ওমিক্রন: অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ?

          Dr. Zaki Rezwana Anwar FRSA

২০২১ সালের নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই বিজ্ঞানীদের মহলে তিনটি প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছিল।
প্রথম প্রশ্ন ছিল, এই ভ্যারিয়্যান্টের transmissibility বা সংক্রমণের ক্ষমতা কেমন। ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের আগে যে চারটি ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন ছিল সেই চারটিতে যে মিউটেশনগুলো ছিল তার সবগুলোই এই ওমিক্রনে রয়েছে। তাই যখন আমি দেখেছি যে ওমিক্রনে ডেল্টা ভ্যারিয়্যান্টের মিউটেশনগুলো রয়েছে তখনই ধারণা করেছিলাম যে ওমিক্রনের সংক্রমণের ক্ষমতা কম হবেনা, বেশীই হবে। প্রাথমিক ড্যাটাও সে রকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে এখন।
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, এই ভ্যারিয়্যান্টের vaccine evasion ক্ষমতা থাকবে কিনা। অর্থাৎ যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাদের দেহে ওমিক্রন ঢুকতে পারবে কিনা। এরই মধ্যে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে যারা ভ্যাকসিন নেননি কিন্তু আগে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন এবং যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন — উভয়ের ক্ষেত্রেই ওমিক্রন আবার তাদের আক্রমণ করতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে , রোগে ভুগে তৈরী হওয়া এন্টিবডি বা ভ্যাকসিন দিয়ে তৈরী এন্টিবডিকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা ওমিক্রনের রয়েছে। [* এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে রাখা প্রয়োজন তা হচ্ছে, ওমিক্রন আংশিকভাবে বা সম্পূর্ণভাবে এন্টিবডিকে ফাঁকি দিলেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে সবার ভ্যাকসিন নেওয়া আবশ্যক – সে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো কি কি তা আমি আমার পরবর্তী কলামে ব্যাখ্যা ক’রে লেখার ইচ্ছে রাখি]
তৃতীয় প্রশ্নটি ছিল, ওমিক্রন কতটা virulent বা এই ভ্যারিয়্যান্টের ভয়াবহতা কেমন, এই ভ্যারিয়্যান্ট দ্বারা আক্রান্ত হলে রোগী কতটা কাবু হতে পারে বা মৃত্যুর ঝুঁকি কেমন হতে পারে। এ বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ার একটি হাসপাতালে পরিচালিত  গবেষণার ফলাফল (যে ফলাফলের সাথে আশেপাশের হাসপাতালগুলোর ফলাফলের সামঞ্জস্য রয়েছে) আমরা পেয়েছি — বিচক্ষণতার সাথে সেটির বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
দক্ষিণ আফ্রিকার মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের প্রকাশিত এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে ১৪ ই নভেম্বর থেকে ২৯শে নভেম্বরের মধ্যে। ঐ সময়ে  ঐ অঞ্চল যার জনসংখ্যা দুই মিলিয়নের বেশী সেখানে প্রায় ৪৩ হাজার মানুষের মধ্যে এই ভ্যারিয়্যান্ট শনাক্ত করা হয়েছিল। আমার ধারণা যেহেতু ঐ অঞ্চলের অনেককেই পরীক্ষা করে ভ্যারিয়্যান্ট শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি বা হওয়ার কথাও নয় তাই সংক্রমিত মানুষের আসল সংখ্যা এর শনাক্ত হওয়া রোগীদের চাইতে বহু গুণে বেশী। এই ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়েছে এ অঞ্চলের sewage water পরীক্ষা করার পর যখন জানা গেল যে ওমিক্রনের আসল সংক্রমণ কত বহু গুণে বেশী! এখানে বলা বাহুল্য ওমিক্রনে আক্রান্তদের দেহ থেকে বের হওয়া মানব কোষ থেকে নি:সরিত একটি এসিড sewage water এ গেলে sewage water থেকে বোঝা যায় ঐ অঞ্চলে সংক্রমণের হার কেমন। যেসব দেশে ঢালাও ভাবে টেষ্ট করা সম্ভব নয় সেখানে ওমিক্রনের মাত্রা বোঝার জন্যে অল্প ব্যায়ে এটি একটি ভাল ইন্ডিকেটর।
প্রিটোরিয়ার হাসপাতালে ১৪ থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ১৬৬ জন কোভিড রোগী ভর্তি ছিল। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, ঐ ১৬৬ এর ৭০% এর বেশী রোগী কোভিডে নয়, অন্য কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এবং হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের উপর পরীক্ষা করায় কভিড ধরা পড়েছিল। এছাড়াও জানা যায় ঐ সময় কালের মধ্যে  কভিড ইউনিটে থাকা ৪২ জন কোভিড রোগীদের মধ্যে বেশীরভাগ রোগীকেই অক্সিজেনের উপর নির্ভর করতে হয় নি। বেশীরভাগ রোগীর room air বা অক্সিজেন ছাড়া হাসপাতালের কামরা মধ্যের বাতাসেই শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক ছিল । দক্ষিণ আফ্রিকার আগের তিনটি  ওয়েভের প্রত্যেকটিতেই এর চাইতে অবস্থা খারাপ ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রন জনিত চতুর্থ ঢেউয়ে হাসপাতালে এ পর্যন্ত রোগীদের থাকতে হয়েছে ২.৮ দিন আর ডেল্টা জনিত ঢেউয়ের সময় রোগীদের হাসপাতালে গড়ে থাকতে হয়েছিল ৮.৫ দিন। তবে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে তরুণ ও শিশুরা রয়েছে যার অবশ্য বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
যে গবেষণার কথা উল্লেখ করলাম সেরকম চলতে থাকলে ধারণা করা যেতে পারে যে ওমিক্রনের ভয়াবহতা হয়তো এতটা হবে না, তবে এখানে একটি জরুরী বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে – hospitalisation এবং death শুধুমাত্র একটি ভ্যারিয়েন্টের virulence বা ভয়াবহতার উপর নির্ভর করে না। Hospitalisation ও death ভ্যারিয়্যেন্টের ভয়াবহতা ছাড়াও একটি দেশের (১) ভ্যাকসিন আপটেক, (২) সে দেশের জনসংখ্যা পিরামিড (কোন্ বয়সের মানুষের সংখ্যা কেমন),  (৩) ঐ দেশের baseline infection rate ( ঐ দেশে নতুন ভ্যারিয়্যান্টের আবির্ভাবের ঠিক আগে বিদ্যমান সংক্রমণের হার কেমন), (৪) ঐ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নতুন ঢেউ মোকাবেলা করতে কতটা প্রস্তুত — এ সব কিছুর উপর নির্ভর করে। তার উপর আমাদের কিন্তু এখনো ডেল্টার ধাক্কা সামাল দেওয়াই খুব সহজ কাজ বলে বিবেচিত হচ্ছে না।
সবশেষে এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে,  hospitalisation বা death এর হিসেবটা শতকরার হিসেবে যদি খুব কমও মনে হয়, কিন্তু যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে অনেক লোক একসাথে আক্রান্ত হয় তখন প্রকৃত সংখ্যায় এর পরিমাণ দাঁড়াবে অনেক। মনে রাখা প্রয়োজন, একশত জনের ০.১% যতজন এক মিলিয়নের ০.১% কিন্তু ততজন নয়। সে অবস্থাতে বহু উন্নত দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পক্ষেও সে ভার বহন করা সম্ভব হয় না — এ কথা বর্তমান ডেল্টা ভ্যারিয়্যান্টের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।।
লেখক : Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA একজন চিকিৎসক, সংবাদ পাঠক ও কলামিস্ট।
Advertisement