ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের অবসানের পর ঢাকা এবং দেশ যে পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে, তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে শুক্রবার রাত সোয়া নয়টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িতে লোকাল বাসের ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা। আর এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তখন, যখন চলছে ট্রাফিক সপ্তাহ। পথে পথে পুলিশের উপস্থিতি এবং লাইসেন্স পরীক্ষার মধ্যেই বাসচালকের সহকারী, যাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্সই ছিল না, তাঁর চালানো বাস ধাক্কা দিয়েছে মন্ত্রীর গাড়িকে। সৌভাগ্যবশত মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আহত হননি, গাড়ির ক্ষতিও সামান্যই। দুর্ঘটনা ঘটা কোনো বিচিত্র বিষয় নয়, অস্বাভাবিকও নয়; কিন্তু কোনো কোনো দুর্ঘটনা যে প্রতীকী হয়ে ওঠে, সেটা মনে রাখলে এই সামান্য দুর্ঘটনাটির তাৎপর্য বোঝা সহজ হবে। সময় ও কারণ দুই-ই লক্ষণীয়। ২৯ জুলাই দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীবের মৃত্যু যেমন পরিবর্তনের তাগিদের জন্য প্রতীকী হয়ে উঠেছিল এবং গোটা দেশের মানুষের কাছে আবেদন রেখেছিল, শুক্রবারের দুর্ঘটনাও তেমনি পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তনের এক প্রতীকী ঘটনা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ সবার জানা। যেভাবে এর অবসান হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলাও বাহুল্য। সহিংসতা এবং বল প্রয়োগের কারণেই একটি ন্যায্য আন্দোলনের ইতি ঘটেছে। এর জন্য ‘গুজব’ রটনাকারীদের ওপর সমস্ত দায় চাপিয়ে দিয়ে যারা স্বস্তি ও তৃপ্তি বোধ করছেন, তাঁরা গুজব রটনার পরিস্থিতির সূচনা কেন হলো, সেটা ভেবে দেখলে ভালো করবেন। যাঁরা আন্দোলনের তৃতীয় দিন থেকেই তাঁদের অনিঃশেষ বিজ্ঞতা দিয়ে প্রায় দৈব বাণীর মতো করে অত্যাসন্ন সহিংসতার ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছিলেন, তাঁরা কি এই সহিংসতা যাঁরা চালালেন, তাঁদের অনুকূলেই পরিবেশ তৈরি করেননি? একেই ইংরেজিতে বলে ‘সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসি’; বাংলায় সম্ভবত একে ‘স্ব-পূরক ভবিষ্যদ্বাণী’ বলে বর্ণনা করতে পারি। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট মার্টন প্রথম এই ধরনের আচরণের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেন এবং এই ধারণাটি চালু করেন। ‘সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসি’র মোদ্দা কথা হচ্ছে গোড়াতে কোনো পরিস্থিতিকে এমন মিথ্যাভাবে বলা, যার ফলে এমন ধরনের আচরণ সংঘটিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত ওই মিথ্যাকেই সত্যে পরিণত করে। তাতে করে যে বা যাঁরা ওই মিথ্যার প্রচার করেছিলেন, তাঁরা এই কৃতিত্ব নিতে পারেন যে সে বা তাঁরাই আসল অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। এই ধরনের ‘প্রফেসি’ সংকটকালে ‘গুজবের’ চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ হতে পারে, বিশেষ করে তা যদি ক্ষমতাশালীদের অস্ত্র হয়ে ওঠে। কেউ কেউ একে ‘উসকানি’ বলেই বিবেচনা করতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার পরে এখন যে অবস্থা, তাকে গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যাঁরা ‘স্বাভাবিক’ হয়ে আসা বলে বর্ণনা করছেন, তাঁরা আসলে বলতে চাইছেন ‘পূর্বাবস্থা’। পূর্বাবস্থা যে স্বাভাবিক ছিল না, সেটা শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে দেখিয়ে দেওয়ার পরেও যদি তা না বুঝতে সক্ষম হই তবে তাকে অপারগতা বলে মনে করার কারণ নেই, একে অনীহা বলাই ভালো। এটা বলা যথার্থ যে, নয় দিনের আন্দোলনের আগে রাস্তাঘাটের যে অবস্থা ছিল, সড়ক পরিবহনের ব্যবস্থাপনায় যে অবস্থা ছিল, আমরা সেখানেই ফিরে এসেছি। মনে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পথে নামা, দাবি উত্থাপন, আন্দোলন হচ্ছে ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনামাত্র। একে যাঁরা একসময় ঐতিহাসিক বলেছিলেন, তাঁদের আচরণে মনে হয় এখন তাঁরা একে ইতিহাসের ফুটনোটে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যেই যে ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে পুরো আন্দোলনকেই কেবল ‘গুজবের’ ফসল বলা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
অনেকে মনে করিয়ে দেবেন যে এক দিনে এত বড় সমস্যার সমাধান হবে না। আমিও তা আশা করছি না। প্রশ্ন হচ্ছে লক্ষণগুলো কী? ইতিমধ্যে অর্জনের তালিকার শীর্ষে আছে সড়ক পরিবহন আইন। এই আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে এবং সংসদে পাস হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। এই আইনের ফাঁকফোকর বোঝার জন্য এটাই যথেষ্ট মালিকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে-এমন কিছুই এতে নেই। মালিকদের প্রতিনিধিকে মন্ত্রিসভায় রেখে সেই সম্ভাবনা কতটুকু? অন্য বিষয়গুলোর মধ্যে যা আছে তাকে একধরনের দায়মুক্তির ব্যবস্থাই বলা যায়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) নেতারা সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ: “আইনটিতে…সড়কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারিগরি ব্যক্তি, বাসমালিক ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনাজনিত দায়মুক্তির সুযোগ রয়ে গেছে” (বণিকবার্তা, ৯ আগস্ট ২০১৮)। গত কয়েক দিনে ঢাকায় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সামনে উপচে পড়া গাড়ির ভিড় দেখিয়ে যাঁরা একে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতার কিংবা আইন পালনে আগ্রহের উদাহরণ বলবেন, তাঁরা নিশ্চয় এটাও জানেন যে এই সুযোগে দালালদের আয়-রোজগার বেড়েছে (বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন, ৯ আগস্ট ২০১৮)। দালালদের উপস্থিতি এবং চটজলদি কাগজপত্র নবায়নের এই প্রক্রিয়া যে আবারও যথাযথ ব্যবস্থার অনুপস্থিতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের উপস্থিতি যে দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়, তা বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ কোথায়?
এই সব হচ্ছে আইনি দিক, আমলাতান্ত্রিক দিক। এর সঙ্গে কারিগরি এবং প্রযুক্তিগত বিষয় যুক্ত করা যায়। এই সব বিবেচনায় পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তনের ফলে হয়তো আগের চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে না। কিন্তু একে আর স্বাভাবিক বলে বিবেচনা করা যাবে না, সেটাই হচ্ছে এই আন্দোলনের শিক্ষা। যাঁরা এই পরিস্থিতিকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করছেন, তাঁদের সঙ্গে আমার মতপার্থক্য কেবল ভাষাগত নয়। কেননা, আন্দোলন দমনেই কেবল শক্তি প্রয়োগ হয়েছে, তা নয়; এরপর যা ঘটছে তা আরও উদ্বেগজনক। ইতিমধ্যে আটক ২২ জন শিক্ষার্থীকে রিমান্ডে পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে, তাঁদের জামিনের আবেদন নাকচ করে জেলে পাঠানো হয়েছে এবং একসময়ের ছাত্রনেতা শিক্ষামন্ত্রী এককথায় তাঁদের মুক্তির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে আইনের নিজস্ব গতির দিকে অঙ্গুলিসংকেত করেছেন।
শুধু তা-ই নয়, লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে সারা পৃথিবীই এখন জানে যে ‘কাউকেই ছাড়া হবে না’ বলে হুংকার দিয়ে গুজব রটনাকারী অভিযোগে তরুণদের সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা হচ্ছে। স্বীকার করতে চান অথবা না চান দেশের বাইরে একে ‘উইচ হান্টিং’ বলেই মনে করা হচ্ছে। তরুণদের ভীতসন্ত্রস্ত করার যে কৌশল কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছে, এখন তা আরও ব্যাপক আকারে প্রযুক্ত হতে শুরু করেছে। এগুলো শক্তি প্রয়োগের কৌশল। যে লাখ লাখ শিক্ষার্থী আন্দোলনে যুক্ত ছিল, তারা তাদের সমবয়সী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এসব ব্যবস্থাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নেবে-এমন মনে করার কারণ নেই। সেটা এখনই প্রকাশিত হোক অথবা না হোক। ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিতে রাস্তায় নামা শিক্ষার্থীদের ওপর কয়েকটি জায়গায় যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তাতে মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী’-এই খবর বিবিসির। এই অবস্থায় আছে কত শিক্ষার্থী, আমরা তা জানি না। এর সঙ্গে এখন মানসিক চাপ, ভীতি এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার যে কৌশল, তাতে আপাতত রাজনৈতিক সাফল্যই প্রধান বিবেচ্য।
এ ধরনের শক্তি প্রয়োগ এবং কথিত আইনি ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া দেশের বাইরে কী ধরনের হয়, তা ইতিমধ্যেই শহিদুল আলমকে আটকের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোধগম্য। যে প্রক্রিয়ায় তাঁকে আটক করা হয়েছে এবং আটক অবস্থায় তাঁর সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন, তার প্রতিক্রিয়ায় ‘সড়ক নিরাপত্তা’ নয়, বাংলাদেশে বিরাজমান শাসনব্যবস্থা নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশে ভিন্নমতের জায়গা যে কতটা সংকুচিত হয়েছে, সে বিষয়ে যাঁরা অবগত ছিলেন না, তাঁদের মনোযোগ এখন বাংলাদেশের দিকে নিবদ্ধ হয়েছে, এটা এখন আর অস্বীকারের উপায় নেই।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর