মুহম্মদ জাফর ইকবাল
আমাদের বয়সী যে কোনো মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন কোনটি? সে অবধারিতভাবে বলবে, সেটি হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আমি মনে করি, আমাদের বয়সী মানুষেরা যারা সেই দিনটিতে বাংলাদেশের জন্ম হতে দেখেছি, সেই সময়ের তীব্র আনন্দটুকু পৃথিবীর খুব কম মানুষই অনুভব করেছে। আমরা খুবই সৌভাগ্যবান একটি প্রজন্ম যারা সেই অবিশ্বাস্য আনন্দটুকু অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিলাম। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সেই দিনটিতে যখন একজনের সাথে আরেকজনের দেখা হয়েছে তখন প্রথম অনুভূতিটি হচ্ছে এক ধরনের বিষাদ, কারণ সারা দেশে একজন মানুষও ছিল না যার কোনো না কোনো আপনজন বা প্রিয়জন সেই যুদ্ধে মারা যায়নি। নতুন বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম কল্পনাও করতে পারবে না একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য একটি দেশের মানুষ কতো বড় আত্মত্যাগ করেছে। বাংলাদেশের পতাকার মাঝখানে যে লাল বৃত্ত, সেটি সাধারণ মানুষের কাছে শুধুমাত্র একটুকরো লাল কাপড়, কিন্তু আমরা জানি সেই লাল রংটুকু কোথা থেকে এসেছে, আমরা জানি সেই লাল রঙে আমাদের সব আপনজনের বুকের রক্ত একটুখানি হলেও আছে।
১৯৭১ সালের বিজয়ের আগের দিনগুলোর স্মৃতি আমাদের এখনো এতো স্পষ্টভাবে মনে আছে যে মনে হয় এটি মাত্র সেদিনের ঘটনা। আমাদের পুরো পরিবার তখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, কে কোথায় আছে কেমন আছে, আদৌ বেঁচে আছে কী না আমরা কিছুই জানি না। আমি যাত্রাবাড়ীতে একটা পরিবারের সাথে অনেকগুলো শিশুকে নিয়ে আছি। ১৯৭১-এর যাত্রাবাড়ী আজকের যাত্রাবাড়ীর মতো নয়, মোটামুটি ফাঁকা। রাস্তার দু’পাশে বাড়িঘর নেই। আমি যেখানে আছি তার চারপাশে ছোট একটা জনবসতি।
তখন শেষ যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দিনরাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। শেলিং হচ্ছে একটা দুটো শেল, আশেপাশে পড়ছে- সেরকম খবরও ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে এতো কাছ থেকে এতো তীব্র গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই যে মনে হয় এই বুঝি সেগুলো আমাদের গায়ে এসে লাগবে। এরকম সময়ে কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা যায় না। তাই কিছু একটা করার উদ্দেশ্যে একটা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে ঘরের উঠোনে একটা ট্রেঞ্চ খুঁড়ে ফেলা হলো। ট্রেঞ্চের উপর একটা ঢেউটিনের আস্তরণ। যখন গোলাগুলির শব্দ খুব বেড়ে যায় তখন বাচ্চাগুলোকে নিয়ে সেই ট্রেঞ্চের ভেতর বসে থাকি।
বাড়িটার পাশেই রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে মিলিটারির বহর যাচ্ছে এবং আসছে। একদিন মিলিটারিরা সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটা স্কুটারের সব যাত্রীকে মেরে ফেলল। আমরা দেখতে পাই, স্কুটারের ভেতর থেকে মৃত মানুষগুলোর হাত-পা বের হয়ে আছে। মৃত মানুষগুলো প্রকাশ্য রাস্তায় স্কুটারের ভেতর দিনের পর দিন পড়ে আছে, কেউ সেটা নিয়ে বিচলিত হচ্ছে না।
একসময় লক্ষ করলাম রাস্তা দিয়ে বড় বড় ট্যাংক ঘড়ঘড় শব্দ করে ঢাকার দিকে ফিরে যাচ্ছে। তার সাথে সাথে অসংখ্য পাকিস্তানি মিলিটারি। পশ্চাদপসরণ বলে একটা শব্দ আছে, এই মিলিটারি বাহিনীকে দেখলেই বোঝা যায় তারা সেই পশ্চাদপসরণ করছে। প্রাণের ভয়ে? আমরা দূর থেকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকি।
ঠিক সেই সময় একদিন যখন সূর্যের আলো নিভু নিভু, অন্ধকার নেমে আসছে, গোলাগুলির শব্দ কমে আসছে, তখন নৈঃশব্দ বিদীর্ণ করে একজন চিত্কার করে উঠল— ‘জয় বাংলা’।
মুহূর্তের মাঝে আমরা বুঝে গেলাম দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষ হয়েছে, যে স্বাধীনতার জন্য বুভুক্ষের মতো আমরা অপেক্ষা করছিলাম সেই অপেক্ষার শেষ হয়েছে। সেটি জানার জন্য আমাদের প্রয়োজন ছিল শুধু একটি শ্লোগান! জয় বাংলা।
কী আশ্চর্য! মুক্তিযুদ্ধের সেই শ্লোগানটি এই দেশে নির্বাসিত হয়েছিল। শুধু শ্লোগানটি নয় যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য এই শ্লোগান সেই মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল, দেশের শাসক হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত স্বাধীনতার শত্রুরা। জয় বাংলা শ্লোগানটি ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে ছিল শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের কর্মীদের মাঝে। কেউ সেই শ্লোগানটি উচ্চারণ করলেই মানুষ ধরে নিতো সেই মানুষটি নিশ্চিতভাবে আওয়ামী লীগের কর্মী। দেশের মানুষ মনে হয় ভুলেই গেল যে কোনো রাজনৈতিক দলের শ্লোগান ছিল না এটি। এই শ্লোগানটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র গর্জে ওঠার আগে তাদের কণ্ঠ থেকে প্রকম্পিত হতো এই শ্লোগান।
গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই যে তারা মুক্তিযুদ্ধের সেই শ্লোগানটি আবার আমাদের উপহার দিয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না হয়েও এখন একজন শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর ভালোবাসায় জয়বাংলা শ্লোগানটি দিতে পারে!
২.
বাংলাদেশটি আমরা এমনি এমনি পাইনি। এই দেশটি পাওয়ার একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। একসময় আমরা পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। সেই পাকিস্তান দেশটির জন্যে যে লাহোর প্রস্তাব ছিল সেখানে বহুবচনে দুটি দেশের কথা বলা হয়েছিল। ‘মুদ্রণ প্রমাদ’ বলে দুটি দেশের ধারণাটিকে সরিয়ে একটি পাকিস্তান তৈরি করা হয়েছিলো। আমরা জন্ম থেকে দেখে এসেছিলাম বলে মেনে নিয়েছিলাম। এখন নিশ্চয়ই সবাই চোখ কপালে তুলে বলে, এটি কীভাবে সম্ভব? একটি দেশের দুই টুকরো দুই জায়গায়, মাঝখানে হাজার কিলোমিটার দূরত্ব? সেটিই ছিল আজব স্থান পাকিস্তান! জনসংখ্যায় আমরাই ছিলাম বেশি অথচ সম্পদের বড় অংশ ভোগ করতো পশ্চিম পাকিস্তান। পুরো দেশটিই যে ছিল ষড়যন্ত্রের জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা একটি দেশ সেটি বুঝতে বাঙালিদের মাত্র বছর খানেক সময় লেগেছিল— যখন পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা এসে ঘোষণা দিয়ে গেলেন- ‘উর্দু এবং শুধুমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলন হলো, রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হলো। চুয়ান্ন সালে বঙ্গবন্ধু আর সহনেতারা প্রাদেশিক নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করলেন কিন্তু বছর ঘোরার আগেই সেই সরকারকে বাতিল করে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু তখন একজন তরুণ রাজনৈতিক নেতা কিন্তু তার বুঝতে বাকি রইল না যে পাকিস্তানের এই ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তিলাভের একটিমাত্র উপায় সেটা হচ্ছে স্বায়ত্তশাসন। তিনি ছয়দফার আন্দোলন শুরু করেন।
এই দেশের নতুন প্রজন্মের যারা দেশকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাদের সবার এই ছয়টি দফা একবার হলেও পড়ে দেখা উচিত, তাহলে তারা অবাক হয়ে আবিষ্কার করবে যে ছয়দফা আসলে একটিমাত্র দফা, যার আসল অর্থ হচ্ছে স্বাধীনতা!
পাকিস্তানে তখন আইউব খানের সামরিক শাসন, বঙ্গবন্ধু আর তার সহকর্মীরা বেশিরভাগ সময়েই জেলখানায় থাকেন। রাজনৈতিক নেতাদের বলতে গেলে কেউই বাইরে নেই, ছাত্ররা আন্দোলন করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনল। (আজকাল কেউ কল্পনা করতে পারবে, এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রলীগ আছে, ক্যাফেটারিয়া-ক্যান্টিনে ফাউ খাওয়ার চেয়ে যারা বড় কিছু চিন্তা করতে পারে না, তাদের পূর্বসূরীরা একসময় এতো বড় বড় কাজ করেছে?)
ঊনসত্তুরের বিশাল গণ-আন্দোলনে সামরিক শাসক আইউব খানের পতন হলো, ক্ষমতা দেয়া হলো সর্বকালের নৃশংস দানব ইয়াহিয়া খানের কাছে— তখনো আমরা তার সেই পরিচয়টির কথা জানি না।
সত্তুরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফার প্রতি স্বীকৃতি জানিয়ে বাঙালিরা তাকে একটা অভূতপূর্ব বিজয় উপহার দেয়। বাঙালিরা প্রথমবার এই দেশের শাসনভার গ্রহণ করবে, পাকিস্তানি মিলিটারির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তাদের বিশাল ষড়যন্ত্রের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তারা নির্বাচনের রায় অস্বীকার করা মাত্রই সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন, তার অঙুলি হেলনে এই দেশ চলতে শুরু করল। মার্চ মাসের সাত তারিখ রেসকোর্সে তিনি তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি দিলেন, সেটি শুনলে এখনো আমার শরীরে শিহরণ হয়!
২৫ মার্চ পাকিস্তান মিলিটারি এই দেশে গণহত্যা শুধু করল, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ!
নয় মাসের সেই যুদ্ধের ইতিহাস হচ্ছে আত্মত্যাগের ইতিহাস, বীরত্বের ইতিহাস আর অর্জনের ইতিহাস। পৃথিবীর কয়টি দেশ এরকম একটি গৌরবের ইতিহাস দাবি করতে পারবে?
৩.
বাংলাদেশের একটি কালো অধ্যায়ের সময় ছিল যখন সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করা হতো কিংবা খাটো করে দেখানো হতো। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বোঝানো হতো বঙ্গবন্ধু বলে কেউ নেই, কেউ ছিল না, জিয়াউর রহমান নামের একজন মেজরের ঘোষণায় এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। রাজাকার শব্দটি উচ্চারণ করা যেতো না। পাকিস্তান বলা যেতো না, বলতে হতো হানাদার। যারা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতেন তাদের শাসন করা হতো, শাস্তি হিসেবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি করে দেয়া হতো। যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা উচ্চারণ করলে দেশদ্রোহী হিসেবে মামলা করে দেয়া হতো।
ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আমাকে জিজ্ঞেস করতো- ‘স্বাধীনতার ঘোষক কে?’ (স্বাধীনতা যেন একটি ছেলের হাতের মোয়া, কোনো একজন তার কথা ঘোষণা করলেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়!) তারা জিজ্ঞেস করতো রাজাকাররা কেমন করে মন্ত্রী হয়? যারা এই দেশ চায়নি, এই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে তারা কেমন করে এই দেশ শাসন করে? তারা কেমন করে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়? আমাদের অনেক বড় সৌভাগ্য সেই দুঃসময়কে আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। কেউ আমাদের কাছে জানতে চায় না স্বাধীনতার ঘোষক কে? নতুন প্রজন্ম এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ওরা পাঠ্যবইয়ে পড়েছে, নিজের কানে শুনতে পেয়েছে। শুধু তাই নয়, এই দেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে দেখেছে, দেশকে গ্লানিমুক্ত হতে দেখেছে।
এই দেশকে নিয়ে অনেকের অনেক কিছু চাওয়ার আছে, আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। এই দেশ থেকে আমি যা চেয়েছিলাম তার থেকে বেশি পেয়েছি! বিজয় দিবসের প্রাক্কালে নতুন প্রজন্মের কাছে আমার শুধু একটি মাত্র প্রত্যাশা- ‘যেটুকু পেয়েছি সেটি যেন কোনোভাবে আবার হারিয়ে না ফেলি’।
লেখক :কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট