।। ড. রাশিদ আসকারী ।।
চলতি বছর অর্থাত্ ২০১৭ সালকে নেপালের জন্য নির্বাচনের বছর বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। বস্তুত ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশটির প্রথম প্রজাতান্ত্রিক সংবিধানের তাগিদ অনুযায়ীই ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারির আগেই একটি নতুন পার্লামেন্ট গঠন করার জন্যই পর্যায়ক্রমিকভাবে স্থানীয় সরকার, প্রাদেশিক সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি নির্বাচন সম্পন্ন করা হচ্ছে। অধুনার ফেডারেল ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব নেপাল সাতটি প্রদেশ, ৭৫টি জেলা, ৭৪৪টি স্থানীয় ইউনিট, চারটি মেট্রোপলিস, ১৩টি উপ-মেট্রোপলিস, ২৪৬টি মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল এবং ৪৮১টি গ্রাম দ্বারা গঠিত। মে মাসে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যে এসয স্থানীয় প্রশাসনিক অঞ্চলে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছে এবং একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এদিকে ২৭৫ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সভার (হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস্) দুই পর্যায়ের নির্বাচনও শুরু হয়েছে। এই ২৭৫ জন সদস্যের মধ্যে ৬০ শতাংশ প্রতিনিধি ফাস্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (FPTP) পদ্ধতিতে এবং বাকি ৪০ শতাংশ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) নির্বাচিত হবে। নেপালের ফেডারেল পার্লামেন্ট মূলত একটি দুইকক্ষবিশিষ্ট আইন পরিষদ যাতে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে নির্বাচিত ২৫৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি জাতীয় পরিষদসহ (National Assembly) হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস থাকবে। জাতীয় পরিষদ এবং প্রতিনিধি সভায় সদস্যদের মোটামুটি সমান ক্ষমতা থাকবে এবং তারা পরস্পরের পরিপূরক হবে।
নেপাল নামের হিমালয়ের কোল ঘেঁষা ছোট্ট দেশটি ২৩৯ বছরের পুরনো রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পর এবং দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসানের পর গণতন্ত্রায়নের কন্টকাকীর্ণ পথে যাত্রা শুরু করেছে। ২০১৫ সালে পাস হওয়া নতুন সংবিধানের শর্ত মোতাবেক নতুন বছরের ২১ জানুয়ারির মধ্যে নতুন সংসদ গঠিত হতে পারলে এই যাত্রা নিশ্চয়ই আরো বেগবান হবে। ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় দক্ষিণ এশিয়ার এই অন্যতম দরিদ্র দেশটি নানা কারণেই ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। দেশটির ২৮ মিলিয়ন অধিবাসীর মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশই দৈনিক দুই ডলারের নিচে উপার্জন করে। এদিকে বছর বছর সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেপালের দুর্বল অর্থনীতিতে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো চেপে রয়েছে। তাছাড়া দেশটির উপর আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় ভারত এবং চীনের ধস্তাধস্তিও কখনো কখনো এর কাঙ্ক্ষিত বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সব মিলে রাজনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল এবং গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে নেই দেশটির সামনে। তাই নেপালের এই চলমান নির্বাচন সব বিবেচনাতেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটি সম্ভবত দেশটির সচেতন জনগণ বুঝতে পেরেছে। তাই ২৬ নভেম্বরের প্রথম দফার নির্বাচনে কাঠমুন্ডুর তীব্র শীত উপেক্ষা করে বরফ ঠেলে জবুথবু হয়ে মানুষকে দেখা গেছে ভোটকেন্দ্রে উপচে পড়তে। দুই দফার এই নির্বাচনে দেশটির ১৫ মিলিয়ন ভোটার অংশগ্রহণ করতে পারবে। প্রথম দফার নির্বাচনে ৬৫ শতাংশ উপস্থিতির পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. আয়োধী প্রসাদ যাদব সোত্সাহে ঘোষণা করেন যে, প্রথম দফার ৩২ জেলার নির্বাচনে নেপাল ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছে। একই সঙ্গে মানুষ এই প্রথমবারের মতো ৭টি প্রাদেশিক পরিষদের ৫৫০ জন প্রতিনিধি নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করছে। নতুন সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত এসব নির্বাচন নেপালের রাজনৈতিক পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটানোর পথ সুগম করবে বলে নেপালের মানুষ মনে করছে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ফেডারেল এবং প্রাদেশিক পরিষদে নারী, আদিবাসী এবং নিচুবর্ণের দলিতদের প্রতিনিধিত্বের বিধান সন্নিবিষ্ট করায় এ নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে জাতিগত ঐক্য এবং জাতীয় সংহতি সৃষ্টির পথ উন্মোচিত হবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। নেপালের আমজনতা আর সংঘাত-সহিংসতা চায় না। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত স্বার্থান্বেষী মহলের দ্বারা ঘনঘন ক্ষমতার পরিবর্তন চায় না। তারা চায় টেকসই উন্নয়ন, চায় উন্নত রাস্তাঘাট, পানি সরবরাহ, বিদ্যুত্, স্বাস্থ্যসেবা এবং কর্মসংস্থান। তারা চায় না তাদের সন্তানেরা আর শিশুশ্রমের জাঁতাকলে পিষ্ট হোক। আর এসব নিশ্চিত করার জন্যে তারা চায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। গত ১১ বছরে ১০ জন প্রধানমন্ত্রী দেখে তারা ক্লান্ত। তাদের এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশটিকে বৈশ্বিক উন্নয়নের মহাসড়কে এমনকি প্রতিবেশি দেশগুলোর সহযাত্রীও হতে দিচ্ছে না। তাই চলমান নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী সরকার ব্যবস্থা এবং একটি টেকসই উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখার জন্যে নেপালের মানুষ এখন ব্যালট বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছে। এ কম বড় কথা নয়।
নেপালে নতুন সরকার গঠনের দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে, ততোই সবার কৌতূহল ঘনীভূত হচ্ছে। কে বা কারা পাচ্ছেন নেপালের পরবর্তী কাঙ্ক্ষিত সরকারের দায়িত্ব। প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে চীন এবং ভারতের কৌতূহলটা যেন একটু বেশিই। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে চীন এবং ভারতের ঠান্ডা প্রতিযোগিতার প্রভাব যে নেপালের চলমান নির্বাচনে পড়বে না তা বলা মুশকিল। নেপালের নির্বাচনের মূল উত্তাপ প্রধানত নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি, ইউনিফাইড মার্কসিস্ট-লেলিনিস্ট (CPN-UML) এবং সিপিএন-এর বাম জোট এবং কেন্দ্রীয় নেপালি কংগ্রেস-এর নেতৃত্বাধীন ডেমোক্র্যাটিক ব্লককে কেন্দ্র করেই ছড়াচ্ছে। এ জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল সাধারণত অনিশ্চিত হলেও আনষঙ্গিক নানান সূচক দিয়ে তার প্রবণতা ব্যাখ্যা করা যেতেই পারে। প্রতিনিধি সভার (House of Representatives) ২৭৫ জন সদস্যের মধ্যে সরকার গঠন করতে ১৩৮টি আসন অধিকার করার প্রয়োজন রয়েছে। নেপালের সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফলের ওপর গুরুত্ব দিলে নেপালের আসন্ন ফেডারেল সরকার নির্বাচনে বাম জোটেরই এগিয়ে থাকবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালের যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন এবং যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট ভোটের ফলাফল প্রবণতার দিকে তাকালে কংগ্রেস-এর সাফল্যের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে বাম জোট কিংবা কংগ্রেস জোট যারাই জয়লাভ করুক না কেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নেপালের ভবিষ্যত্ রাজনীতি এই দুই জোটকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে এবং বাম জোট সংগত কারণেই চীনের দিকে এবং নেপালী কংগ্রেস জোট ভারতের দিকে ঝুঁকে থাকবে। তবে মজার ব্যাপার হলো, ভারত এবং চীনের মধ্যে নেপালের আসন্ন সরকারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে মেরু-বৈপরীত্য বিদ্যমান থাকলেও উভয় দেশই নেপালে একটি টেকসই সরকার প্রত্যাশা করে। কারণ, পরস্পর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে নেপালের সাথে চীন এবং ভারতের সম্পর্কোন্নয়নের জন্যে নেপালের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এক অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত। তাই দিল্লি এবং বেইজিং উভয়ই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে নেপালের চলমান নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে এবং এ নির্বাচনকে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ববহ করে তুলছে।
নেপালে এখন নির্বাচনী উত্সব চলছে। শতাব্দী-প্রাচীন রাজতন্ত্রের জগদ্দল পাথর এবং দশক-বিস্তারী সহিংস আদর্শিক উগ্রবাদের তাণ্ডবে উপদ্রুত নেপাল এখন প্রজাতন্ত্রের পথে পা বাড়িয়েছে শান্তির অন্বেষায়। চলমান নির্বাচনগুলো সফল হলে সে অগ্রযাত্রায় অনেকগুলো মাইলফলক যুক্ত হবে। নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের মধ্যে সুসমন্বয়ের মধ্য দিয়ে পরিচালিত নির্বাচন প্রক্রিয়া কিছু বাধা বিপত্তি ডিঙিয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রতিকূল ভৌগোলিক অবস্থা এবং আবহাওয়া সত্ত্বেও ভোটকেন্দ্রে টার্নআউট আশাব্যঞ্জক। ৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফা ভোটগ্রহণ শেষ হলে একযোগে গণনা শুরু হবে। ফলাফলে হারজিত মেনে নেওয়ার মানসিকতাও প্রদর্শন করেছে অংশগ্রহণকারী দল/ জোটগুলো। উগ্রবাদী কিছু আণ্ডারগ্রাউণ্ড গোষ্ঠী বিচ্ছিন্নভাবে নির্বাচন ব্যাহত করতে চাইলেও সার্বিক পরিস্থিতি সুনিয়ন্ত্রিত রয়েছে। বস্তুত দলমত নির্বিশেষে নেপালের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই নির্বাচনের সাফল্য দেখতে চাইছে। এই নির্বাচন নেপালিদের জন্যে এক রাজনৈতিক অগ্নিপরীক্ষা। প্রাচীন রাজতান্ত্রিক হিন্দু রাষ্ট্র থেকে আধুনিক, প্রজাতান্ত্রিক ফেডারেল সেক্যুলার রাষ্ট্রে উন্নীত হওয়ার এই প্রক্রিয়ায় বর্তমানের নির্বাচন অসামান্য ভূমিকা রাখবে। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত বৈচিত্র্যময় নেপালে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টির জন্য এই নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নেপালের চলমান প্রাদেশিক সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি নির্বাচনের সাফল্য যেমন নেপালের জনগণের প্রত্যাশা, তেমনি আমাদেরও প্রত্যাশা। নেপালিদের এখন প্রমাণ করবার সময় এসেছে যে, হিমালয় পাদদেশের এই অকুতোভয় শেরপারা কেবল পর্বতচূড়ায় আরোহণেই দক্ষ নয়, গণতন্ত্রের চূড়ায় আরোহনেও পারদর্শী।
n লেখক: অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক