তাত্ত্বিকভাবে হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং-উনের বৈঠকটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কূটনৈতিকভাবে প্রতীকী এক পরাজয়ের মুহূর্ত। যুক্তরাষ্ট্র সাত দশক যাবৎ দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারকে কোরীয় উপদ্বীপের বৈধ প্রতিনিধি বিবেচনা করেছে। এত দিন পিয়ংইয়ংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ দেখাশোনা করত সুইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ৬২ শতাংশ, গত বছর আগস্টেও এক জরিপে উত্তর কোরিয়ার ওপর সামরিক পদক্ষেপের পক্ষে বলেছে এবং ৭৫ শতাংশ চাইছিল, ট্রাম্প যেন দেশটির বিরুদ্ধে অবরোধ আরও তীব্র করেন। এসবই ছিল যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে দশকের পর দশক ধরে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে চলমান প্রচারযুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক পরিণতি। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব এভাবেই কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য নিজ করদাতাদের মনোজগৎ প্রস্তুত করে। ফলে সেই নাগরিকদের পক্ষে টিভির পর্দায় এটা দেখা কিছুটা হলেও বিস্ময়কর যে কিম জং-উনকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করছেন তাঁদের প্রেসিডেন্ট এবং যত দূর মনে হচ্ছে, কিমকে এও কথা দিয়ে এসেছেন ট্রাম্প, পিয়ংইয়ংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস খোলা হবে। আর কিমকে যে হোয়াইট হাউসেও আমন্ত্রণ জানানো হবে, সে সম্ভাবনার কথাও উচ্চারিত হয়েছে ট্রাম্পের জবানিতে।
বিস্ময়কর যে ওয়াশিংটনের মনোভাবে ভূমিকম্পতুল্য এত সব পরিবর্তন এসেছে কিমকতৃর্ক অল্প কয়েকটি দূরপাল্লার মিসাইল উৎক্ষেপণ এবং পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের পরপরই! এ যেন চীনের সমরবিদ সানজুর পুরোনো সেই প্রবাদ মনে করিয়ে দেয়: ‘যখন সাধারণ পন্থায় রাষ্ট্রনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জন করা যায় না, তখন সামরিক পন্থায় তা লাভ করতে হয়’!
গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়ার ৩৪ বছর বয়সী রাষ্ট্রনায়ক বহুভাবেই গতকাল থেকে প্রচারমাধ্যমের নায়কে পরিণত হয়েছেন। তাঁর বাবা (কিম জং-ইল) ও দাদা (কিম উল-সং) যা পারেননি, উন তা–ই করে দেখালেন। উত্তর কোরিয়ার নিজস্ব ধাঁচের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্ট আলোচনার টেবিলে বসলেন। আবার বৈঠকে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় দলিলে উনকে বহুল আলোচিত মিসাইল প্রযুক্তির উন্নয়ন বন্ধে কোনো অঙ্গীকারও করতে হয়নি ট্রাম্পের কাছে।
উত্তর কোরিয়া ৬ এবং যুক্তরাষ্ট্র ৩
তবে কৌতুকের ছলে হলেও বলতে হয়, কিম জং-উনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ট্রাম্পের সঙ্গে তার বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের চরমভাবে বিভক্ত করে ফেলা। সাধারণভাবে এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এমন বিশ্লেষক পাওয়া বিরল, যিনি ১২ জুনের বৈঠকের ফলাফল পিয়ংইয়ংয়ের পক্ষে যায়নি—এমন কথা বলতে পারেন।
সিঙ্গাপুর থেকে কিমের অর্জনগুলো এ রকম:
এক. পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রকে হামলা থেকে নিবৃত্ত করতে পারা এবং ‘নিরাপত্তা নিশ্চয়তা’ আদায় করা;
দুই. বিশ্বকে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারের পরিবেশে ঠেলে দেওয়া;
তিন. আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেকে এবং দেশকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা;
চার. কোরীয় উপকূলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর অজুহাতকে অকার্যকর করে দেওয়া;
পাঁচ. প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া ত্রয়ীর সামরিক সম্পর্ক বিকাশের বাস্তব শর্ত নষ্ট করে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের যুদ্ধের মহড়া স্থগিত রাখতে পারা; এবং
ছয়. চীনের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করে নেওয়া।
উত্তর আমেরিকার যেসব ভাষ্যকার কিমের ‘সফলতা’র উপরিউক্ত তালিকা তুলে ধরছেন, তাঁরাই দুই বছর যাবৎ কিম জং-উনকে বারবার ‘পাগলাটে এক বালক’ বলছিলেন।
হ্যাঁ, অতিমাত্রায় ট্রাম্পভক্ত আলোচকেরা তাঁদের প্রেসিডেন্টেরও কয়েকটি সফলতার কথা তুলে ধরছেন। কিন্তু তা সর্বোচ্চ ২-৩টির বেশি নয়। তাঁদের ভাষায়, ট্রাম্পের অর্জন হলো প্রথমত, দেশে-বিদেশে কদাকার ইমেজের মাঝে ‘শান্তিবাদী’ হিসেবে কিছু কূটনৈতিক সফলতা দেখাতে পারা। এই প্রথম ট্রাম্প বিশ্বে একটি ভালো খবরের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারলেন;
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের তিন নাগরিককে পিয়ংইংয়ের আটকাবস্থা থেকে দেশে ফেরত আনতে পারা—উত্তর কোরিয়া যাঁদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতার অভিযোগ তুলেছিল;
এবং তৃতীয়ত. উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক কার্যক্রম থেকে আপাত নিবৃত্ত করতে পারা (কার্যত, খোদ কিম রাজবংশই বহু আগে থেকে কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত দেখতে চাইছিল!)
ফিফা বিশ্বকাপের শুরুর মুহূর্তে কিম-ট্রাম্প বৈঠকের উপরিউক্ত রিপোর্টকার্ডকে গুরুত্ব দিলে ক্রীড়া প্রতিবেদকদের ভাষায় বলতে হবে, মাত্র ৪১ মিনিটের সিঙ্গাপুর ম্যাচের ফলাফল আপাতত উত্তর কোরিয়া ৬ এবং যুক্তরাষ্ট্র ৩।
তবে নিঃসন্দেহে এটা সিরিজের প্রথম ম্যাচ। আসন্ন ম্যাচগুলো সম্পর্কে ১২ জুন ট্রাম্প ও কিম ‘চার দফা’ অস্পষ্ট এক আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এবং ভবিষ্যতে ‘অনেক বৈঠকে’র অঙ্গীকার করেছেন।
‘এ যেন চীনের ফাঁদেই পা দেওয়া হলো’
বলাবাহুল্য, কোরিয়া উপদ্বীপে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের কাজটি সহজ নয়। বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক মনোযোগ এখন উত্তর কোরিয়ার প্রতিবেশী ও প্রধান মিত্র চীনকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। উপরন্তু, দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৫৭ সালের ১ জুলাই থেকে প্রায় ৬০ বছর পুরোনো বিশাল সামরিক উপস্থিতি। কেবল প্রকাশ্য হিসাবেই ২৮ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। যে বাহিনীকে সামরিক পরিভাষায় বলা হয় ‘ইউএসএফকে’ (ইউনাইটেড স্টেইটস ফোর্সেস কোরিয়া)।
যদিও আপাতত কিম-ট্রাম্প বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির প্রসঙ্গ ছিল না—যেভাবে ছিল না উত্তর কোরিয়ার ‘মানবাধিকার’ প্রসঙ্গও। কিন্তু এটা প্রায় অনিবার্য, পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগের শর্ত হিসেবে পিয়ংইয়ং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ইউএসএফকের প্রত্যাহার চাইবে।
ঠিক এখানে এসেই উত্তর কোরিয়া ও চীনের স্বার্থ একবিন্দুতে এসে মিশেছে। চীনও চাইছে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়ুক। বৈঠকে ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক মহড়া বন্ধের যে অঙ্গীকার করেছেন, সেও সরাসরি চীনেরই পুরোনো দাবি মাত্র। ফলে ট্রাম্প তাৎক্ষণিকভাবে যেমন ১২ জুনের বৈঠক থেকে কিমের চেয়ে অতিরিক্ত কিছু অর্জন করতে পারেননি, তেমনি ভবিষ্যত আসরগুলোতেও তাঁর যেকোনো ছাড় চীনকেই খুশি করবে। সেই অর্থে এটাও এক সম্পূরক প্রতীকী ঘটনা যে কিমকে পিয়ংইয়ং থেকে সিঙ্গাপুর বয়ে এনেছিল এয়ার চায়নার একটা বিমান এবং চীনের প্রধান এক প্রচারমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস গতকাল তাদের সম্পাদকীয়তে ট্রাম্প-কিম বৈঠকের ফলাফলকে উল্লেখ করেছে ‘বড় অগ্রগতি’ হিসেবে।
অথচ যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান প্রচারমাধ্যমে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের তরফ থেকে সিঙ্গাপুর সম্মেলন নিয়ে দ্বিধান্বিত সব ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে; বিজয় উল্লাস তো নয়ই। ‘এ যেন চীনের ফাঁদেই পা দেওয়া হলো’—এমনই শঙ্কা তাঁদের শব্দ চয়নে।
বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সমরশিল্প লবি অনেকখানি হতাশ এবং একইরূপ হতাশার কারণ ঘটেছে জাপানের বেলাতেও। ট্রাম্প-কিম হাস্যোজ্জ্বল ছবি বলে দিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জাপানের আপাতত সামরিক গুরুত্বহীনতার কথা।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক।