পাকিস্তানের সবচেয়ে ‘বিপজ্জনক’ তরুণ

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তরুণেরা পরিবর্তনের জন্য কীভাবে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে আছে, তার হালনাগাদ দৃষ্টান্ত হলো পাকিস্তানজুড়ে মনজুর পাশতিনদের আন্দোলন। পাঁচ দশক আগের বাঙালি যুবকেরা যেভাবে লড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রায় সেভাবেই উঠে দাঁড়িয়েছে পশতু তরুণেরা। তাদের নেতাও ২৬ বছর বয়সী এক তরুণ। তারা যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে, তা দেশটির কায়েমি ক্ষমতাকে আবারও একাত্তরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এবারও নিজেদের শুধরানোর কথা তারা ভাবতে পারছে না।

দুই. 
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ২১ বছর পর দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে এক গরিব পরিবারে মনজুরের জন্ম। দক্ষিণ এশিয়ার এক সহিংস অঞ্চল এটা। পাকিস্তানের বিভিন্ন বাহিনী ২০০৯ সাল থেকে এ অঞ্চলে পাকিস্তানি তালেবান ও বিদেশি গেরিলাদের বিরুদ্ধে ‘অপরাশেন রাহে নিজাত’ (মুক্তির পথ) পরিচালনা করছে। এই অপারেশন-পরবর্তী অর্ধযুগে মনজুর পাশতিনের পরিবারকে অন্তত চারবার উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। সর্বশেষ তাদের ঠাঁই হয়েছে ডেরা ইসমাইল খান শহরে।

মনজুর পাশতিনের পরিবারের দুর্দশার এ অধ্যায় পাকিস্তানের বিভিন্ন সহিংস এলাকায় প্রায় সব পশতু ও বালুচদের কাহিনির মতোই। প্রায় দুই প্রজন্ম ধরে দেশটির ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’র প্রধান জ্বালানি হয়ে আছে তারা। কিন্তু এই কাহিনির পরের অংশটুকুতে সম্প্রতি মনজুর একদম অচেনা এক পাণ্ডুলিপি জুড়ে দিয়েছেন।

মনজুরের জন্ম যে ‘মাসিদ’ ট্রাইবে, তাদের বিবেচনা করা হয় পশতুদের সবচেয়ে স্বাধীনচেতা গোত্র। সেই কারণেই হয়তো উদ্বাস্তু জীবনের মাঝেই মনজুর গড়ে তোলেন ‘পশতুন তাহফুজ মুভমেন্ট’ (পশতুন সুরক্ষা আন্দোলন, পিটিএম)। এরপর থেকে মনজুর ও পিটিএম কোয়েটা থেকে পেশোয়ার-পশতুন জনপদগুলোয় যত ঘুরেছেন, ততই আবিষ্কৃত হচ্ছে পাকিস্তানজুড়ে এরূপ জাতিসত্তার বঞ্চনা ও বেদনার বিশাল গাথা। একে ভাষা দিয়ে তরুণ মনজুর এ মুহূর্তে ‘পাকিস্তান রাষ্ট্র’-এর কাছে সবচেয়ে বিপজ্জনক তরুণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর হাতে কোনো অস্ত্র নেই—কিন্তু তাঁর আহ্বান দারুণ এক প্রতিরোধের জন্ম দিয়েছে।

সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে পিটিএম ডেরা ইসলাইল খান থেকে পেশোয়ার হয়ে ইসলামাবাদ পর্যন্ত এক লংমার্চ করে। এই লংমার্চের মধ্য দিয়ে এক দশক ধরে শত শত পশতুনের বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রসঙ্গটি পাকিস্তানজুড়ে সংবাদমাধ্যমের প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়। আর এর মাধ্যমেই দেশটির ডিপ-স্টেইট (নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতাজাল) প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন মনজুর পাশতিন।

তিন. 
বিচারবহির্ভূত হত্যা বাংলাদেশের মতোই এখন ভারত ও পাকিস্তানেরও বিপজ্জনক এক বাস্তবতা। পাকিস্তানে তালেবান ও বালুচ স্বাধীনতাকামীদের দমনের নামে এর প্রসার ঘটানো হয়েছে। এসব ধারাবাহিক হত্যালীলার প্রধান শিকার পশতু তরুণেরা—লাহোর, করাচি, পেশোয়ারসহ সর্বত্র। দেশের যেকোনো শহরেই পশতু পরিবারগুলো প্রায়ই অতিরিক্ত সন্দেহ এবং তল্লাশির শিকার। আর পশতু এলাকামাত্রই যখন-তখন কারফিউ। সোয়াত উপত্যকায়ও এমনও রয়েছে, একই সড়কে এক জায়গায় সেনাবাহিনী তল্লাশিচৌকি বসিয়েছে এবং অপর স্থানে তালেবানরা বসিয়েছে অনুরূপ চৌকি। উভয় গোষ্ঠীর হয়রানির শিকার সাধারণ পশতুরা—পাকিস্তানের জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ হয়েও নীতিনির্ধারণী স্তরে তাদের উপস্থিতি খুবই নগণ্য।

প্রাত্যহিক এই নিগৃহীত জীবন নিয়ে পশতু সমাজে ক্ষোভ থাকলেও এই প্রথম তা বিস্ফোরক রূপ নেয়। গত ১৩ জানুয়ারি নকিবুল্লাহ মেহসুদ নামের ২৭ বছর বয়সী পশতু মডেলকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে হত্যার পর ঝড় ওঠে। সরকারি ভাষ্যে বলা হয়, নকিবুল্লাহ ‘লস্কুর-ই-জংবি’র সদস্য ছিলেন।

অতীতে পাকিস্তানের বিভিন্ন বাহিনীর এরূপ ‘সন্ত্রাসী’ হত্যা প্রচারমাধ্যমে ‘রাষ্ট্রে’র গতানুগতিক সফলতার সংবাদ হিসেবেই প্রকাশ পেত। কিন্তু নকিবুল্লাহর ‘মৃত্যু’কে পশতু তাহফুজ মুভমেন্ট চ্যালেঞ্জ করে। দেশটির সোশ্যাল মিডিয়াও পিটিএমের পাশে দাঁড়ায়। ফলে করাচিতে ‘সন্ত্রাসবিরোধী অপারেশন’-এর এত দিনকার ‘নায়ক’ পুলিশ কর্মকর্তা রাও আনোয়ারের বিরুদ্ধে তদন্তে নামতে বাধ্য হয় রাষ্ট্র। আর ভয়ানক এক চিত্র বেরিয়ে আসে তদন্ত শেষে। ২০১৮-এর ৩ জানুয়ারি নকিবুল্লাহকে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। ১০ দিন বন্দী রেখে পরে তাকে এনকাউন্টারে হত্যা করা হয়।পেশওয়ারে ‘এনকাউন্টার’ বিরোধী সমাবেশ। ছবি: এএফপিচার. 
পিটিএমের আন্দোলন প্রচারমাধ্যমেরও সাহস বাড়িয়ে তোলে। খ্যাতনামা কাগজ ডন গত ২৩ মার্চ দেশটির এনকাউন্টার পরিস্থিতি নিয়ে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, করাচিতে নকিবুল্লাহকে যিনি এনকাউন্টার করেছিলেন, সেই কর্মকর্তার অধীনে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এমন ৪৪৪টি এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটেছে, যার একটিরও সত্যাসত্য তদন্ত করে দেখা হয়নি। একটি এনকাউন্টারেও কোনো বাহিনীর কেউ আহত হয়নি। পিটিএমের আন্দোলনের পর নকিবুলল্লাহর এনকাউন্টার ছিল জবাবদিহির কাঠগড়ায় ওঠা প্রথম ঘটনা।

বলা বাহুল্য, কেবল পুলিশ নয়, পাকিস্তানে এনকাউন্টার উৎসবে যুক্ত আছে রেঞ্জার্সসহ ‘অন্যরাও’। স্বভাবত পিটিএম জানাচ্ছে, কেবল নকিবুল্লাহ নন, বিগত বছরগুলোর তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ শত শত বালুচ ও পশতু তরুণ নিখোঁজ হয়ে গেছে। তাদের দাবি, অবিলম্বে এই ধারা বন্ধ হতে হবে এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দিতে হবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত ১৯ মার্চ জানিয়েছে, জাতিসংঘের যে শাখা গুম ও নিখোঁজ মানুষদের নিয়ে কাজ করে, সেখানে অন্তত ৭০০ পাকিস্তানি পরিবার তাদের নিকটজনদের নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ দায়ের করেছে। দেশ হিসেবে পাকিস্তানের জন্য এটা খুবই বিব্রতকর। কারণ, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য সে। সরকার এই বিষয়ে যে কমিশন গঠন করেছে, তার কাছে ২০১১ থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৬০৮টি নিখোঁজের তথ্য জমা পড়েছে বলে দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন ১০ জানুয়ারি তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। এসব নিখোঁজ মানুষের বড় এক অংশই পশতু জাতিসত্তার মানুষ।

বলা বাহুল্য, আফগানিস্তানে শুরু হওয়া এবং পরে পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়া তালেবান আন্দোলনে যেহেতু ঐতিহাসিকভাবে পশতুদের সংখ্যাই ছিল বেশি। ফলে পশতুদের নির্বিবাদে এনকাউন্টারে দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে দেশে-বিদেশে বাহবা কুড়িয়েচে পাকিস্তান। অথচ দেশটি একসময় আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী প্রতিরোধের জন্য তালেবান বাহিনী গড়ে দিয়েছিল। পিটিএম তাই পাকিস্তানের চলতি সন্ত্রাসী পরিস্থিতির জন্য ‘ইউনিফর্মধারী’দের দায়ী করছে। তাদের মতে, চলতি পশতুবিরোধী এনকাউন্টার হয়ে দাঁড়িয়েছে পাঞ্জাবি প্রাধান্যপূর্ণ সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের জাতিগত নিপীড়নের এক হিংসাত্মক প্রকাশ, যার সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। মনজুর পাশতিন পিটিএমের মিছিলগুলোয় স্পষ্টত সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ‘রাওয়ালপিন্ডি’র দিকে আঙুল নির্দেশ করছেন; পাকিস্তানে যে শহর ডিপ-স্টেইট তথা রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রতীক।

গত সপ্তাহে লাহোরে পিটিএমের মিছিল থেকে একই দাবি উঠলে দেশটির সেনাপ্রধান এই প্রথম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, আলোচ্য বিক্ষোভ ‘সাজানো’ এবং তাতে ‘বিদেশি ইন্ধন’ আছে। জেনারেল কামার জাভেদের ইঙ্গিত আফগানিস্তানের দিকে। যেমনটি বালুচদের আন্দোলনের জন্য ভারতকে দায়ী করা হয়।

তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেকোনো ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ জন-আন্দোলনের বিরুদ্ধে এগুলো অতি ব্যবহৃত অভিযোগ। পিটিএম কিংবা মনজুর পাশতিন কেউ-ই তাই থামতে অনিচ্ছুক। আগামী ১২ মে তারা করাচিতে সমাবেশ করবে। করাচি ইতিমধ্যে এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠছে। দেশের অন্যত্রও পশতু তরুণদের অনেকেই মনজুরের প্রতি সমর্থনের চিহ্ন হিসেবে তাঁর টুপির আদলে লাল-কালো টুপি পরতে শুরু করেছে এবং নামের শেষে ‘পাশতিন’ পদবি ব্যবহার করছে। যেকোনো সামাজিক সংগ্রামই নানান সাংস্কৃতিক তৎপরতা নিয়ে হাজির হয়—এসবই তার চিহ্ন।

তবে পিটিএমের এই আন্দোলন পাকিস্তানের জন্য গুরুতর এক এনকাউন্টারে পরিণত হয়েছে। আগামী কয়েক মাস পরই দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন। বয়োবৃদ্ধ নির্বাচনী খেলোয়াড়দের জন্য মনজুর পাশতিনরা ইতিমধ্যে এক অনিশ্চিত সমীকরণ ছুড়ে দিয়েছেন। বালুচ ও পশতু তরুণেরা যতই পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোতে ন্যায়বিচার ও সামাজিক সাম্যের দাবিতে জড়ো হচ্ছে, ততই প্রথাগত নেতৃত্বের জন্য রাষ্ট্র বনাম জনতার মাঝে ফাঁকা জায়গা কমে যাচ্ছে।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক।

Advertisement