লন্ডনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নামে একটি রাস্তার নাম করনের দাবী বাংলাদেশের হাই কমিশনারের

লন্ডন: লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকায় সৈয়দ আশরাফ যে স্থানে বসবাস করতেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের প্রতি সেই রোড়ের নাম সৈয়দ আশরাফের নামে নামকরনের দাবি জানিয়েছেন লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম।

গতকাল ২০ জানুয়ারী রবিবার পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে আলতাব আলী ফাউন্ডেশন আয়োজিত সৈয়দ আশরাফ স্মরণে নাগরিক শোক সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ দাবী জানান। হাই কমিশনার বলেন, লেবার পার্টির এক সময়ের সক্রিয় এক্টিভিষ্ট সৈয়দ আশরাফের মৃ্ত্যুতে পার্টি অফিসিয়েলী একটি শোক প্রস্তাব গ্রহন করবে, এমন প্রত্যাশা টাওয়ার হ্যামলেটসের বাসিন্দাসহ আমাদের সকলের।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সময়ের ব্যাতিক্রমী রাজনীতিক উল্লেখ করে লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম বলেন, দৈহিক মৃত্যু হলেও এমন রাজনীতিকদের আদর্শ আমাদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত।

তিনি বলেন, সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিলো সৈয়দ আশরাফের রাজনীতির লক্ষ্য। তাঁর লোকান্তরিত হওয়ার পর সেই সুবিধা বঞ্চিত মানুষ যেন নেতৃত্বহীন হয়ে না পড়ে, সেদিক বিবেচনা করে হলেও আশরাফ কন্যা রিমার বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া উচিত ।

বাবার শূন্যস্থান পুরনে বাংলাদেশে ফিরে যাবার জন্যে সদ্য প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কন্যা রিমাকে দেশে ফিরে যাবার অনুরোধ জানান হাই কমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম।

ব্যাঙ্ককে রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন বিভিন্ন সময় আশরাফের সান্নিধ্যে আসার স্মৃতিচারণ করে বক্তৃতায় আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েন হাই কমিশনার। তিনি বলেন বর্তমান সময়ের প্রচলিত রাজনৈতিক ডামাডোলে সৈয়দ আশরাফ ছিলেন এমন একজন ব্যতিক্রমী রাজনীতিক, যিনি যা বিশ্বাস করতেন তা বলতেন অকপটে। রাজনীতি মানে মানুষের সেবা, আত্মসেবা নয়, নিজের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে সেটিই প্রমান করে গেছেন তিনি। মুনা তাসনিম বলেন, প্রয়াত সৈয়দ আশরাফ যে ছিলেন জনতার নেতা, কিশোরগঞ্জে তাঁর নামাজে জানাজায় লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ তাই প্রমান করে।

নিজেকে সৌভাগ্যবান দাবি করে হাই কমিশনার বলেন, ব্যাঙ্ককে দায়িত্ব পালনকালীন তাঁর সংস্পর্শে এসে অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয়েছে আমার।
আলতাব আলী ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট সাবেক কাউন্সিলার ও নূরুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক আনসার আহমেদ উল্লার পরিচালনায় অনুষ্ঠিত নাগরিক শোকসভার শুরুতে একমিনিট দাড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। এর সৈয়দ আশরাফুল ইসরামের রুহের মাগফেরাত কামনায় মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মৌলানা শফিকুর রহমান বিপ্লবী।
নাগরিক শোক সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন টাওয়ারহ্যামলেটস কাউন্সিলের মেয়র ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বন্ধূ জনবিগস, ব্যরোনস পলা মঞ্জিলা উদ্দিন, যুক্তরাজ্য আওয়ামীলগের সভাপতি ও প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সুলতান মাহমুদ শরীফ, গ্রেটার লন্ডন এমেমব্লী মেম্বার উমেশ দেশাই।

শোকসভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাবেক কাউন্সিলার টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি লিডার রাজন উদ্দিন জালাল, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ভাই অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, সৈয়দ আশরাফূল ইসলামের কন্যা রীমা ইসলাম, টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের অন্যতম সহযোদ্ধা রাজু নাথন, লয়েড গি, আজাদ বখত চৌধুরী, রুহুল আমিন, সাবেক কাউন্সিলার হেলাল আব্বাস, নইমুদ্দিন রিয়াজ, এ্যালিসা উইলসন রউজ, জামাল খান প্রমুখ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ব্যারোনেস পলা মঞ্জিলা উদ্দিন সৈয়দ আশরাফকে একজন প্রকৃত মানব প্রেমিক রাজনীতিক হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে মানুষের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার কথা কখনও ভুলতে পারতেননা আশরাফ। আর তাই শুধু কোন একটি ভূখন্ড নয় মানব জাতির সুবিধা বঞ্চিত অংশের পক্ষেই তাঁর কন্ঠ সব সময় উচ্চকিত ছিলো প্রতিটি ফোরামে।

ব্যারোনেস উদ্দিন সৈয়দ আশরাফের পাশাপাশি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন আশরাফ পত্নি শিলা ইসলামের কথাও। বলেন, মানব প্রেমিক এই দম্পতি টাওয়ার হ্যামলেটসের কমিউনিটি ইতিহাসের এক স্বর্ণালী অংশ হয়েই থাকবেন, এটি আমার বিশ্বাস।

টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাহী মেয়র জন বিগস বলেন, সমাজে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আশরাফ ছিলেন সামনের কাতারের একজন যোদ্ধা। তাঁর এই যুদ্ধ নির্দিষ্ট কোন ভূখন্ডে সীমাবদ্ধ ছিলোনা, লন্ডনে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি যেমন ছিলেন তাঁর কমিউনিটির পাশে, ঠিক নিজের জন্ম মাটি বাংলাদেশের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের পাশেও ছিলো তাঁর সরব উপস্থিতি। মেয়র বলেন, এত সাদামাটা,জৌলুসহীন ও আত্মপ্রচার বিমূখ জীবন ছিলো তাঁর যে, কমিউনিটি আন্দোলনে তাঁর সহযোদ্ধা হওয়ার পরও ১৯৯৪ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্মলগ্ন ও রাজনীতিতে আশরাফের গৌরবোজ্জল পারিবারিক অবস্থান আমি জানতাম না।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি লীডার রাজন উদ্দিন জালাল বলেন, বর্তমান ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অফ কমন্সে প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন তিন বাঙালি নারী।এই যাত্রা শুরু হয়েছিলো সেই বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের পথ ধরেই।আর এই যাত্রায় আশরাফ ভাই আমাদের অন্যতম সংগঠক ও নেতা ছিলেন। অনেক বাঙালি কাউন্সিলার তৈরি করতেও তিনি প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। বাঙালিদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অন্যতম নেতা হওয়া সত্বেও আশরাফ ভাইয়ের মাঝে কেনোদিন ক্ষমতার লোভ দেখিনি।

তিনি বলেন, সৈয়দ আশরাফ ছিলেন একজন ভিশনারী রাজনীতিক, ভবিষ্যৎ দেখতে পারার ক্ষমতা ছিলো তাঁর। আশরাফ কন্যা রিমা ইসলামের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে জালাল বলেন, সৈয়দ আশরাফ যেমন ছিলেন আমাদেরই লোক, কমিউনিটির আপনজন, ঠিক তেমনি রিমাও আমাদের সন্তান। কমিউনিটি নিশ্চয়ই তাঁর এই সন্তানের প্রতি দায় এড়াবে না।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি, প্রবীন রাজনীতিক সুলতান শরীফও সৈয়দ আশরাফকে স্মরণ করতে গিয়ে আবেগ প্রবণ হয়ে উঠেন। ৭৫ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের আন্দোলনে তরুণ সহকর্মী সৈয়দ আশরাফের সক্রিয়তার কথা স্মরণ করেন তিনি তাঁর বক্তৃতায়।
স্মরণ সভার সভাপতি, সৈয়দ আশরাফের ঘনিষ্ট সহযোদ্ধা সাবেক কাউন্সিলার নুরুদ্দিন আহমদ তাঁর স্বাগত বক্তৃতায় গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, তাঁর জীবনের স্বর্ণালী অধ্যায়ের সহযোদ্ধা সৈয়দ আশরাফের প্রতি। বলেন, একজন ক্ষনজন্মা মানুষ ছিলেন আশরাফ। ব্রিটেনের মূলধারায় বাঙালীর ক্ষমতায়নের এক নেপথ্য নায়ক ছিলেন তিনি। নুরউদ্দিন আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সোনার বাংলা গড়তে সোনার মানুষ চাই। আশরাফ ছিলেন সেই সোনার মানুষ।

এই সোনার মানুষ চিনতে পেরেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু কন্যা ১৯৯৪ সালে আশরাফকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন দেশেরই প্রয়োজনে।
স্মরণ সভার শেষ পর্যায়ে সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে শোকাভিভূত কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি শোক বই হস্তান্তর করা হয় আশরাফ কন্যা রিমা ইসলাম ও তাঁর পরিবারের হাতে।

Advertisement