।। হাসান রহমান ।।
তালেবানদের বন্ধুর অভাব নাই! কখনো আমেরিকা, কখনো রাশিয়া অথবা চায়না। তবে সত্যিকারের কোন বন্ধু আছে কিনা সেটা বলা যায়না। তালেবানরা গত দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে বিভিন্ন পরাশক্তির অভিলাসের সূত্রধর হিসেবেই ছিল, এবং এখনো আছে। তালেবানদের সাময়িক বিজয়ে উৎসাহ প্রকাশ করার মানুষের অভাব নেই, কিন্তু তাদের সঠিক ভবিষ্যত দিক নির্দেশনা দেবার মানুষ কোথায়? বিশ্বব্যাপী তালেবানদের এই বিজয়ে মানুষ যতটা না খুশী, এর চেয়ে বেশী খুশি আমেরিকার পরাজয়ে। আমেরিকার কর্তৃত্ববাদীরাজনীতি অনেক আমেরিকানই পছন্দ করে না। প্রখ্যাত চিন্তাবিদ নওম চমস্কি আমেরিকার মাটিতে বসেই যখন বলেন, আমেররিকা মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস করে দিয়েছে, তখন দেশটির সরকার এবং প্রশাসন নিরব থাকে। কারণ, চমস্কি হয়তো ভুল কিছু বলেননি।
দেশ ত্যাগের আশায় কাবুল বিমান বন্দরের বাইরে অপেক্ষারত আফগান নাগরিকরা
যুদ্ধজয়ী তালেবানদের বিজয় উল্লাসের হাজারো ছবি এখন বিশ্ব মিডিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ যেই ছবিগুলো আমরা দেখিনি অথবা যেই ছবিগুলো কেউ কোনদিন ধারণই করেনি তা হলো হাজারো তালেবান মুজাহেদীনের অসহায় মৃত্যু। হাজারো বিধবা কিংবা এতিমদের দু:সহ জীবন যন্ত্রনা। আশরাফ ঘানি হেলিকাপ্টার আর চার গাড়ি ডলার নিয়ে দেশ ছেড়েছেন। এই সংবাদ বিশ্ব গণমাধ্যম প্রচার করেছে। এই প্রচারনা আমরা বিশ্বাস করেছি। কিন্তু কিছুটা সন্দেহও হয়, যখন এই সংবাদটি রাশিয়ার মিডিয়ায় বেশী প্রাধান্য পায়। তবে কি ধরে নেব, আশরাফ ঘানি আমেরিকার বন্ধু বলেই সে রাশিয়ার শত্রু? কেউ কি বলতে পারেন আফগানিস্তানে গত কয়েক দশকে কেন একটি স্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি? আমরা জানি প্রশ্ন যখন উত্তরের চাইতেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়, তখন কেউই সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজে না।
গত দুই দশকে আমেরিকা এবং এর মিত্ররা আফগানিস্তানে ২ দশমিক ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। আমরা সেটাও বিশ্বাস করি। কিন্তু এর কোন বাস্তব চিত্র দেখতে পাইনা। এই বিশাল অর্থ ভান্ডার কোথায় কার জন্য খরচ করা হয়েছে সেই খবরও আমাদের অজানা। আফগানিস্তানের স্থাপনা, রাস্তাঘাট, জীবন ব্যবস্থা কিংবা এয়ারপোর্ট দেখলেই বুঝা যায় দারিদ্রতার ছাপ প্রতিটি অঙ্গনে। এই রকম একটি সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি– আমি আমার কানকে বিশ্বাস করবো নাকি চোখকে?
আল কায়দা আর তালেবানরা টুইন টাওয়ার ধ্বংস করেছে। এই কথাটিও আমাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে। কিন্তু স্বয়ং আমেরিকানরাই যখন এই কথাটি বিশ্বাস করতে চায়না তখন আমাদের বিশ্বাসের অসহায়ত্ব আরো নিবিড় ভাবে প্রকাশিত হয়। আমেরিকা টুইন টাওয়ার ধ্বংসের কারণ দেখিয়ে ২০ বছর আফগানিস্তান দখলে রেখেছে। চাইলে আরো ২০ বছরও দখল করে রাখতে পরতো এই সত্যটি তালেবানরাও জানে। কিন্তু কেন রাখবে? সেই উপলদ্ধির পরই বাইডেন সরকার ধ্বংস প্রায় দেশটিকে দ্বায়িত্বহীনভাবে ফেলে রেখে ফিরে গেল নিজ গন্তব্যে।
বহুমত বহু পথের আফগান জনপদে এখন শুধুই অনিশ্চয়তা। প্রতিটি আফগান নাগরিকই উপলদ্ধি করছেন, কিভাবে তাদের প্রতিটি দিন যায়, রাত কাটে। অবিশ্বাসী বন্ধু এবং নিশ্চিত শত্রুরাই এখন আফগানিস্তানকে পুনঃনির্মাণ করবে। একবিংশ শতাব্দিতে একটি জাতির জন্য এর চাইতে বড় অসহায়ত্ব আর কি হতে পারে। যারা এরই মধ্যে দেশ ত্যাগ করেছে তারা হয়তো জীবন রক্ষার সুযোগ পাবে। কিন্তু কোটি কোটি আফগান নাগরিকের ভবিষ্যত কি হবে? মিলিয়ন ডলারের এই প্রশ্নের কোন উত্তর কি আছে কারো কাছে?
মানবিকতা অনেক আগেই নির্বাসনে চলে গেছে। প্রতিযোগিতা সম্পদ অর্জনের। প্রতিযোগিতা মতবাদ প্রতিষ্ঠার। এই প্রতিযোগিতায় কত মানুষ কষ্ঠ পেল, কত মানুষ আহত কিংবা নিহত হলো, সেটি এখন আর বিবেচনার বিষয় নয়। আধিপত্য আর দখলদারিত্বে জন্য ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই আমরা এক অসুস্থ্য প্রতিযোগিতায়। আফগানিস্তানের কোটি কোটি মানুষ সেই প্রতিযোগিতার নিষ্পেশিত দর্শক। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর বিশ্ব মোড়লরা এখন আফগানিস্তান পুনর্গঠনে সক্রিয় হওয়ার ভনিতা করছে। অথচ গত বিশ বছর ধরে যারা এই দেশটিকে ধ্বংস করেছে তাদের বিচার কে করবে?
ইমরান খান যখন আফগানিস্তান পুনর্গঠনে তদবির করে তখন সেই তদবিরকেও তামাসা মনে হয়। কারণ পাকিস্তানের অনেক অঞ্চলই তার সরকারের ক্ষমতার বাইরে। পাকিস্তানের মাটিতেও তালেবানদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। সর্বোপরি দেশটি আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। পাকিস্তানের জনগনের উপর আমেরিকা বছরের পর বছর ধরে ড্রোনের মাধ্যমে তাদের মিসাইলসহ বিভিন্ন মারণাস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছে। পাকিস্তান এ বিষয়টা সবসময় না দেখার ভান করে থাকে। ইসরাইলি সমাজবিজ্ঞানী ইউভাল নোয়া হারারী যখন বলেন, ‘‘পাকিস্তান হচ্ছে আমেরিকার বোমা পরীক্ষার ল্যাব‘‘ তখনতো ইমরান খানরা কোন প্রতিবাদ করেনি।
বন্ধুহীণ তালেবানদের আগামীতে আসলে সম্ভাবনার চাইতে চ্যালেঞ্জই বেশী। তালেবানরা শত্রুর শত্রু চীন আর রাশিয়াকে বন্ধু হিসেবে নিলেও এই বন্ধুত্ব কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে সেটা বলা কঠিন, কারণ তালেবানদের মনে রাখতে হবে,‘‘বড়র পিরিতি বালির বাঁধ‘‘। বড় ধরনের স্বার্থ ছাড়া চীন, রাশিয়া কেন তালেবানদের মত অনুদার ধর্মীয় গোষ্ঠিকে সমর্থন দেবে? সেটি তালেবানরা না জানলেও সমগ্র বিশ্ব জানে। তালেবানরা যেই মতাদর্শে বিশ্বাস করে, তালেবানরা যেই ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, চীন এবং রাশিয়া যখন সেই মতবাদ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে, তখন বুঝতে হবে, তাদের বাসনা আরো অনেক বড়। উত্তপ্ত কড়াই থেকে জলন্ত আগুনে পড়া আফগান নাগরীকদের জান-মাল রক্ষা করাই এখন তালেবানদের সব থেকে বড় দায়িত্ব।
দিন শেষে আফগান জনগনই হোক আফগানিস্তানের সকল ক্ষমতার উৎস। সেই জনগনকে যদি বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে, অতীতের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে আমেরিকার তাবেদার সাব্যস্ত করে, শাস্তি দেয়া হয়, তাহলে তালেবানদের জন্য আফগানিস্তানের নেতৃত্ব দেয়া আরো কঠিন হবে। তাদের ক্ষমতা দখলের কারনে বিশ্বব্যাপী মুসলমানেদের একটি অংশ যেভাবে সমর্থন দিয়েছে, সেই সমর্থন অচিরেই বিরোধীতায় রূপ নেবে। স্বাধীনতা অর্জনের চাইতেও স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। এমন মতবাদকে গুরুত্ব দেয়ার সময় যে তালেবানদের নেই, সেটা ক্ষমতা দখলের এক সপ্তাহের মধ্যে প্রমান করেছে তারা। দেশটিতে গৃহযুদ্ধের দামামা বাজছে। তাদের ভুলে গেলে চলবে না অস্ত্র দিয়ে ভুখন্ড দখল করা গেলেও অস্ত্র দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শরীয়া আইনের নামে তেলেবানরা যে দুঃশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। বিশ্ববাসী এখনো তা মনে রেখেছে। আমেরিকার এবং মিত্রবাহিনীর হাত থেকে ক্ষমতা দখল যদি স্বাধীনতা অর্জন হয় তবে সেই অর্জনের পর কেন হাজারো মানুষকে দেশ ছাড়ার জন্য কাবুল বিমান বন্দরে জড়ো করা হয়েছিল? সেই বাস্তবতাও মনে রাখতে হবে তালেবানদের। ইসলামের নামে আতংক সৃষ্টি করে মুখে শান্তির ধর্ম হিসেবে প্রচার করলে ধর্মের অবমাননাই হবে বৈকি। বন্ধুহীণ তালেবানদের সামনে হাজারো সমস্যা। সেই সকল বাস্তব সমস্যা সমাধান না করে, নতুন করে সমস্যা তৈরী করে সমাধানের চেস্টা করা হবে তাদের পুরানো ভুলেরই পূনরাবৃত্তি। আর ভুলের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে অপরাধ। আর সেই অপরাধের শাস্তি ভোগ করবে আফগানিস্তানের আপামর জনসাধারণ।
হাসান রহমান : সাংবাদিক ও মানব উন্নয়ন কর্মী। ২১ আগস্ট ২০২১ লন্ডন poloketv@yahoo.com