আ স ম মাসুম:যুক্তরাজ্য : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চতুর্থবারের মতো ব্রিটেনে আসেন ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে।
এর আগে ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতের একটি হোটেলে মৃত্যুবরণ করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এর ফলে ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারী শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে পাকিস্তান আওয়ামীলীগকে পূনরূজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। সেই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য গুনগত পরিবর্তন আসে।
তখন আইয়ূব খানের কেন্দ্রীয় শাসন দেশের দুই অংশের মাঝে বৈষম্য আরো বাড়িয়ে তোলে। ফলে দেশ-বিদেশে বাঙ্গালীদের মধ্যে অসন্তোষ আরও তীব্রতর হয়।
পাকিস্তান আওয়ামীলীগের দায়িত্ব নিয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছুটে আসেন লন্ডনে। বলা যায় এটাই তার প্রথম সাংগঠনিক সফর, যদিও তখনও ব্রিটেনে আওয়ামীলীগের কোন দলীয় কার্যক্রম ছিলো না।
তবে ঐতিহাসিকভাবে এই সফরের গুরুত্ব অনেক। আগরতলাকে ব্যবহার করে গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনাকে পাকাপোক্ত করতেই বঙ্গবন্ধুর সেই সফর ছিলো।
এই সফরেও তিনি আব্দুল মান্নান ছানু মিয়ার আথিতেয়তা গ্রহন করেন।
৬৪ সালের এই সফরে বঙ্গবন্ধু ব্রিটেনের ততকালীন বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের সাথে দেখা করেন। এক পর্যায়ে তিনি লন্ডনে তার পুরোনো রাজনৈতিক সহকর্মী লন্ডন প্রবাসী তাসাদ্দুক আহমদের সাথে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হোন।
২১ রমিলি ষ্ট্রিট, লন্ডন ডব্লিউওয়ান এর ততকালীন বাঙ্গালী নেতৃত্বাধীন পাকিস্থান ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন এর অফিসে সেই একান্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর সেই সফর কতোদিনের ছিলো সে সম্পর্কে তেমন ধারনা পাওয়া না গেলেও দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হওয়ায় সফর অর্ধ সমাপ্ত রেখে সংক্ষিপ্ত রেখে চলে যান দেশে।
তবে তাসাদ্দুক আহমেদ ও শেখ মুজিবুর রহমানের সেই গোপন বৈঠক সম্পর্কে লেখক-সাংবাদিক আব্দুল মতিন বলেন, শেখ সাহেব চলে যাওয়ার পর আমি তাসাদ্দুককে জিজ্ঞেস করলাম, কি বললেন তিনি? তাসাদ্দুক বললো, ১৯৬০ সালে তিনি ( বঙ্গবন্ধু ) আমাকে ( আব্দুল মতিন ) আগরতলা থেকে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করার সম্ভাবনা সম্বন্ধে যে ইঙ্গিত দেন, তারই পূনরাবৃত্তি করেন।
এ ধরনের গুরুত্বপূর্ন বিষয় শত্রুপক্ষ ঠের পেলে তিনি (বঙ্গবন্ধু ) বিপদগ্রস্থ হবেন, আশঙ্কা করে আমি ও তাসাদ্দুক এ সম্পর্কে কারো সাথে আলোচনা না করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করি।
উল্লেখ্য ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হওয়ার পর ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গৃহবন্দি হিসাবে দিন কাটাচ্ছিলেন।
তখন একদিন সাংবাদিক আব্দুল মতিনের সাথে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি ইঙ্গিত দেন যে, আইয়ূব বিরোধী সংগ্রামে প্রয়োজনে তিনি আগরতলাকে ব্যবহারের কথা। ঠিক একই কথা তিনি লন্ডনে তাসাদ্দুক আহমদকেও বলেন।
উল্লেখিত ইঙ্গিত ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সাথে আর কি কি আলাপ হয়েছিলো নিরাপত্তা জনিত কারণে তাসাদ্দুক আহমদ প্রকাশ না করলেও ধারনা করা হয় আগরতলাকে গেরিলা যুদ্ধের জন্য ব্যবহারের পাশাপাশি লন্ডনকেও কিভাবে ব্যবহার করা যায় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ন আলাপ-আলোচনা হয়ে থাকবে।
বিষয়টি সম্পর্কে আরো গুরুত্বপূর্ন তথ্যের উল্লেখ করেছেন আব্দুল মতিন। তিনি কূটনৈতিক সূত্রে জানা সেই তথ্য সম্পর্কে বলেন, ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের দুই মাস পর শেখ মুজিব পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা অর্জনের এক সূদুরপ্রসারী পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য গভীরভাবে চিন্তা করে স্থির করেন, পাকিস্থান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রচ্ছন্ন সংগ্রামের পরিবর্তে সারা দুনিয়াকে জানিয়ে তাকে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী লন্ডন পৌছানোর পর তিনি বাংলাদেশের জন্য প্রবাসে অস্থায়ী সরকার গঠন করবেন। এরপর তিনি ব্রিটেন, আমেরিকা ও ততকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সমর্থন ও সাহায্যের আবেদন জানাবেন। এ ব্যাপারে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের সাহায্য সবচেয়ে বেশি জরুরী বলে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। ভারতের সাহায্য পাওয়া যাবে কিনা তা জানার জন্য তিনি ঢাকায় নিয়োজিত ভারতীয় কাউন্সিলর অফিসার মি. শশাঙ্ক এস ব্যানার্জির সাহায্য গ্রহন করেন।
শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী সেই ঘটনা সম্পর্কে বলেন, তিনি, বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ঢাকায় নিযুক্ত ডেপুটি হাই কমিশনার সৌর্য কুমার চৌধুরী ও গোয়েন্দা প্রধান কর্নেল শৈলেন চন্দ্র ঘোষ রাত দুইটায় মানিক মিয়ার বাসায় শেখ মুজিবুর রহমান ও মানিক মিয়ার সাথে বৈঠকে মিলিত হোন গোপনে। সেখানে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি স্বাধীনতা আন্দোলন পাকিস্থানে বসে কি করে করবো! আমি লন্ডনে গিয়ে তা করতে চাই। সেখানে মুখ খুলতে পারবো। তখন সৌর্য কুমার চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহেরুর সঙ্গে আলোচনা করার পর তাকে ভারতের মনোভাব জানানো হবে।
ভারতের কাছে সেসময় প্রস্থাবটি পাঠানো হলেও তারা তখনকার বাস্তবতার কারনে তারা সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তাই শশাঙ্ক এস ব্যানার্জির সেই চেষ্টাও বিফলে যায়। তবে ঠিক ১০ বছর পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী ইতিহাসের মঞ্চ আলোকিত করে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি যে সারাজীবনের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গী হয়ে যাবেন সেটা তিনি নিজেও ভাবতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর পাকিস্থান থেকে ছাড়া পেয়ে ব্রিটেন হয় স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পাশের চরিত্রের নাম যে ততকালীন ব্রিটেনস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের রাজনৈতিক কর্মকর্তা শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি!