শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী :: শান্তি, সম্প্রীতি, মৈত্রী, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম। মানবতার জন্য ইসলাম। সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের জন্য ইসলাম। মহানবী (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আগমনের পর দ্বিতীয় হিজরিতে কুরাইশরা মদিনা আক্রমণ করলে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে চরমভাবে পরাজিত হলেও পঞ্চম হিজরি সনের ১৫ শাওয়াল শনিবার তারা প্রায় পাঁচ শ কিলোমিটার দূরে এসে পুনরায় মদিনা আক্রমণ করে, সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ওহুদের যুদ্ধ। ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে নবীজি (সা.) ওমরাহর উদ্দেশ্যে মক্কা যাত্রা করলেন। কুরাইশরা বাধা দিলে হজরত মুহাম্মদ (সা.) হুদায়বিয়া নামক জায়গায় অবস্থান করেন। এখানেই সম্পাদিত হয় ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে বিখ্যাত বিশ্বের প্রথম লিখিত সন্ধি চুক্তি।
এ সন্ধি অনুযায়ী মক্কার ‘বনু খোজা’ সম্প্রদায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর সঙ্গে এবং ‘বনু বকর’ সম্প্রদায় কুরাইশদের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করে। এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পূর্বশত্রুতা ছিল। কুরাইশদের প্ররোচনায় বনু বকর গোত্রের আবাসভূমি ‘ওয়াতির’–এর নিভৃত পল্লিতে রাতের অন্ধকারে অতর্কিত হামলা করে অসহায় নারী, শিশুসহ নির্বিচারে হত্যা ও লুণ্ঠন করে। প্রাণের ভয়ে কাবায় আশ্রয় নেওয়া নিরীহ মানুষকেও তারা হত্যা করে। এ ঘটনার প্রতিকারের জন্য খোজা সম্প্রদায় মদিনার মিত্র মুসলমানদের সহযোগিতা চায়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতিকারের জন্য দূত মারফত মক্কার কুরাইশ নেতাদের জানালেন, তোমরা বনি খোজা গোত্রকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাও; নয়তো বনু বকর গোত্রের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি বাতিল করো, না হলে হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন হয়েছে বলে এ চুক্তি বাতিল হয়েছে বলে পরিগণিত হবে। কুরাইশ নেতারা তৃতীয় পন্থাই গ্রহণ করলেন।
অষ্টম হিজরিতে বিশ্বমানবতার কেন্দ্রভূমি মক্কা পঙ্কিলতামুক্ত করার জন্য বিশ্বনবী নীরব আয়োজন করলেন। তিনি ধ্বংযজ্ঞ চান না, তিনি কুরাইশদের রক্ষা করতে চান। তিনি চান প্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ১০ রমাদান ১০ হাজার সাহাবিসহ মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। মক্কার উপকণ্ঠে এসে ‘মারাউজ জাহরান’ নামক গিরি উপত্যকায় তাঁবু স্থাপন করলেন। ১৯ রমাদান রাতে আবু সুফিয়ান হাকিম ইবনে নিজাম ও বুদাইলকে সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধানে বের হলে হজরত ওমর (রা.)–এর নেতৃত্বে টহলরত ছদ্মবেশী গেরিলা সাহাবি দলের হাতে বন্দী হয়ে নবীজি (সা.)–এর কাছে আনীত হন। দীর্ঘ ২১ বছরের নিষ্ঠুরতার পুরোহিত আবু সুফিয়ানকে রহমতের নবী (সা.) প্রেম–ভালোবাসার দীক্ষা দিলেন, পাষাণ হৃদয় দয়ার সাগরে স্নাত হলো; তিনি ইমান আনলেন।
আল্লাহর হাবিব (সা.) মক্কা জয়ের আগেই মক্কাবাসীদের মন জয় করাকে বড় বিজয় মনে করলেন। এ সময় নবীজির চাচা হজরত আব্বাস (রা.), যিনি কৌশলগত কারণে মক্কাবাসীদের কাছে তাঁর ইসলাম গ্রহণ গোপন রেখেছিলেন, তিনিও তা প্রকাশ করলেন। এ উভয় কুরাইশ নেতাকে নবীজি (সা.) শান্তির পয়গাম ঘোষণার জন্য প্রভাতে মক্কায় পাঠালেন এবং ঘোষণা দিতে বললেন: ‘যারা কাবাগৃহে আশ্রয় নেবে, তারা নিরাপদ; যারা আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে বা তঁার নাম বলবে, তারা নিরাপদ; যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে, তারাও নিরাপদ।’
১৯ রমাদান সকালে নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কিরামের বিভিন্ন দলকে মক্কার বিভিন্ন দিক থেকে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, কাউকে আক্রমণ করবে না। ইতিপূর্বে ‘মুতা’ অভিযানেও তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, কোনো সাধু–সন্ন্যাসীকে হত্যা করবে না, বালক–বালিকা ও শিশুদের হত্যা করবে না, নারীদের হত্যা করবে না, বৃক্ষনিধন করবে না, শস্যক্ষেত্র ধ্বংস করবে না, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করবে না এবং আত্মসমর্পণকারীকে আঘাত করবে না।
মহানবী (সা.) ক্রীতদাস উসামা ইবনে জায়েদের সঙ্গে উটে চড়ে অবনত মস্তকে সবার শেষে মক্কায় প্রবেশ করলেন। হজরত (সা.) মক্কাবাসীদের নিয়ে একটি সভা করলেন। তিনি ভাষণে সাম্য, মৈত্রী ও একতার কথা বললেন: ‘হে কুরাইশগণ! অতীতের সকল ভ্রান্ত ধারণা মন থেকে মুছে ফেলো, কৌলীন্যের গর্ব ভুলে যাও, সকলে এক হও। সকল মানুষ সমান, এ কথা বিশ্বাস করো। আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলকেই এক নারী ও পুরুষ হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদিগকে গোত্রে ও শাখায় পৃথক করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই বেশি সম্মানিত, যে বেশি পরহেজগার।”’ (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)।