আবদেল বারি আতওয়ান
সিরিয়ার কেন্দ্রে (দামেস্কে) ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনাবলির নিবিড় পর্যালোচনা করলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট হয়। বিষয়গুলো সংক্ষেপে উপস্থাপন করা যাক।
এক. ইসরায়েলি দখলদারি ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রতিরোধী শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে ইরান। প্রায় এক শতক আগে আরব-ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর ইরানই তেমন সামরিক শক্তি হয়ে উঠেছে, যাকে ইসরায়েলের সামরিক-রাজনৈতিক সব নেতাই সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে বাধ্য হন। এটা শুধু এ কারণে নয় যে ইরানের প্রবল সামরিক শক্তি রয়েছে, বরং অনানুষ্ঠানিক সামরিক নেটওয়ার্ক রয়েছে তার, যা যেকোনো সময় অপ্রথাগত যুদ্ধ শুরু করতে সক্ষম।
দুই. ২০১৮ সালে রাশিয়ার যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, ২০১৯ সালে তার বদল হবে বলেই মনে হয়। সিরিয়ায় ইসরায়েলের পৌনঃপুনিক হামলার জবাবদানে ব্যর্থতার কারণে রাশিয়াকে অনেক সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। তার নির্ভরযোগ্যতায় মিত্রদের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। আশা করা যায়, দ্রুত তার অবস্থানে বড় পরিবর্তন দেখা যাবে।
তিন. সম্প্রতি রাশিয়ার দৈনিক কম্মারসান্ত পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে নিশ্চিত করে বলা হয়েছে, সিরিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ শেষে মার্চ নাগাদ এস-৩০০ চালানোর সক্ষমতা অর্জন করবে। সর্বশেষ ইসরায়েলি হামলা ঠেকাতে কেন এস-৩০০ ব্যবহার করা হয়নি, এ খবর তার জবাব।
চার. সব ইরানি সেনাকে সিরিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত থেকে, বিশেষ করে গোলান এলাকার নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে থাকতে হবে—এমন একটি শর্তে রাশিয়াকে রাজি করিয়েছিল ইসরায়েল। বিষয়টি বোধ হয় যথামাত্রায় কাজ করেনি। কারণ গণমাধ্যমে প্রকাশিত ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তাদের কথাবার্তায় মনে হয়, সীমান্ত থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে ইরান তার সেনা মোতায়েন করে রেখেছে।
পাঁচ. ক্রমেই এ ধারণা প্রবল হচ্ছে—ইসরায়েল যদি আবার হামলা চালায়, তাহলে সিরিয়া ও ইরান পাল্টা হামলা চালাবে। ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলার জবাবে গোলানে ৫০০ কেজি বিস্ফোরকের মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার মধ্য দিয়ে এটাই নিশ্চিত হয়েছে যে পাল্টা হামলা চালানোর ব্যাপারে যে সীমা মানা হতো, সেটা ভেঙে পড়েছে। কুদস বাহিনীর প্রধান জেনারেল কাশেম সুলেইমানি ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব বিশেষত সর্বশীর্ষ নেতা আলী খামেনির সঙ্গে পরামর্শ না করেই এ হামলা করেছেন, এটা মনে করার কারণ নেই। এ হামলার চরিত্র কৌশলগত। ভবিষ্যতে কী হতে পারে তার ইঙ্গিত এ পাল্টা হামলার মাধ্যমে ইসরায়েলকে দেওয়া হয়েছে।
সিরিয়ায় ইরানি বিপ্লবী গার্ড কোরের ঘাঁটিতে সর্বশেষ হামলার সফলতা নিয়ে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা উচ্চকণ্ঠ। কিন্তু এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে, এমনকি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও। আসলে গোলানে সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি এবং এর বিপরীতে দক্ষিণ ফ্রন্ট খোলার বিষয়টিকে ঢাকার জন্যই এসব হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।
আমাদের বিশ্বাস, এস-৩০০ চালু হলে এ বছরেই সিরিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা বিষয়ক সক্ষমতা এক লাফে অনেক বেড়ে যাবে। তুলনামূলকভাবে কম সক্ষম রুশ আকাশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, যেমন—পান্তসির ও বাক দিয়ে বেশির ভাগ ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। অতএব এস-৩০০ চালু হলে কী ঘটবে, তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
সিরিয়া ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না। এখন তাদের লক্ষ্য বিদ্রোহী অধ্যুষিত শহর এবং এলাকা পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু ইরানের চিন্তা ভিন্নতর হতে পারে। বিপ্লবী গার্ড কোর শুধু দক্ষিণ সিরিয়া থেকে নয়, ইরাক থেকেও হামলা চালাতে পারে। এ কারণেই সম্প্রতি ইরাককে হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল।
সিরিয়ায় সামরিক হামলার জন্য নেতানিয়াহু কড়া সমালোচনার সম্মুখীন। আত্মপক্ষ সমর্থনে তিন-তিনবার কোনো কারণ না দেখিয়েই তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র আছে। যারা ইসরায়েলের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তাদের ওপর হামলা চালানো হবে। এসব কথা অস্থির চিত্তের লক্ষণ।
কিছু আরব দেশ বুঝতে অক্ষম—তাদের পিছু হটার কারণে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করতে যাচ্ছে ইরান। এখন ইসরায়েলের সরাসরি প্রতিপক্ষ তারা। ওই সব দেশের অপপ্রচার সত্ত্বেও ইরান মধ্যপ্রাচ্যে নেতৃত্বের ভূমিকা নিশ্চিত করতে যাচ্ছে। ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও লেবাননে তার প্রভাব বাড়ছে, সুদানেও তার প্রভাব আবার দেখা যাবে। অথচ আরব মাতব্বররা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ব্যস্ত।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক, রাই আল-ইয়োমের প্রধান সম্পাদক
সূত্র : রাই আল-ইয়োম (অনলাইন)
ভাষান্তর : সাইফুর রহমান তারিক