লন্ডন, ৯ সেপ্টেম্বর : ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা ও আনন্দঘন পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো সপ্তম মুসলিম চ্যারিটি রান। শতশত মানুষের অংশগ্রহণে ৯ সেপ্টেম্বর, রোববার পূর্ব লন্ডনের ভিক্টোরিয়া পর্কে এই চ্যারিটি রান অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১১টায় প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ৯টা থেকেই ছুটে আসতে থাকেন কমিউনিটির নানা বয়সের শিশু-কিশোর, তরুণ যুবক ও বয়বৃদ্ধরা। সকলেরই গন্তব্য ছিলো ভিক্টোরিয়া পার্ক। নির্ধারিত স্থানে পৌছলে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে মুসলিম চ্যারিটি রানের মনোগ্রামখচিত স্পেশাল টি-শার্ট দেয়া হয়। মূল প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগে দীর্ঘক্ষণ চলে শরীরচর্চা। ঘড়ির কাটা যখন ১১টায় ছুঁই ছুঁই, তখন সকলেই গিয়ে দাঁড়ালেন স্টার্টিং পয়েন্টে। সোয়া এগারোটা বাজতেই বেজে উঠলো হুইশেল। শুরু হলো ৫ কিলোমিটার দৌঁড়। মাত্র ১৮ মিনিট ৬ সেকেন্ডে পাঁচ কিলোমিটার রুট ঘুরে এসে প্রথম হওয়ার রেকর্ড সৃষ্টি করেন ইরিত্রিয়ান বংশোদ্ভুত বৃটিশ মুসলিম ডেইম ডিবাবা। অন্যান্য বিজয়ীরাও আধঘন্টার আগেই পাঁচ কিলোমিটার পথ ঘুরে আসেন। আর এভাবেই ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও বিভিন্ন চ্যারিটির জন্য মোটা অংকের ফান্ডরেইজ করলেন অংশগ্রহণকারীরা। ২০১২ সালে শুরু হওয়া এই চ্যারিটি রান প্রথম তিন বছর ‘রান ফর ইউর মস্ক’ নামে পরিচালিত হয়। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে কিছু পরিবর্তন এনে ক্যাম্পেইনের নামকরণ করা হয় মুসলিম চ্যারিটি রান। বিগত দিনে শুধু ইস্ট লন্ডন মসজিদের জন্য ফান্ডরেইজ করা হয়। আর মুসলিম চ্যারিটি রান নামকরণের পর থেকে ইস্ট লন্ডন মসজিদের জন্য ফান্ডরেইজিংয়ের পাশাপাশি অন্যান্য চ্যারিটি সংস্থার জন্যও ফান্ডরেইজ করছেন অংশগ্রহণকারীরা। এবার ইস্ট লন্ডন মসজিদসহ ২৬টি চ্যারিটি সংস্থা মুসলিম চ্যারিটি রানে অংশগ্রহণ করে। চ্যারিটিগুলো হলো: ইসলামিক রিলিফ, মুসলিম হ্যান্ডস, হিউম্যান এইড, হেলপিং হিউম্যানিটি, মুনতাদা এইড, হিউম্যান অ্যাপিল, জামিয়াতুল উম্মাহ, হাগস, হিউম্যান কেয়ার ইনিশিয়েটিভ, বাংলাদেশ রিজেনারেশন ট্রাস্ট, গ্লোবাল এইড ট্রাস্ট, লনলি অরফ্যানস, গ্রেনিচ ইসলামিক সেন্টার, ওয়ান নেশন ইউকে, লন্ডন ইস্ট একাডেমী এন্ড আল মিজান স্কুল, হ্যাফস একাডেমী, নিউব্যারী পার্ক মস্ক, সিরিয়া রিলিফ, ফিজিশিয়ান এক্রস কন্টিনেন্ট, এসেক্স কালচারাল এন্ড ইয়ূথ সোসাইটি, লুইশাম ইসলামিক সেন্টার, অরফ্যানস ইন নিড, ইডেন কেয়ার ও সিলেট এইড, মুসলিম রিসার্চ এন্ড ডেভেলাপমেন্ট ফাউন্ডেশন এবং স্পোর্টিং ফাউন্ডেশন ইউকে। চ্যারিটি রানে অংশগ্রহণকারীদের ৫টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ৫ বিজয়ীদেরকে পুরষ্কার প্রদান করা হয়। এর মধ্যে অনুর্ধ ১২ বছর বয়স ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হন মোহাম্মদ ইউসুফ রাফিক। তিনি মাত্র ২৮ মিনিট ২০ সেকেন্ডে পাঁচ কিলোমিটার রুট ঘুরে আসেন। তাছাড়া ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়স ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হন রেদওয়ান ইয়াকুব। তিনি ২০ মিনিট ২০ সেকেন্ডের মধ্যে প্রতিযোগিতা শেষ করেন। এরপর ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়স ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হন রায়হানুল হক। তিনি ২০ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে ৫ কিলোমিটার দৌড় সম্পন্ন করনে। ২৫ থেকে ৩৪ বয়স ক্যাটারিতে বিজয়ী হন ডেইন ডিবাবা। তিনি ১৮ মিনিট ৬ সেকেন্ডে প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হন। ৩৫ থেকে ৫০ বছর ক্যাটাগরীতে কাশিম চৌধুরী বিজয়ী হন। তিনি ২১ মিনিট ১২ সেকেন্ডে দৌড় সম্পন্ন করেন। তাছাড়া সর্বশেষ ক্যাটাগরি ৫১ ও ততোর্ধ বয়স ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হন সানু মিয়া। তিনি ২৩ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে দৌড় সম্পন্ন করেন। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ীদের প্রত্যেকের হাতে মুসলিম চ্যারিটি রানের মনোগ্রামখচিত ক্রিস্টাল ট্রফি তুলে দেয়া হয়। ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও লন্ডন মুসলিম সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক দেলওয়ার হোসাইন খানের উপস্থাপনায় পুরষ্কার বিতরনী পর্বে বক্তব্য রাখেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়র জন বিগস, ডেপুটি মেয়র কাউন্সিলার সিরাজুল ইসলাম, ইস্ট লন্ডন মসজিদের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, সেক্রেটারি আইয়ুব খান, ইমাম ও খতীব শায়েখ আব্দুল কাইয়ূম, নিউহ্যাম কাউন্সিলের ডেপুটি স্পীকার ব্যারিস্টার নাজির আহমদ, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাপ্তাহিক জনমত সম্পাদক নবাব উদ্দিন, রেডব্রিজ কাউন্সিলের কাউন্সিলার মোঃ জামাল উদ্দিন প্রমুখ। এ সময় সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে নির্বাহী মেয়র জন বিগস মুসলিম চ্যারিটি রানের মাধ্যমে কমিউনিটির বিভিন্নস্তরের মানুষকে ভালোকাজে সমবেত করার জন্য ইস্ট লন্ডন মসজিদ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এই চ্যারিটি রানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একদিকে যেমন মানুষ শরীরচর্চা উদ্ধুদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যারিটি সংস্থার জন্য ফান্ডরেইজ করতে পারছে। এ বছর ২৬টি চ্যারিটি সংস্থা এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছে জেনে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছি। সিরিয়ার মানুষের দুর্দশার কথা আমরা জানি। সিরিয়ার জন্য ফান্ডরেইজ করতে সিরিয়া রিলিফ অংশগ্রহণ করেছে। আমি আশাবাদী এই চ্যারিটি রানের সংগৃহিত অর্থ নির্যাতিত মানুষের হাতে পৌছে দেবে। তিনি বলেন, শুরু থেকেই মুসলিম চ্যারিটি রানকে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল সাপোর্ট করে আসছে। আগামীতে কাউন্সিলের তরফ থেকে সবধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, আমি প্রতিদিনই প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ হাঁটি। তাই আজকের চ্যারিটি রানে দৌড়ানো হয়নি। আগামী বছর অংশগ্রহণের আশাবাদী। ডেপুটি মেয়র সিরাজুল ইসলাম এ ধরনের উৎসবমুখর একটি কর্মসূচি ৭ বছর ধরে নিয়মিত পরিচালনার জন্য ইস্ট লন্ডন মসজিদকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, যুব সমাজকে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে এই কর্মসূচি বিরাট ভুমিকা রাখছে। তিনিও আগামী বছরগুলোতে আয়োজিত চ্যারিটি রানে কাউন্সিলের পক্ষ থেকে সবধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আমাদের পাশ্ববর্তী বারা নিউহ্যাম, রেডব্রিজ এবং বার্কিং এন্ড ডেগেনহ্যামের অনেক কাউন্সিলারই আজকের চ্যারিটি রানে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁদের প্রতি আমাদের আহবান থাকবে, আপনারাও নিজ নিজ এলাকায় বছরে একটি চ্যারিটি রান আয়োজন করবেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আগামী বছর পাশ্ববর্তী বারাগুলোতে অন্তত দুইটি চ্যারিটি রান দেখতে চাই। ইস্ট লন্ডন মসজিদের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান মুসলিম চ্যারিটি রানে অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এই রান কমিউনিটির মানুষের একটি বার্ষিক মিলন মেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিটির মানুষের সহযোগিতায় আগামীতে আরো সম্প্রসারিত হবে ইনশাল্লাহ। ইস্ট লন্ডন মসজিদের সেক্রেটারি আইয়ূব খান সমাপনী বক্তব্যে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মুসলিম চ্যারিটি রান কমিউনিটির জন্য একটি আনন্দঘন কর্মসূচি। এ বছরের আবহাওয়া ছিলো দৌঁড়ের জন্য যথোপযুক্ত। খুব গরম নয়, আবার ঠাণ্ডাও নয়। অনেকেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পার্কে এসেছেন। আনন্দ উপভোগ করেছেন। এটা আমাদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। তিনি বলেন, প্রথম দিকে এই ক্যাম্পেইন শুধু ইস্ট লন্ডন মসজিদের ফান্ডরেইজিংয়ের জন্য শুরু হলেও এখন এটার পরিধি অনেক বেড়েছে। শুধুমাত্র ২০ পাউন্ডের একটি এডমিন ফি প্রদান করে প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের পছন্দের চ্যারিটির জন্য ফান্ডরেইজ করতে পারছেন। ইস্ট লন্ডন মসজিদ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি কমিউনিটির মানুষকে একিভূত করে আনন্দ উপভোগের সুযোগ করে দিয়েছে। এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে আমরা একদিকে যেমন মসজিদের জন্য ফান্ডরেইজ করতে পারছি, অপরদিকে আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উদ্ধুদ্ধ হচ্ছি। মুসলিম চ্যারিটি রান আমাদের ইহকাল ও পরকালের জন্য কল্যাণ বয়ে আনছে। ইস্ট লন্ডন মসজিদের ইমাম ও খতীব শায়খ আব্দুল কাইয়ূম এর মোনাজাতের মধ্য দিয়ে পুরস্কার বিতরনী পর্বের সমাপ্তি ঘটে। সাত বছর যাবত মুসলিম চ্যারিটি রান সফলতার সাথে আয়োজনের জন্য চ্যারিটি রানের মূল অর্গানাইজার, ইস্ট লন্ডন মসজিদের সিনিয়র ফান্ডরেইজিং অফিসার তজম্মুল আলীকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানানো হয়। উল্লেখ্য, এ বছর মুসলিম চ্যারিটি রান স্পনসর করে হিউম্যান এইড ইউকে, মুসলিম চ্যারিটি, মুসলিম এইড, সিরিয়া রিলিফ, হিউম্যান অ্যাপিল, ডায়মন্ড জুয়েল, দ্যা সোসাইটি অব বৃটিশ-বাংলাদেশী সলিসিটর্স, মুসলিম হ্যান্ডস, ইডেন কেয়ার, হিউম্যান রিলিফ ফাউন্ডেশন, মুনতাদা এইড, ইসলামিক রিলিফ, পেনি অ্যাপিল, আইস হট মার্সেনডাইস, বামফোর্ড ট্রাস্ট লিমিটেড, মুসলিম গিভিং চ্যারিটি সংস্থা। মিডিয়া পার্টনার ছিলো চ্যানেল এস, ঈমান চ্যানেল, টিভি ওয়ান ও ইক্বরা বাংলা।
উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো সপ্তম মুসলিম চ্যারিটি রান
Advertisement