|| কামাল মেহেদী।।
আর মাত্র দুদিন বাকী লন্ডন মেয়র নির্বাচনের। লন্ডনে লেবার মেয়র প্রার্থী সাদিক খান এবং কনজারভেটিভ প্রার্থী শন বেইলির মধ্যেই মূল লড়াইটি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মিনিক্যাব ড্রাইভার ও তাদের পরিবারের সদস্য এবং ক্ষতিগ্রস্ত লন্ডনের ছোট্ট ও মাঝারি আকারের ব্যবসায়ীরা কোনো অঘটন ঘটিয়েও ফেলতে পারেন। তাই সাদিক খান তথা লেবার পার্টির জন্যে লন্ডন মেয়র নির্বাচন কম গুরুত্বের সেটা বলা যাবে না।
অন্যদিকে নিউহ্যাম এবং টাওয়ার হ্যামলেটসবাসীর জন্যেও ৬ মে’র নির্বাচনটি বেশ গুরুত্বের। ১০ বছর আগে রেফারেন্ডামের মাধ্যমেই টাওয়ার হ্যামলেটসে মেয়রাল সিস্টেম চালু হয়েছিল। টাকার শ্রাদ্ধ আর কাকে বলে! ১০ বছর না ঘুরতেই এই সিস্টেম থাকবে কি না, এই প্রশ্নে আবারো রেফারেন্ডাম হচ্ছে। স্থানীয় লেবার পার্টি গত রেফারেন্ডামেও মেয়রাল সিস্টেমের পক্ষে ছিল না। অন্যদিকে গত নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় নিউহ্যামেও রেফারেন্ডাম দিয়েছেন বর্তমান মেয়র।
নির্বাহী ক্ষমতা বলে মেয়র বারায় একক ক্ষমতাবান ব্যক্তি। নির্বাচিত মেয়রের যদি উদ্দেশ্য ভালো থাকে তাহলে সব ভালো। আর নির্বাচিত মেয়র যদি নিজে ডিক্টেরের পথ বেঁচে নেন তাহলেই সমস্যা! তাহলে আর গণতন্ত্র থাকে না। আমি মনে করি, লিডারশীপ পদ্ধতিতে তৃণমূলে নেতা তৈরীতে সহযোগিতা করে। স্বাধীনভাবে কেবিনেট বা লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালনের ফলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয় কাউন্সিলরদের। অন্যদিকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত মেয়রের কেবিনেটে কারো কিছু বলার থাকে বলে মনে হয় না। মেয়রের সিদ্ধান্তের উল্টো কিছু বললে চাকুরী হারাবার ভয় অবশ্যই থাকে। তারপরেও বড় যে সুবিধাটি মেয়রাল সিস্টেমে, তা হল মেয়র চাইলে কমিউনিটির স্বার্থে এককভাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন এবং জবাবদিহীতার একজন মানুষ পাওয়া যায়। কিন্তু লিডারশীপ সিস্টেমে জবাবদীহিতার স্বাক্ষাত পাওয়া মুশকিল। কে জবাব দেবে? নির্বাহী অফিসার না লিডার? তাই সব কিছু মিলিয়ে আমার কাছে মেয়রাল সিস্টেমই পছন্দের। তাই বৃহস্পতিবার লন্ডন মেয়র এবং ইয়েস-নো’র ক্ষেত্রে ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার শুধু লন্ডনেই ভোটাভুটি হচ্ছে না। ইংল্যান্ডের অন্যান্য এলাকা এবং স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলসেও হচ্ছে ভোটাভুটি। একইদিন ইংল্যান্ডের ১৪৩টি কাউন্সিলের স্থানীয় নির্বাচন, ইংল্যান্ডের হার্টলিপুলের সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন, ১৩টি বারায় সরাসরি ভোটে মেয়র নির্বাচন, ৩৯ জন পুলিশ এন্ড ক্রাইম কমিশনার নির্বাচন, ১২৯ আসনের স্কটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচন, ৬০ আসনের ওয়েলস পার্লামেন্টের নির্বাচন, লন্ডন মেয়র এবং ২৫ জন এসেম্বলী মেম্বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বৃহস্পতিবার। ভোট কেন্দ্রে করোনা বিধি নিষেধ মানতে হবে এবং করোনার কারণে ভোটের দিন ভোটারদের নিজস্ব কলম বা পেন্সিল নিয়ে যেতে অনুরোধ করা হয়েছে।
জেনারেল ইলেকশন অর্থাৎ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনের মতোই ৬মে’র নির্বাচনটি হচ্ছে বিশাল। করোনাকালীন নির্বাচনী প্রচারণায় মূলত সামাজিক মাধ্যমই সরগরম। লকডাউন আইন শিথিলের পর হাটে-মাঠে কদাচিত দেখা যাচ্ছে প্রার্থীদের। লেবার নেতা স্যার কিয়ার স্টারমারের জন্যে এবারের নির্বাচন যেমন বড় পরীক্ষা টিক তেমনি পরীক্ষা প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের জন্যেও।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনাকে মহামারী ঘোষণা করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আর ব্রিটেনে ২০২০ সালের ২৩শে মার্চ জাতীয় লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। করোনা মোকাবিলায় ছিল না তেমন প্রস্তুতি। পিপিই’র অভাবে অংসখ্য ডাক্তার, নার্স এবং কেয়ার ওয়ার্কারের মৃত্যু হয়েছে। বিলম্বে করোনা লকডাউনে যাবার এবং করোনা মোকাবিলার অপ্রস্তুতির ব্যর্থতা ধামাচাপা দিতে প্রচলিত নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে চুক্তির অভিযোগ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে সংসদে সরকারের এসব ব্যর্থতা কতোটা সফলভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন লেবার নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার? পার্লামেন্টে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে জোড়ালো ভূমিকা পালনে ব্যর্থতার অভিযোগে এই কিছু দিন আগেও স্যার কিয়ার স্টারমারকে পাব থেকে জোরপূর্বক বের করে দিয়েছেন পাবের মালিক। সংবাদ মাধ্যমে ব্রিটিশ জনগণ তা দেখেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ব্রেক্সিট এবং করোনা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সাফল্য-ব্যর্থতা এবং কঠিন এই সময়ে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে ভূমিকা পালনে লেবার নেতা স্যার কেয়ার স্টারমারের সাফল্য-ব্যর্থতার বিচার হবে ৬ই মে’র নির্বাচনে। কেউ কেউ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী উন্সটন চার্চিলের পরিণতির বিষয়টিও টেনে নিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ক্ষেত্রে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কনজারভেটিভের প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের সর্বদলীয় কেবিনেট ছিল। কিন্তু যুদ্ধের রেশ তখনো কাটেনি। জাপানের সঙ্গে হিটলার বাহিনীর যুদ্ধ চলাকালেই ব্রিটেনে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন উইন্সটন চার্চিল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ব্রিটেনকে নতুনভাবে গড়ার পরিকল্পনার মাঝেই তৎকালিন লেবার নেতা এবং উইন্সটন চার্চিলের কোয়ালিশন সরকারের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ও লেবার নেতা ক্লাইমেন্ট এ্যাটলি যুদ্ধকালিন কোয়ালিশন সরকার থেকে বের হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর ১৯৪৫ সালের ২৩শে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে জাতীয় নির্বাচনের ডাক দেন স্যার উইন্সটন চার্চিল। তবে পদত্যাগ করলেও জুলাইয়ে নির্বাচনের পর নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই দায়িত্বে ছিলেন তিনি। নির্বাচনী প্রচারণায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত পুরো দেশ ঘুরেছেন চার্চিল। ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল তাঁর। যেখানেই গেছেন সেখানেই তাকে স্বাগত জানিয়েছে সাধারণ মানুষ। তবে নির্বাচনী প্রচারণার সর্বশেষ সভায় ওয়ালথামস্টোতে প্রথম প্রকাশ্যে চার্চিলের সামনেই সাধারণ মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে শুরু করে। ১৯৪৫ সালের ২৬শে জুলাইয়ের নির্বাচনে পরাজিত হন তিনি। উইন্সটন চার্চিলকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসেন লেবার পার্টির নেতা ক্লেমেন্ট এ্যাটলি। এটাই গণতন্ত্র বলে নির্বাচনের ফলাফলকে স্বাগত জানিয়ে ছিলেন চার্চিল। অবশ্য ১৯৫১ সালের নির্বাচনে আবারো ক্ষমতায় আসেন স্যার উইন্সটন চার্চিল।
গণতন্ত্র বড় কঠিন! গণতন্ত্রের কাছে জনপ্রিয়তা ধরা খাওয়ার প্রমাণতো আমরা এই কিছুদিন আগেও দেখেছি। কট্টর বামপন্থী সাবেক লেবার নেতা জেরেমি করবিনের জনপ্রিয়তা কি কম ছিল? কিন্তু ভোটে তিনি ক্ষমতার মুখ দেখেননি একবারও। জনপ্রিয়তা এবং রাজনীতি দুটি আলাদা। ব্রেক্সিটের ফলে বরিসের জনপ্রিয়তা বেড়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে। ভ্যাকসিনের ফলেও হয়তো কিছুটা জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে পারে কিন্তু নির্বাচনের মাঠে ভোটারদের মনে কি আছে কে জানে? করোনা মহামারীর পর প্রায় ৪৮ লাখ ভোটার ভোট দেবেন ৬ মে। কিন্তু স্যার কিয়ার স্টারমার টিক মতো নাড়তে পারলে এই নির্বাচনেই বরিস জনসনের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। সফল আইনজীবি স্যার কিয়ার স্টারমার রাজনীতিতে এখনো কাঁচা বলে একটি ধারণা রয়েছে নির্বাচনে এই ধারণাটি ভুল প্রমানেরও সুযোগ পাচ্ছেন তিনি। তাতে সফল হলেন কি না তার উত্তর পাওয়া যাবে শনিবার রাতে। কারণ করোনা বিধি নিষেধের কারণে কারণে এবার নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব হবে।
লেখক : হেড অব নিউজ, চ্যানেল এস এবং সম্পাদক, ব্রিটবাংলা২৪.কম