বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সে গবেষণার স্বপ্ন ছিল অনেক আগে থেকেই। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের বড় অনুপ্রেরণা আসে যখন ব্র্যাক বিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগ থেকে ২০১৮ সাথে ১ম স্থান অধিকার করে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করি এবং সমাবর্তনে ‘ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হই। এরপর ২০১৯ সালেই চলে আসি জার্মানির কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল লাইফ সায়েন্সে মাস্টার্স করতে। ক্যানসার গবেষণায় কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয় জার্মানির অন্যতম প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয় হসপিটালের (UKSH) গাইনোকলজি বিভাগে ক্যানসারের ওপর থিসিসের কাজ করছি। এ ছাড়া ২০২০ সালে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত অবস্থায় জার্মান সরকারের শিক্ষা ও গবেষণা বৃত্তি ‘ডয়েচল্যান্ডস্টিপেন্ডিয়াম’-এর জন্য নির্বাচিত হই। জার্মানিতে পড়াশোনা, গবেষণা ও বৃত্তি নিয়ে এভাবেই বিস্তারিত জানিয়েছেন কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত ও ওভারিয়ান ক্যানসারে গবেষণারত শিক্ষার্থী রায়হানাতুল আনোয়ার।
গবেষণার বিষয়বস্তু ও অভিজ্ঞতা
ওভারিয়ান ক্যানসার বেশ ভয়াবহ রোগ এবং এতে মৃত্যুর ঝুঁকি অত্যধিক। প্রতি ৭৮ জনে একজন নারী ওভারিয়ান ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে। এই ক্যানসার চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় বাধা কেমোথেরাপি কাজ না করা এবং ক্যানসার পুনরায় ফিরে আসা। আমাদের ল্যাবে কেমোথেরাপির কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে। ক্যানসার কোষ বৃদ্ধির জন্য দায়ী রিসেপ্টরের কার্যকারিতা কমিয়ে কেমোথেরাপির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করাই মূল উদ্দেশ্য। এই লক্ষ্যে ল্যাবে একটি প্রাথমিক পরীক্ষা শেষ করে হসপিটাল থেকে সরাসরি ক্যানসার রোগীর নমুনা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা সত্যিই এক দারুণ অভিজ্ঞতা। এই ল্যাবে থিসিস শুরু করার আগে আমি অন্য ল্যাবে বায়োমলিকুলার বিষয়ের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করার সময় প্রশিক্ষণ লাভ করি যা এখনকার গবেষণা এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে। এ ছাড়া আমার গবেষণায় প্রথম হাতেখড়ি হয় বাংলাদেশে ব্যাচেলর করার সময়। সহ-লেখক হিসেবে আমার দুইটি পাবলিকেশন বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। তবে ক্যানসার গবেষণায় আমি এখনো নতুন, এই বিষয়ে ভবিষ্যৎ পেশাজীবনের আরও অনেক দূর যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
গবেষণার সুযোগ
বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণায় জার্মানি বিশ্বের স্বনামধন্য কয়েকটি দেশের একটি। এ দেশের উচ্চশিক্ষা গবেষণানির্ভর। বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও এখানে আছে ম্যাক্সপ্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট, ফ্রেনহফার, হামবোল্টসহ বিশ্বের নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানে মাস্টার্সে পড়ার সুযোগ বেশি আবার কোনোটাতে পিএইচডির সুযোগ বেশি। জার্মানিতে পড়াশোনার আরেকটি বিশেষত্ব হলো এখানে তত্ত্বীয় জ্ঞান ও ব্যবহারিক জ্ঞান উভয় অর্জন করা যায় একসঙ্গেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে যেকোনো শিক্ষার্থীর হতে পারে গবেষণায় হাতেখড়ি।
জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা ও তথ্য
মাস্টার্সে পড়াশোনার জন্য জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইংরেজি ভাষায় অনেক কোর্স অফার করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য সাধারণভাবে নিম্নোক্ত যোগ্যতা ও কাগজপত্র প্রয়োজন হবে।বাংলাদেশের স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং সিজিপিএ ন্যূনতম ৩। ভালো রেজাল্ট অবশ্যই ভর্তিতে এবং ভবিষ্যৎ বৃত্তির আবেদনে সহযোগিতা করবে।ইংরেজির দক্ষতা প্রমাণের জন্য আইইএলটিএস। বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ৬.৫ থেকে ৭.৫ পর্যন্ত স্কোর প্রয়োজন হতে পারে।
মোটিভেশন লেটার
ইউরোপিয়ান রীতির সিভি (ইউরোপাস)
কিছু ক্ষেত্রে রেফারেন্স লেটার
এ ছাড়া সহ-পাঠ্যক্রমিক সংশ্লিষ্টতা ও গবেষণার কিছু অভিজ্ঞতা ভর্তি ও বৃত্তি উভয় ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে।
জার্মানিতে পড়াশোনার বিষয়ে সব প্রয়োজনীয় তথ্য Daad. de এই ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। সাধারণত জানুয়ারির ১৫ তারিখ ও জুন-জুলাই যথাক্রমে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন সেমিস্টারে জন্য আবেদনের শেষ সময়।
জার্মানিতে কী কী বৃত্তি পাওয়া যায়
জার্মানিতে উচ্চশিক্ষায় আসার অন্যতম বড় সুবিধা হলো এখানে অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি দিতে হয় না। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের জীবনধারণের খরচ বহন করার জন্য আছে বিভিন্ন স্কলারশিপ যেমন ডাড স্কলারশিপ। এই স্কলারশিপের জন্য ওপরের ভর্তি অভিজ্ঞতার সঙ্গে লাগবে দুই বছরের কাজের অভিজ্ঞতা। ইউরোপের আরেকটি বিখ্যাত ইরাসমুস মুনডাস বৃত্তি। এই বৃত্তির মাধ্যমে ইউরোপের ক্রমান্বয়ে তিনটি দেশে পড়াশোনার সুযোগ হয়েছে। erasmus-plus. ec. europa. eu ওয়েবসাইটে বৃত্তি সম্পর্কিত তথ্য দেওয়া আছে। এ ছাড়া জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে এমন শিক্ষার্থীদের জন্য আছে জার্মান সরকারের শিক্ষা ও গবেষণা বৃত্তি ‘ডয়েচল্যান্ডস্টিপেন্ডিয়াম’।
‘ডয়েচল্যান্ডস্টিপেন্ডিয়াম’ আবেদন প্রক্রিয়া
ডয়েচল্যান্ডস্টিপেন্ডিয়াম মূলত ইতিমধ্যে জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এমন শিক্ষার্থীদের জন্য। মেধা বা যোগ্যতার ভিত্তিতে এই বৃত্তিটি দেওয়া হয়। বৃত্তির অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে কম-বেশি হতে পারে এবং প্রাথমিকভাবে এটি এক বছরের জন্য প্রদান করা হয়। সল একাডেমিক সনদপত্র ছাড়াও এই বৃত্তির আবেদনে সিভি, কভার লেটার প্রয়োজন হবে। এই বৃত্তির তথ্যবলি স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ অংশে দেওয়া থাকে।
গবেষণায় আগ্রহী বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য পরামর্শ
বাংলাদেশে অনেক শিক্ষার্থীর আগ্রহ থাকলেও মৌলিক গবেষণার সুযোগ বেশ কম। ভবিষ্যতে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা বা গবেষণার ইচ্ছে থাকলে ব্যাচেলরের তৃতীয় বর্ষ হতে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। কোনো রিসার্চ প্রজেক্টে যদি যুক্তি থাকা যায় ভালো। এ ছাড়া গবেষণায় একাগ্রতার বিকল্প নেই। ল্যাবের বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট ও রিপোর্টের জন্য আমাদের প্রচুর পাবলিকেশন পড়তে হয়, এই অভ্যাসও ধীরে ধীরে করা উচিত। এ ছাড়া দেশের বাইরে এসে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয়ে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টের জব বা কোনো কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপ করে পাওয়া যেতে পারে ল্যাবে কাজ করার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা।