শিক্ষায় মূল্যায়ন ব্যবস্থা এবং গুণগত মান

ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ ::

গত সোমবার ২০১৯ সালের মাধমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান (দাখিল ও কারিগরি) পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। ফলাফলে দেখা যায়, এবারের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৮২.২০ শতাংশ, যা গতবারের তুলনায় ৪.৪৩ শতাংশ বেশি। গতবার এসএসসি ও সমমানের পাসের হার ছিল ৭৭.৭৭ শতাংশ। শুধু পাসের হার নয়, পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও এবার গতবারের চেয়ে বেশি ছিল। গতবার মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্য ছিল ২০ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৪ জন। এর মধ্যে পাস করে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪ জন। এবার মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২১ লাখ ২৭ হাজার ৮১৫ জন। তবে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার বাড়লেও কমেছে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা, যা গতবারের উল্টো ঘটেছে। সারাদেশে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী কমেছে ৫ হাজার ৩৫ জন। সারাদেশে মাধ্যমিকে অকৃতকার্য হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার ৬৫০ (সমকাল)। সাধারণত দেখা যায়, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের কারণে মাধ্যমিকে ফল বিপর্যয় দেখা যায়। এবার শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে ভালো করলেও গণিতে অনেক শিক্ষার্থী ফল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে।

(সূত্র :সংবাদমাধ্যম)

ফলাফলে আরও দেখা যায়, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তি দুটিই বেশি। ছেলেদের পাসের হার ছিল ৮১.১৩ শতাংশ; অন্যদিকে মেয়েদের পাসের হার ছিল ৮৩.২৮ শতাংশ। অর্থাৎ পাসের হারে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় ২.১৫ শতাংশে এগিয়ে। অনুরূপভাবে ছাত্রদের তুলনায় এক হাজার ৩৭৪ জন ছাত্রী জিপিএ ৫ বেশি পেয়েছে। জিপিএ ৫ পাওয়া মোট ছেলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫২ হাজার ১১০ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৩ হাজার ৪৮৪ জন। তৃতীয়বারের মতো মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলে ভালো করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, বছর বছর মাধ্যমিক পাসের হার বৃদ্ধি, জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা বৃদ্ধি (যদিও এ বছর গতবারের তুলনায় কম) শিক্ষাক্ষেত্রে কী বার্তা বহন করে? শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করার কথা, তারা কি তা অর্জন করছে! বর্তমান মূল্যায়ন ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা, জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে কতটা সহায়ক? যে মূল্যায়ন ব্যবস্থা আমরা বছরের পর বছর অনুশীলন করছি, তার আন্তর্জাতিক মান কেমন? এ মূল্যায়ন ব্যবস্থা শিক্ষাক্রম, শ্রেণি শিক্ষণ-শিখন ব্যবহার সঙ্গে কতটা সাযুজ্যপূর্ণ। পরীক্ষায় যে প্রশ্ন ব্যবহার করা হয়, তার কতটা যথার্থতা এবং নির্ভরযোগ্যতা রয়েছে? সর্বোপরি এ ধরনের মূল্যায়ন ব্যবস্থা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের গুণগত শিক্ষা লক্ষ্য অর্জনে কতটা সহায়ক?

এ বিষয়গুলো জানার জন্য কথা বলেছিলাম দু’জন শিক্ষাকর্মীর সঙ্গে। দু’জনই দেশ ও দেশের বাইরে পড়াশোনা করেছেন। একজন পড়াশোনা করেছেন জাপানে, আরেকজন করেছেন মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে। দু’জনই বর্তমানে প্রচলিত মাধ্যমিক স্তরের মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিয়ে গভীর হতাশা ব্যক্ত করেন। তারা তাদের হতাশার কারণ ও তার প্রতিকারের উপায় ব্যক্ত করেছেন। এ প্রবন্ধ রচনায় তাদের মতামতের প্রতিফলন রয়েছে।

বাংলাদেশের মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিয়ে বরাবরই বিতর্ক রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিতর্কের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিতর্ক তীব্রতর হয়েছে গত তিন দশকে। বিশেষ করে বহু নির্বাচনী প্রশ্ন এবং সৃজনশীল প্রশ্ন প্রবর্তনের পর। দেশে যে মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটে তার মূল্য (ঠধষঁব) রয়েছে। এই মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীরা উচ্চতর পর্যায়ে ভর্তির সুযোগ পায়। কিন্তু গুণগত মানের দিক থেকে, কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়নের দিক থেকে এ মূল্যায়ন ব্যবস্থা কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করার কথা, যে গভীরতায় শেখার কথা, তা তারা অর্জন বা শিখতে পারছে না। কেন অর্জন করতে পারছে না, তা নিয়ে সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক- সবাই ভাবছেন। কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা দৃশ্যমান হচ্ছে না। এর অন্যতম প্রধান কারণ মূল্যায়ন ব্যবস্থা সেভাবে তৈরি করা হয়নি। যার ফলে শিক্ষকরা শ্রেণিতে যা পড়ানোর কথা, যেভাবে পড়ানোর কথা, তা তারা করছেন না। এ জন্য শিক্ষকদের যেমন জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব রয়েছে, তেমনি অভাব রয়েছে সুষ্ঠু মূল্যায়ন ব্যবস্থা, অনুশীলন, পরীবিক্ষণ (মনিটরিং) ও জবাবদিহি।

দ্বিতীয়ত, আমাদের মূল্যায়ন ব্যবস্থা যা মূল্যায়ন করার, তা করতে পারছে না। শিক্ষাক্রমে যে শিখন ফল তা যথাযথভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে না। যেমন- ইংরেজি বিষয়ে ভাষা দক্ষতার চারটি দক্ষতার (শোনা, বলা, পড়া, লেখা) দুটি দক্ষতা পড়া ও লেখা মূল্যায়িত হচ্ছে। কিন্তু শোনা ও বলার দক্ষতা মূল্যায়নের কোনো ব্যবস্থা নেই। আবার পড়া ও লেখার দক্ষতার মূল্যায়ন অনেকটা মুখস্থনির্ভর, যা শিক্ষার্থীর সৃষ্টিশীলতা ও মেধা বিকাশের তেমন সহায়ক নয়। শোনা যায়, সরকার অনেক দিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। এখন ভাবনা থেকে কাজে পরিণত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে গবেষণা করেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

তৃতীয়ত, একজন শিক্ষার্থী যখন কোনো বিষয়ে জিপিএ ৫ পায়, তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, শিক্ষার্থী যে বিষয়ে বিদ্যালয় শিক্ষাক্রমের যা শেখার তা ভালোভাবে শিখেছে, দক্ষতার সঙ্গে শিখেছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। না উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে, না ব্যবহারিক জীবনে।

চতুর্থত, আমাদের এসএসসি পরীক্ষাটি গ্লোবাল মানদণ্ডে কতটা গ্রহণযোগ্য। যেমন প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস এসেসমেন্ট-এর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আমাদের মাধ্যমিক পাসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, তা নিয়ে কাজ করতে হবে।

পঞ্চমত, আগেই বলেছি, বাংলাদেশে সৃজনশীল প্রশ্ন বহুমাত্রিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। থিওরিটিক্যালি ও কনসেপচুয়ালি সৃজনশীল প্রশ্ন ভালো, তা নিয়ে সমস্যা নেই। সমস্যাটা হলো, কতজন শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন। অধিকাংশ শিক্ষকই সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না, যা এক গবেষণায় উঠে এসেছে। আবার যেসব শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্নের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, তারা বিদ্যালয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরির চর্চা করেন না বা করার সুযোগটা সীমিত। কারণ অধিকাংশ স্কুল সমিতির মাধ্যমে প্রশ্ন ক্রয় করে পরীক্ষা নেন, যেখানে সৃজনশীল প্রশ্ন করার এবং সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। সুতরাং বিদ্যালয় পর্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্নের চর্চা না থাকলে কেন্দ্রীয়ভাবে সেই চর্চা করা ঝুঁকিপূর্ণ এবং অযৌক্তিক বৈকি।

বাংলাদেশের এ ঝুঁকিপূর্ণ, বিতর্কিত ও দুর্বল মূল্যায়ন ব্যবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য মূল্যায়ন নীতিমালা ঠিক করতে হবে। যেখানে বলা হবে কী মূল্যায়ন করব, কেন মূল্যায়ন করব এবং কীভাবে মূল্যায়ন করব! এ মূল্যায়ন নীতিমালা হতে হবে শিক্ষাক্রম এবং শিক্ষণ-শিখনের সঙ্গে গভীরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের মধ্যে যে টেস্টিং ইল্লিটারেসি রয়েছে, তা দূর করতে হবে। সেই সঙ্গে টেস্টিং লিটারেসি স্কুল পর্যায়ে চর্চা করতে হবে। শিক্ষকরা চর্চা করছেন কি-না তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তৃতীয়ত, টেস্ট স্পেসিফিকেশন থাকতে হবে, যা পরীক্ষার পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষাক্রমের শেষে সাপ্লিমেন্টারি মেটেরিয়াল হিসেবে টেস্ট স্পেসিফিকেশন দেওয়া যেতে পারে। প্রতিটি টেস্ট আইটেম কতটা ভ্যালি ও রিলায়েবল, তা নিয়ে চর্চা করতে হবে। এ জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিতে হবে। যেমনটি করা হয়Azi Project-এ শ্রেষ্ঠ কন্টেন্ট নির্মাতার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসতে হবে। এ কাজগুলো যত দ্রুত করা সম্ভব, ততই জাতির জন্য মঙ্গল। ততই মূল্যায়ন ব্যবস্থা অর্থবহ হয়ে উঠবে গুণগত মান নির্ণয়ে।

moninoor@du.ac.bd

সহযোগী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Advertisement