ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: কিছুদিন আগে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ও কবিতা খানমের বক্তব্য নিয়ে অনেক আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যে কারণে এ বিষয়ে বেশ চর্চা হয়েছে ও হচ্ছে। বাংলাদেশে যেকোনো নির্বাচন, তা দলীয় বা নির্দলীয়, যে সরকারের অধীনেই হোক না কেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় এলেই নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। সবার দৃষ্টিও তখন নির্বাচন কমিশনের দিকে নিবন্ধিত থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো থেকেও দাবিদাওয়া বাড়তে থাকে।
নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলো যথাসম্ভব শোধরাতে আগের সব নির্বাচন কমিশনকেই কমবেশি চাপের মুখে কাজ করতে হয়েছে। এই প্রবণতা ১৯৯১ সালের পর থেকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দিলে তা নিয়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় ওঠে, দাবি ওঠে পদত্যাগের। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনও বেশ চাপের মুখে রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। ধারণা করি, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ সামনে আরও বাড়তে থাকবে এবং চ্যালেঞ্জগুলোও হবে ১৯৯০-এর পর গঠিত যেকোনো নির্বাচন কমিশনের চেয়ে বেশি। কারণ, সংবিধানের ১২৩(৩)(ক)-এর আওতায় বিদ্যমান সরকার ও সংসদ রেখেই নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।
এ পরিস্থিতিতে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। এরই মধ্যে মাহবুব তালুকদারের উত্থাপিত কয়েকটি বিষয় নিয়ে কমিশনের সভায় আলোচনা না হলেও এ নিয়ে প্রথম আলোসহ অন্যান্য পত্রিকায় বেশ কয়েকটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধগুলোর বিষয়বস্তু ছিল কমিশনের এখতিয়ার নিয়ে। এ বিষয় নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই না। কারণ, নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের বিষয়টি সংবিধানের ১১৮ থেকে ১২৬ ধারায় সুস্পষ্ট দেওয়া আছে। তার ওপর রয়েছে সময়ে সময়ে উচ্চ আদালতে ব্যাখ্যা।
আমার আজকের লেখার মূল বিষয় কিছু কিছু মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্বাচন কমিশনের নজরদারির প্রসঙ্গ। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিষয়টি প্রথম উত্থাপন করেছেন, তা নয়। এ টি এম শামসুল হুদা কমিশনে প্রথম এ প্রসঙ্গ ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়ে সুপারিশ আকারে উত্থাপিত হয়েছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০১১ সালের মাঝামাঝি এ টি এম শামসুল হুদা কমিশনের (আমিও যার একজন সদস্য ছিলাম) সঙ্গে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরপিও সংশোধনের সুপারিশগুলো নিয়ে প্রায় দুই মাসব্যাপী (৭ জুন-৭ আগস্ট ২০১১) আলোচনা বা সংলাপ হয়েছিল। সংলাপ হয়েছিল সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সঙ্গেও। ওই আলোচনায় অন্য বিষয়াদির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নির্বাচনী আইনের অধিক সংস্করণের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কর্মক্ষমতা বাড়ানো, যাতে আগামী নির্বাচন কমিশনগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মোট ৩১টি নিবন্ধিত দল অংশগ্রহণ করেছিল।
রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য শরিকজনের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আরপিওতে ৩১টি সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজনের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে ১৬টি ত্রুটি সংশোধন, ৬টি অধিকতর স্পষ্টীকরণ এবং ৯টি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনের বিষয় ছিল, যার মধ্যে নির্বাচনের সময়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ছাড়পত্র গ্রহণ ছিল অন্যতম। সুপারিশে একটি ডিভিশন ও দুটি মন্ত্রণালয়ের ক্যাবিনেট ডিভিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এবং তা আরপিওর আর্টিকেল ৪৪(খ)(৫) অনু-অনুচ্ছেদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করারও সুপারিশ করা হয়েছিল (মোট চারটি মন্ত্রণালয় ও একটি ডিভিশন)।
ওপরের প্রস্তাবনার লক্ষণীয় বিষয় হলো, নির্বাচন চলার সময়ে আলোচিত মন্ত্রণালয়গুলোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে ইসির মতামত গ্রহণের আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করা। এখানে কোনোভাবেই নির্বাচন কমিশনের কাছে মন্ত্রণালয় হস্তান্তর বা পরিচালনা বা কথা বলা হয়নি। কারণ, কোনো স্বাধীন নির্বাচন কমিশনেরই মন্ত্রণালয় পরিচালনার মতো কাঠামোগত সামর্থ্য ও দক্ষতা থাকার কথা নয়। মতামত গ্রহণ মন্ত্রণালয় পরিচালনা নয়। অনেকেই বিষয়টিকে আলাদা করে দেখছেন না। এ ধরনের প্রয়োজনীয়তা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আরও বেশি গুরুত্ব বহন করে। অন্য বিষয়গুলোর মধ্যে এই প্রস্তাব উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিবিদ ও বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেও সমর্থন পেয়েছিল। এখন বর্তমান সরকারের শরিকসহ প্রায় ১৫টি দল এর পক্ষে মতামত দিয়েছে বলে আমরা সংবাদমাধ্যমসূত্রে জেনেছি। কাজেই বিষয়টি যে নির্বাচন কমিশনের কাছে একেবারে নতুন, তেমন নয়। বর্তমান কমিশন আয়োজিত নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনাতেও এই প্রসঙ্গে মতামত দেওয়া হয়েছিল।
আমাদের পাশের দেশ ভারতের নির্বাচন কমিশনকে অ্যাফ্রো-এশিয়ান দেশগুলোর মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেখানে এটা কার্যকর রয়েছে। ভারতে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে পরবর্তী সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়গুলো নির্বাচন কমিশনের পূর্বানুমতি ছাড়া অনেক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করে না। হালের একটি বড় উদাহরণ হলো বিগত নির্বাচন চলাকালে (২০১৪) ভারতীয় সেনাপ্রধান নিয়োগের ঘোষণা স্থগিত করা। ভারতে বাহিনীপ্রধানদের নিয়োগের ঘোষণা করা হয় দায়িত্ব গ্রহণের তারিখের ৬০ দিন আগে। এই নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ছাড়পত্র ভারতীয় নির্বাচন কমিশন লোকসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার পর ১২ মে ২০১৪-এ প্রদান করে।
শুধু ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ই নয়, সব কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের মন্ত্রণালয়ের জন্য একই ব্যবস্থা। ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কোরাইশি তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অনেক বিষয়ে লিখিত আইন বা বিধি না থাকলেও সংবিধানের ৩২৪ আর্টিকেল এবং উচ্চ আদালতের ব্যাখ্যায় নির্বাচন কমিশন শক্তি অর্জন করে থাকে। তিনি তাঁর লেখা বই অ্যান আনডকুমেন্টেড ওয়ান্ডার-এ একপর্যায়ে লিখেছেন যে ভারতের সম্পূর্ণ প্রশাসন নির্বাচনী চলাকালে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে ন্যস্ত থাকে। এমনকি সরকার ওই সময়ে সচিব পর্যায়ের রদবদলও করতে পারে না। ওই পুস্তকে তিনি বলেছেন যে নির্বাচন চলাকালে ভারতের নির্বাচন কমিশন সরকারের ওপর একপ্রকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপ নেয়। এ ধরনের ব্যবস্থার আইনি ভিত্তি না থাকলেও ব্যবহারিক আইনে প্রণীত হয়েছে, যেমনটা হয়েছে ভারতের ‘মডেল কোড অব কনডাক্ট’। আইনের আওতায় না হলেও আর্টিকেল ৩২৪-এর আওতায় উচ্চ আদালত এর যেকোনো ব্যত্যয়কে আমলে নিয়ে থাকে। কাজেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইনে নেই, এমন পদক্ষেপ নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে রয়েছে। এমনকি নির্বাচন কমিশনের পরিপত্র, যদি কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, নির্বাচনী আইন হিসেবে গণ্য করা হয়।
ভারতের সংবিধানের এবং নির্বাচনী আইনের ধারাগুলোর মতোই আমাদের সংবিধানেরও আরপিওর মূল ধারাগুলো রচিত। ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ও নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা সর্বজনবিদিত। উপমহাদেশের সব দেশই ভারতের স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে আইন ও বিধি তৈরি করেছে। এমনকি পাকিস্তানের হালের নতুন নির্বাচনী আইন ২০১৭ ভারতের নির্বাচনী আইনকে সামনে রেখে তৈরি করা হয়েছে। এই উপমহাদেশের সর্বশেষ উদাহরণ ভুটানের নির্বাচন কমিশন।
ওপরে আলোচিত বিষয় ছাড়াও বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ২০১১ সালের সুপারিশমালায় অন্যান্য বিষয় ছাড়া আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত গৃহীত হয়েছিল। এর একটি ছিল পর্যায়ক্রমে নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার এবং আরজিও ধারা ৭৩-এ কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রমাণিত নয়। তা নিয়ে প্রতিপক্ষের যেকোনো বক্তব্যের মাধ্যমে চরিত্রহনন নিষিদ্ধকরণ: ধারা ২২(১)-এ এজেন্ট বিষয়ে বিশদ আইনি ব্যবস্থা ও বিস্তারিতভাবে প্রার্থী ও পোলিং এজেন্টদের করণীয় ও আইনি অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এসব সংস্কার, সংযোজন ও বিয়োজন এবং সংলাপে অংশগ্রহণকারী সব দল ও গোষ্ঠীর মতামত ও সুপারিশের সিদ্ধান্ত একটি প্রকাশনী আকারে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জানুয়ারি ২০১২ সালে প্রকাশ করার পর সব মন্ত্রণালয়সহ অন্য সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের অফিসে বিতরণ করা হয়েছিল এবং সব শরিকের মধ্যেও বিতরণ করা হয়েছিল। দৃশ্যত মনে হয়, প্রায় ছয় বছর অতিবাহিত হলেও এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত তো হয়ইনি, বরং আলোচিত হয়েছে বলেও মনে হয় না। এসব সুপারিশ পরবর্তী পর্যায়ে আলোচিত হলে হয়তো হালের বিতর্কের প্রয়োজন হতো না। এর কারণ ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের কমিশনগুলোর মতো বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের ধারাবাহিকতা না থাকা।
যা-ই হোক, যেমনটা আগেই বলেছি যে আসন্ন নির্বাচন হতে পারে বাংলাদেশের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নির্বাচন। এ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন কমিশনের ভেতরে টিমওয়ার্ক সুদৃঢ় নেতৃত্ব ও আগাম পরিকল্পনার। কারণ, বাংলাদেশের জনসাধারণ যেমন একটা সুস্থ নির্বাচন আশা করে, তেমনি ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে চান। এর জন্য নির্বাচন কমিশনের যা করা প্রয়োজন, তা করার অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতা প্রয়োগের পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়, এমন বিষয়গুলোর সমাধান করার নিমিত্তে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ নির্বাচন কমিশনের আইনি অধিকার। এর জন্য অন্য কারও মুখাপেক্ষী বা ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ, সংবিধানের ধারা ১১৯-এ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শুধু নির্বাচন কমিশনকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং অন্যান্য ধারায় অন্যদের সহযোগী করা হয়েছে মাত্র।