ভোট নিয়ে তামাশার শেষ কোথায়?

মারুফ মল্লিক :: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচন, বহুল প্রত্যাশিত ডাকসু নির্বাচন আশার খোরাক জুগিয়েছিল। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই না, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরাও একটু নড়েচড়ে বসেছিলেন যে, এবার শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নির্বাচন হবে। আমরাও যারা শিক্ষার্থী সংসদবিহীন শিক্ষাজীবন শেষ করেছি বা শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচন দেখিনি, তাদের মধ্যেও এক ধরনের চাঞ্চল্য এসেছিল। জাতীয় নির্বাচন যা-ই হোক, এবার দেশের প্রধান শিক্ষাঙ্গনে জম্পেশ নির্বাচন দেখতে পারব। তাতে হয়তো সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর একচেটিয়া দাপটের অবসান হবে, হয়তো হবে না; কিন্তু নির্বাচন তো হবে!

আমার যারা ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেখিনি বা পাইনি; তারা অতীতে ওই সময় দেখেছি সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক রীতিমতো ভিপি-জিএসের মর্যাদা ভোগ করেন। এটা সব সরকারের আমলেই হয়েছে। এবার অন্তত অনির্বাচিত এই মর্যাদা ভোগের অবসান হবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। ছাত্রলীগ ছাড়া প্রায় সব ছাত্রসংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নানা অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করেছেন। ঢাবির জন্য এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক ঘটনা।

বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন ধরেই কোনো নির্বাচন অনিয়ম ছাড়া হয় না। ডাকসু নির্বাচন নিয়েও কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছিল। বিরোধী প্রার্থীদের সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের হুমকি, ধমকি, মারধরের খবর পড়েছি। বিভিন্ন দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এসব অভিযোগকে গ্রাহ্যই করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বরং একটি নির্বাচনকে যতভাবে বিতর্কিত করা সম্ভব, তার সব উদ্যোগই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়েছিল। গণমাধ্যমের প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, হলগুলোতে ভোটের ব্যবস্থা, আগের রাতেই ব্যালট বাক্স হলে হলে পাঠিয়ে দেওয়া, অস্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা—এসবে ঢাবি কর্তৃপক্ষের একপেশে আচরণ একেবারেই স্পষ্ট।কুয়েত মৈত্রী হলে ভোটের চিহ্ন দেওয়া ব্যালট পাওয়ার পর বিক্ষোভ শুরু করেন ছাত্রীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১১ মার্চ। ছবি: ফোকাস বাংলাধারণা ছিল ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচন বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো থেকে অন্তত ভিন্ন হবে। এখানে ক্ষমতার পালাবদলের কোনো বিষয় নেই। শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির সংযোগ অবশ্যই আছে। কিন্তু এর কারণে ত্বরিত কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের শঙ্কা বা সম্ভাবনা নেই। ডাকসু বা শিক্ষার্থী সংসদের নির্বাচন এমন এক নির্বাচন, যেখানে কেউই হারে না, বরং অর্জন করে। এখানে অর্জনের অনেক কিছুই থাকে। স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, উদারতার উদাহরণ হয়ে থাকার সুযোগ থাকে। চলমান স্রোতের বিপরীতের নিজেকে উজ্জ্বলতর করে তুলে ধরার অর্জন থাকে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে ঢাবি কর্তৃপক্ষ বা ছাত্রলীগ সেই অর্জনের পথ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিল। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের সময় দেখেছি, নির্বাচন কমিশন একটি বধির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ নির্বাচনকে নিয়ে নানা ধরনের কথা প্রচলিত আছে। নির্বাচনের আগেই অভিযোগগুলো উত্থাপিত হচ্ছিল। কিন্তু কমিশন কিছুই শোনেনি না বোঝেনি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সম্প্রতি বলছেন, নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন পদ্ধতি প্রয়োগ করলে আগের রাতে ব্যালট ভরে রাখার সুযোগ থাকে না। তার মানে কী? আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখা হয়েছিল? এ রকম অভিযোগ কিন্তু বিরোধীদের পক্ষ থেকে বরাবরই ছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনের বক্তব্যে কি সেই কথারই প্রতিফলিত হচ্ছে না? আর আগের রাতে যদি বাক্স ভরেই রাখা হয়, তবে কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আচরণ কিন্তু ঠিক কমিশনের মতোই হয়েছে। শিক্ষকেরা সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি। শ্রদ্ধার উচ্চ আসন তাঁদের। তাঁরা শিক্ষা দান করবেন। গবেষণা করবেন। রাজনীতির পঙ্কিল চক্রে নিজেদের মিলিয়ে ফেলা সমীচীন না। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি, এক শ্রেণির শিক্ষক দিন দিন নিজেদের হাস্যাস্পদ করে ফেলছেন। তাঁদের সংখ্যাও কম নয়। এমন জায়গায় এমনভাবে এমন সব বিষয়ে তাঁরা বক্তব্য দিচ্ছেন; মনে হচ্ছে তাঁদের তাল-জ্ঞান নেই।ডাকসু নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন বেশির ভাগ প্যানেলের প্রার্থী ও শিক্ষার্থীরা। তাঁরা নির্বাচন বাতিলের দাবি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১১ মার্চ। ছবি: দীপু মালাকাররোকেয়া হলের একটি কক্ষে ব্যালট-ভর্তি বাক্স রাখা হয়েছে—এমন অভিযোগ পেয়ে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সহসভাপতি প্রার্থী নুরুল হক গিয়েছিলেন রোকেয়া হলে প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু সেখানে নুরুল যাওয়ার পর যা হয়েছে, তা খুবই মর্মান্তিক। প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশন না আসা পর্যন্ত প্রাধ্যক্ষ নুরুলকে ওই কক্ষে যেতে বাধা দেন। পরে প্রক্টর ও ছাত্রলীগের প্রার্থীরা আসেন। সেখানে বৈঠক শেষে নুরুল বেরিয়ে এলে ছাত্রলীগের কর্মীরা নুরুলের ওপর হামলা করেন। এখানে লক্ষণীয় যে হলের প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টর, নির্বাচন কমিশনার ও ছাত্রলীগের প্রার্থীদের উপস্থিতিতে নুরুলের ওপর হামলা হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাবি প্রক্টর স্তম্ভিত হওয়ার মতো বক্তব্য দিয়েছেন গণমাধ্যমে। তিনি বলেছেন, নুরুলকেই জিজ্ঞাসা করুন কেন ছাত্রীদের হলে গিয়েছিলেন। কখনো কখনো শিক্ষকদের আচরণ একেবারেই দলীয় ক্যাডারদের মতো হয়ে যায়। একজন শিক্ষকের কতটা অধঃপতন হলে নিজেকে দলীয় ক্যাডারদের পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারেন?

যা-ই হোক, ছাত্রলীগ বাদে প্রায় সবার বর্জনেই নির্বাচন শেষ হয়েছে। এখন ফলাফলের অপেক্ষা। কিন্তু এ রকম নির্বাচনে সবাই আশাহত হয়েছে। এখানে গ্লানি ছাড়া আর কোনো অর্জন নেই। এই গ্লানি সবার জন্যই। শুরুতেই বলেছিলাম, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আমার আশাবাদী হয়েছিলাম। ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু আর কত? এভাবে আমরা কতবার প্রতারিত হব। ভোট নিয়ে তামাশার শেষ কোথায়? বরং এই তামাশার নির্বাচন আয়োজন না করে নিজেদের মনোনীত ঘোষণা করে দিলেই ভালো হয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট ছাত্র সংসদ ঘোষণা করে দেবে। এতে করে শিক্ষার্থী, জনগণ অন্তত মানসিক ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাবে।

Advertisement