচে গড়ে পাঠিয়েছিলেন।

বাঙালির শেষ রাত্রির ঘনান্ধকারে নিশীত- নিশ্চিন্ত নিদ্রার মধ্যে আমরা শুনেছি রুদ্র- বিধাতার সেই অট্রহাসি,নজরুলের জীবনে, নজরুলের কাব্যে, নজরুলের সঙ্গীতে,নজরুলের পৌরুষ- কন্ঠে।

বাংলার আকাশে মেঘে মেঘে এখনো ছড়িয়ে আছে শেষ রাত্রির অন্ধকার।বাইরে থেকে কানে আসে শুধু ফেরুপালের ঐক্যতান অন্ধকারে নিস্তব্দতার চক্রান্ত।গৃহ -প্রাঙ্গণে কানে আসে শুধু মেনি বিড়ালের সঙ্গী অন্বেষণ – চিৎকার।

বাঙালির অন্তর থেকে,মস্তিষ্ক থেকে নিভে গিয়েছে বিদ্রোহের আগুন, বিদ্রোহহীন বাঙালির অন্তর তার ইতিহাসের অস্বীকৃতি।

আজ সবচেয়ে প্রয়োজন ছিলো নজরুলের রুদ্র- বীণার পৌরুষ,পুরুষ- কন্ঠের,নজরুলের বেপরোয়া অট্রহাসির।

কে বাজাবে আবার ‘বিদ্রোহী ” অগ্নি-বীণা’?

একটা সমগ্র জাতি অপেক্ষা করে আছে তার জন্যে… অপেক্ষা করে থাকতে হবে তারই জন্যে যে আসবে নিয়ে আবার বিদ্রোহের অগ্নি- বীণা।
[ জাতীয় কবির ৪৪ তম প্রয়াণ দিবসে আমার শ্রদ্ধার্ঘ]

Advertisement