আসামিদের দম্ভোক্তি

সিলেট অফিস :: অনুশোচনা নেই ধর্ষকদের। বরং আদালত চত্বরে তাদের দম্ভোক্তি দেখে বিস্মিত সবাই। ক্ষুব্ধ আইনজীবীরাও। এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে দলবেঁধে গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৭ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু আসামিরা ধর্ষণের ঘটনা স্বীকার করেনি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আটক হওয়া ৭ আসামি একেক জন একেক সময় নানা তথ্য দিচ্ছে। এসব তথ্যে তারা নিজেদের রক্ষায় ব্যস্ত। গ্রেপ্তারকৃতরা এখনো মূল ঘটনা প্রকাশ করেনি।

এ কারণে আদালতের কাছে তাদের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। আদালত তাদের রিমান্ডে দিয়েছেন। এখন তাদের আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনার পর রোববার গ্রেপ্তার করা হয় প্রধান আসামি সাইফুর, অর্জুন ও রবিউলকে। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, সোমবার তাদের আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাওয়া হয়। এ সময় আদালতে আসামিরা নিজেরা নিজেদের শুনানিতে অংশ নেয়। তারা তিনজনই জানায়, ‘ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই। তারা ঘটনা জানে না। এ ঘটনা ঘটিয়েছে রাজন, তারেক ও আইনুদ্দিন।’ তবে তাদের এই বক্তব্যকে আমলে নেননি আদালত। অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের রিমান্ডে দেয়া হয়। পরে আদালত থেকে বেরিয়ে এসে আইনজীবীরা জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের মধ্যে অনুশোচনা নেই। লোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়েও তারা বিব্রত নয়। এদিকে গতকাল আদালতে হাজির করা হয় আসামি শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, রাজন ও আইনুদ্দিন আইনুলকে। এ সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের শতাধিক আইনজীবী ছিলেন। শুনানির এক পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্যকালে আসামি রাজন ‘গৃহবধূকে নিয়ে কটূক্তি করে।’ তার এ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন উপস্থিত আইনজীবীরা। আদালতে উপস্থিত থাকা সব আইনজীবী এক সঙ্গে প্রতিবাদ জানান। আইনজীবীরা বলেন, ঘটনাটিকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে আসামিরা এ ধরনের মন্তব্য করছে। আসামিদের রিমান্ড শুনানি শেষে বেরিয়ে এসে সিনিয়র আইনজীবী হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন- ‘ওদের দম্ভোক্তি কমেনি। তারা ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা করছে। এতে আমরা প্রতিবাদ করছি।’ তিনি বলেন- ‘এমসি কলেজ হচ্ছে আমাদের প্রাণের কলেজ। ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপীঠের ঐতিহ্যে আঘাত করেছে আসামিরা। সুতরাং আমাদের জেলা বারের কোনো আইনজীবীই ধর্ষকদের পক্ষে দাঁড়াবে না। গতকালও দাঁড়াননি, আজও দাঁড়াননি।’

এদিকে আসামি শাহ রনি, রাজন ও আইনুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেছিলো র‌্যাব। গ্রেপ্তারের পর তাদেরকে র‌্যাবও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে। সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব জানিয়েছিলো- আসামিদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া আইনুদ্দিন সিলেটের আলোচিত মজিদ ডাকাতের নাতি। সে এলাকায় ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তার নেতৃত্বে বালুচর পয়েন্ট থেকে টুলটিকর পর্যন্ত ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ হয়। ছাত্রলীগের রঞ্জিত গ্রুপের সক্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত সে। দুর্ধর্ষ অপরাধী হিসেবে পুলিশ তাকে চেনে। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে শাহপরান থানায় অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে সোমবার রাতে তাদের শাহপরান থানা পুলিশে হস্তান্তরের পর আসামিরা ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে নানা নাটকীয়তার আশ্রয় নেয়। তারা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে। এ কারণে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) জ্যোর্তিময় সরকার। তিনি জানান, রিমান্ডে এনে তাদের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারের পর আসামিরা ধর্ষণের শিকার হওয়া গৃহবধূর ওপর দোষ চাপাতে চাচ্ছে। ফলে পুলিশ তাদের কথা বিশ্বাস করছে না। পুলিশের ধারণা ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে আসামিরা চালাকি করছে।

এজাহারে যা আছে: আলোচিত এ ঘটনার পর ধর্ষিতা গৃহবধূর স্বামী দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার বাসিন্দা শাহপরান থানায় এজাহার দাখিল করেন। ওই এজাহারকে পুলিশ মামলা হিসেবে রেকর্ড করে। এজাহারে নির্যাতিতার স্বামী উল্লেখ করেন ঘটনার দিন সন্ধ্যায় হযরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করে নিজেদের গাড়ি নিয়ে ফিরছিলেন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন স্বামী ও পাশে বসা ছিলেন নববধূ। রাত পৌনে ৮টার দিকে তারা মহাসড়কসংলগ্ন এমসি কলেজের প্রধান ফটকে এসে পৌঁছান। সড়কের একপাশে গাড়ি দাঁড় করে স্বামী সিগারেট কিনতে নামেন। তিনি কিছুদূর যাওয়ার পরই গাড়ি ঘিরে ফেলে ৪ যুবক। এক পর্যায়ে তারা গৃহবধূকে লক্ষ্য করে নানা অশ্লীল মন্তব্য করে। এ দৃশ্য দেখে স্বামী এসে প্রতিবাদ করলে তাকে চড়-থাপ্পড় মারা হয়। এক পর্যায়ে এক যুবক উঠে বসে গাড়ির চালকের আসনে। অন্য ৩ জন স্বামী-স্ত্রীকে গাড়িতে উঠতে বাধ্য করে। এমসি কলেজের প্রধান ফটক থেকে কয়েকশ’ মিটার দূরে অবস্থিত ছাত্রাবাসের একেবারে শেষ প্রান্তের ৭ নম্বর ব্লকে। গাড়ির পেছনে পেছনে মোটরসাইকেলে আসে আরো কয়েকজন। সেখানে স্বামীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে অন্ধকার-নির্জন এলাকায় নিয়ে আটকে রাখা হয়। আর গাড়ির ভেতরেই পালা করে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে ৪ জন। ওই ৪ জন হলো ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম তারেক, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি ও অর্জুন লস্কর। এরপর তারা স্বামী-স্ত্রীর টাকা, স্বর্ণালঙ্কারও লুটে নেয়। মামলার বাদী জানিয়েছেন, ধর্ষণের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিল ৪ জন। তারা জোরপূর্বক তার স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। এরপর টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুটে নিয়েছে। তিনি আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

Advertisement