বিশেষ প্রতিনিধি : উনিশ শতকের সত্তরের দশকে গ্রেটার লন্ডনের বাঙালী পাড়া টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালীরা বসতি শুরু করেন এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং সফল আন্দোলনের মাধ্যমে শক্ত ঘাটি গড়েন। তবে বিলেতের অর্থনীতিতে বাঙালীদের অবদানের সূচনা কিন্তু শুরু হয় আরো আগে। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বাঙালী মালিকানাধীন ১২ হাজার রেষ্টুরেন্ট ও টেকওয়ের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার অনেক আগে ১৯১৯ সালে বিলেতের বাঙালী পাড়া বলে খ্যাত টাওয়ার হ্যামলেটসের কমার্শিয়াল রোডে রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেছিলেন জগন্নাথপুরের আইয়ূব আলী মাস্টার। রেষ্টুরেন্টের নাম ছিল ‘শাহজালাল’।
ড্যান জোন্সের রং তুলিতে আইয়ূব আলী মাস্টার
আইয়ূব আলী মাস্টার ইউকে মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। রেষ্টুরেন্ট ব্যবসার পাশাপাশি ১৩ সেন্ডি রোতে অরিয়েন্ট ট্রেভেলস নামে ট্রেভেলিং ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। ২ ছেলে ও ১ মেয়ের জনক ছিলেন তিনি। জীবনের শেষ দিকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে ফিরে যান এবং ১৯৮০ সালের পহেলা এপ্রিল জগন্নাথপুর উপজেলার হাসন-ফতেপুরের নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তবে মৃত্যুর আগে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে জনসেবা করেছেন। ব্রিটিশ চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ আইয়ূব আলী মাস্টার দেশে গিয়ে প্রথমে নিজের গ্রামের নাম ‘আচল’ পরিবর্তন করেন রাখেন হাসন-ফতেপুর।
ইউকের ওপেন ইউনিভার্সিটির ওয়েব সাইটে আইয়ুব আলী মাস্টার সম্পর্কে বিশদ একটি লেখা ছাপা হয়েছে। এছাড়া ১৯৮৭ সালের ১লা জানুয়ারী প্রকাশিত ক্যারোলাইন এডামসের লেখা সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে নামে একটি গ্রন্থেও আইয়ুব আলী মাস্টার সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য রয়েছে।
সমুজ আলী এবং মুফাজ্জাল আলীর সঙ্গে বসা আইয়ূব আলী মাস্টার। ১৯৫০ সালের তোলা ছবি
আইয়ূব আলী মাস্টার স্বদেশে ফিরে গেলেও বিলেতে তাঁর রেষ্টুরেন্ট ব্যবসার হাল ধরেছিলেন তার ছেলে মফজ্জল হোসেন। ১৯৫৩ সালে বাবার পথ ধরেই রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। উত্তর ইংল্যান্ডের ম্যানচেষ্টারে দিলকুশ নামে তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। বাবা আইয়ুব আলী মাস্টারের মতো তিনিও এক সময় ব্যবসা গুটিয়ে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে চলে যান। তবে দিলকুশকে সঙ্গে নিয়ে যান তিনি। সিলেটের লালবাজারের মুখে দিলকুশ নামে যে রেষ্টুরেন্টটি এখন দেখা যায়, সেটি পঞ্চাশের দশকের সেই দিলকুশেরই উত্তরাধিকারের স্মৃতি বহন করছে। তাঁর সন্তানরা এখনো দিলকুশ বহাল রেখেছেন।
পুুরুষানুক্রমে পাওয়া রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায় জড়িয়েছেন আইয়ুব আলী মাস্টারের নাতীও। বিলেতে বাঙালী কমিউনিটির পরিচিত মুখ, রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ী রুহুল হোসেন তার দাদাকে নিয়ে অহংকার করেন। ১৯৮২ সালে বিলেতে আসেন। ছোট্ট বেলায় সমাজসেবক দাদাকে দেখেছেন। পড়া-লেখা করে ভিন্ন পেশার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে জীবন শুরু করলেও দাদা এবং বাবার পথই অনুরসন করেন শেষ পর্যন্ত। ১৯৯৫ সালে শুরু করেন রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা। নাম করা লাল কিল্লাসহ চারটি রেষ্টুরেন্ট ছিল। তিনটি ছেড়ে দিয়ে একমাত্র ইন্ডিয়ান লাউঞ্জ নিয়ে সফল ব্যবসা করছেন রুহুল হোসেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে তৃতীয় রুহুল হোসেন। চার ছেলের জনক তিনি। তার জন্যে খুশির সংবাদ হল, বড়ো ছেলেও ভিন্ন পেশা দিয়ে চাকুরী জীবন শুরু করেছে এবং পুরুষানুক্রমিক ব্যবসায় হাল ধরার লক্ষ্য নিয়ে নিয়মিত সে বাবার রেষ্টুরেন্টে যাতায়াত করছে।
কার্ড দেখিয়ে তালতলার বাসা থেকে রামাদানের খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করছেন একটি পরিবার
অন্যদিকে দাদা এবং বাবার মতোই ব্যবসার পাশাপাশি সমাজ সেবায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন রুহুল হোসেন। প্রতি বছর রামাদানে তিনি ৮শ পরিবারকে ২০কেশি চাউল, ৫ কেজি ডাইল, ৫ কেজি তেল এবং খেজুর দিয়ে থাকেন। তবে এই কাজটি করেন অত্যন্ত নিরবে। সিলেট শহর, বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ এবং জগন্নাথপুরের দরিদ্র পরিবারগুলোকে এই সহযোগিতা দেন তিনি। ৮শ পরিবার সিলেট শহরের একটি বাসা থেকে এসব খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যায় কিন্তু কেউ টেরই পায় না। এর কারণ, রামাদানের আগে দু সপ্তাহে স্বাক্ষর করা নিজের বিজনেস কার্ড এই ৮শ পরিবারের কাছে স্থানীয়দের মাধ্যমে পৌঁছে দেন তিনি। যাদেরকে কার্ড দেওয়া হয়, তাদেরকে বলে দেওয়া হয় এই কার্ড দেখিয়ে কার্ডে উল্লেখিত ঠিকানা থেকে দুদিনের ভেতরে খাদ্যদ্রব্যগুলো সংগ্রহ করতে হবে। গ্রাম থেকে যারা আসে সহযোগিতা নিতে তাদেরকে আসা-যাওয়ার ভাড়া বাবদ নগদ দু’শ টাকাও দিয়ে দেন তিনি। পরিকল্পনা করে এভাবে একেক এলাকায় একেক সপ্তাহে কার্ড দেওয়া হয়। আর এ কারণেই সিলেট শহরের ব্যবস্ততম এলাকা তালতলার আট তলা অট্টালিকার বাসা থেকে দরিদ্র আট’শ পরিবার এই ত্রাণ নিলেও কেউ টের পান না।
ঘুমন্ত অসহায়দের কম্বল দিয়ে আসছেন নিরবে
এছাড়া সিলেটের ফাতেমাপুরে এতিমদের জন্যে তিন তলার একটি বভনও বানিয়ে দিয়েছেন তিনি। যেখানে ষাটজন এতিম শিশুর স্থায়ীভাবে বসবাসের জায়গা হয়েছে। অন্যদিকে প্রতি বছর শীতে সিলেট শহরে প্রায় ১ হাজারের বেশি কম্বল বিতরণ করেন। এখানেও ব্যাপক গোপনীয়তা রক্ষা করেন তিনি। নিশীরাতে পরিবারের সদস্য এবং অন্যান্যদের সঙ্গে নিয়ে শহর চষে বেড়ান তিনি। যেখানেই ঘুমন্ত অসহায় চোখে পড়বে, তাদের গায়ে চুপিসারে কম্বল দিয়ে আসেন তিনি।
এতিম শিশু-কিশোরদের সঙ্গে রুহুল হোসেন
তবে রামাদানের ৮শ পরিবারের খাবার বা হাজার পরিবারের কম্বল, সবকিছুই আগে কিনে নিজের বাসায় জমা করেন তিনি। দাদা এবং বাবার মতো দানশীল ব্যক্তিত্ব রুহুল হোসেন তালতলায় বিরাট একটি গেইটও নির্মাণ করে দিয়েছেন।