আসজাদুল কিবরিয়া :: মজুরিকাঠামো ঘিরে তৈরি পোশাকশিল্প খাতের শ্রমিকদের বিক্ষোভ-প্রতিবাদ আপাতত শেষ হয়েছে। নামমাত্র মজুরির হার সংশোধনের পাশাপাশি সরকার ও মালিকপক্ষের কঠোর অবস্থান শ্রমিকদের কারখানায় ফিরে যেতে বাধ্য করেছে। এই আন্দোলনের কিছু মূল্যও গুনতে হচ্ছে তাঁদের। কিছু শ্রমিকের কাজ খোয়া গেছে, কিছু শ্রমিক আছেন পুলিশি হয়রানিতে। আর বাকিরা ভবিষ্যতে কর্মচ্যুতির হুমকি মাথায় নিয়ে ন্যূনতম জীবিকার তাগিদে উদয়াস্ত খেটে যাচ্ছেন। অথচ এমন পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত ছিল না, এখনো নয়। তারপরও হয়েছে। এটা যেন তৈরি পোশাক খাতে অনিবার্য হয়ে গেছে।
দেশে আরও অনেক শিল্প খাত রয়েছে, সেখানেও মজুরি নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ কমবেশি আছে। কিন্তু বৃহত্তম রপ্তানি খাত এবং ৪০ লাখ শ্রমিকের কাজের স্থান হওয়ায় তৈরি পোশাক খাতে সামান্য ক্ষোভ-অসন্তোষই অনেক বড় হয়ে দেখা দেয় এবং দ্রুত নজরে চলে আসে। এই খাতের ন্যূনতম মজুরি এখন আট হাজার টাকা, যেখানে বস্ত্র খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক মজুরির হার ৫ হাজার ৭১০ টাকা। এ খাতে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। আবার ওষুধশিল্প খাতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার ৫০ টাকা আর কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ। সুতরাং, নিম্নমজুরি নিয়ে সমস্যাটা এককভাবে পোশাক খাতে নয়।
আসলে শ্রমিকদের মজুরিজনিত সমস্যার অন্যতম কারণ হলো শ্রমনীতিকে বিভিন্নভাবে উপেক্ষা করা। জাতীয় শ্রমনীতিতে মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘ন্যায্য মজুরি’র ওপর সুস্পষ্টভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে শ্রমিক ও তাঁর পরিবার যেন মানসম্মত জীবন ধারণ করতে পারেন এবং সেই জীবনধারণ–উপযোগী ন্যায্য মজুরি যেন শ্রমিক পান, সরকার সেই ব্যবস্থা করবে। তার মানে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার দায়িত্বটা সরকারের। ন্যায্য মজুরি কী, তা নিয়ে কূটতর্ক হতে পারে। তবে জীবনধারণের ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম মজুরি আর যা–ই হোক ন্যায্য হতে পারে না। অথচ দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো শিল্প খাতে যে ন্যূনতম মজুরি আছে, তা জীবনধারণের মজুরির চেয়ে অনেক কম। অবশ্য যাঁরা মাত্র কাজে ঢুকেছেন বা বছরখানেক কাজ করেছেন, স্বাভাবিকভাবে তাঁরাই সবচেয়ে কম মজুরি পান। তাঁদেরই ন্যূনতম মজুরিকাঠামোর একেবারে নিচের ধাপে থাকতে হয়। ফলে তাঁরা জীবনধারণের মজুরির চেয়ে কম মজুরি পেয়ে থাকেন, এটাই বাস্তবতা। যেসব শ্রমজীবী কয়েক বছর বা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে আসছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে অবশ্য এই সমস্যা থাকে না।
শ্রমনীতিতে ন্যায্য মজুরির পাশাপাশি মজুরির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য প্রণোদনামূলক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে—এ রকম পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই। মজুরি বিতর্কে এ বিষয়টি প্রায়ই হারিয়ে যায় বা অনুপস্থিত থাকে। ফলে প্রকৃত মজুরির চিত্রটিও পরিষ্কার হয় না। নগদ টাকা মজুরি পাওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকদের আরও যেসব ন্যায্য ও বৈধ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা, সেসব কতটা মিলছে বা মিলছে না, তা চিহ্নিত করাও জরুরি। বলা দরকার যে বাংলাদেশের একটি লিখিত ও অনুমোদিত শ্রমনীতি আছে। এটির আনুষ্ঠানিক শিরোনাম ‘জাতীয় শ্রমনীতি, ২০১২’। শ্রমনীতির লক্ষ্য হলো, ‘বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সকল কর্মক্ষম নাগরিকের জন্য উৎপাদনমুখী, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, শোভন, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সকল ক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার ও শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা।’
অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের চেয়ে বেশি মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও অস্বীকার করা কঠিন যে ‘শোষণমুক্ত, শোভন, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ’ এখনো অনেক দূরে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এরপর গত পাঁচ বছরে দেশের পোশাক কারখানাগুলোয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও কাজের পরিবেশ উন্নত করায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। পাশাপাশি শুধু তৈরি পোশাক খাতই নয়, আরও অনেক খাতের বেশ কিছু শিল্পকারখানায় এসবের ঘাটতি এখনো রয়েছে, যা বিভিন্নভাবে দৃশ্যমান হয়। শ্রম মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর দেশের ৩২ হাজার ৯২৪টি শিল্পকারখানা পরিদর্শন করেছে এবং এগুলোর মধ্যে ৬ হাজার ৯৮৫টি কারখানায় শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে; যেগুলো কিনা কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকৃত কারখানা ও প্রতিষ্ঠান। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৬৫। তার মানে কাজের পরিবেশ উন্নত এমন কারখানার সংখ্যা বাড়ছে, যদিও এর হার এখনো দেশের মোট কলকারখানার এক-পঞ্চমাংশ। বিষয়টাকে অবশ্য হতাশাজনকভাবে দেখার কিছু নেই। শ্রমনীতিতে শোভন কাজকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন শ্রমজীবী মানুষের কাজকে ধীরে ধীরে শোভন পর্যায়ে উন্নীত করতে সরকারকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
শ্রমনীতিতে শ্রমিক সংঘ কিংবা শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠন, এর মাধ্যমে মালিকপক্ষ ও সরকারের সঙ্গে দর–কষাকষি এবং ত্রিপক্ষীয় সংলাপকে উৎসাহিত করার জন্য সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতা হলো শ্রমিক সংঘ বা ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রম ক্রমে সংকুচিত ও বিকৃত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক সংঘ একাধারে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এর কার্যকারিতা হারিয়েছে। আর বেসরকারি খাতের শিল্পকারখানায় মালিকেরা শ্রমিক সংঘ নিয়ে মোটেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতায়। ফলে শ্রমিক সংঘ আর শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে ও উৎপাদশীলতা রক্ষায় তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
বাংলাদেশের জাতীয় শ্রমনীতি মোটামুটিভাবে ভারসাম্যপূর্ণ, বাস্তবানুগ ও শ্রমিকবান্ধব। তবে এটি কোনো অবশ্যপালনীয় আইন নয়; বরং বৃহত্তর দিকনির্দেশনার এক দলিল। এই দিকনির্দেশনার বাস্তবায়ন ঘটে শ্রম আইন ও বিধিমালার মাধ্যমে। আবার শ্রম আইন প্রয়োগে ও সংশোধনে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে, যা কমাতে শ্রমিক-মালিক-সরকার তিন পক্ষেরই ইতিবাচক তৎপরতা দরকার। তাহলে শ্রমনীতি আর অতটা উপেক্ষিত হবে না।