সংস্কৃতি জগতের স্বীকৃত অভিভাবক

ড. মইনুল ইসলাম

একদিকে ক্রিকেট বিশ্বকাপ নিয়ে সারা জাতি মেতে থাকায় এবং অন্যদিকে ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতিলগ্নে কেনাকাটা ও গ্রামের শিকড় অভিমুখী যাত্রার ব্যস্ততায় নিমগ্ন জনগণের মনোযোগ অন্যত্র নিবদ্ধ থাকায় জাতির শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের বিশাল মহীরুহ শিক্ষাবিদ, নাট্য সংগঠক-পরিচালক এককথায় নাট্যজগতের পুরোধা, অভিনেতা মমতাজউদদীন আহমদের বিদায়লগ্নে হয়তো তার প্রাপ্য শ্রদ্ধার্ঘ্যের কিছুটা কমতি লক্ষ্য করা গেছে। ২ জুন ২০১৯ তারিখ অপরাহেপ্ত ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে তার জীবনাবসান ঘটে। অবশ্য তিনি নিজেই নাকি নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন তার মৃত্যুর পর বেশি আড়ম্বর না করতে। তাই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়নি। জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মমতাজ স্যারের জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ অধ্যায় ১৯৭১ সালের মার্চে চট্টগ্রামের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিনগুলোতে তিনি নগরীর জনগণকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনার অন্যতম কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন মমতাজ স্যার। আমরা অনেকেই হয়তো এখন ভুলে গেছি, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় তদানীন্তন মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুধু নিজের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর চারদিক থেকে প্রবল আপত্তি ওঠায় বাধ্য হয়ে বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত বিশিষ্টজনের দিকে তার নিজের ড্রাফট করা ঘোষণার কাগজটা ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে; আপনারা লিখে দেন- কী বলতে হবে।’ তখন অধ্যাপক মমতাজউদদীনের ওপরই দায়িত্ব পড়েছিল ঘোষণাটা পরিবর্তন ও পরিমার্জনের। ওই পরিমার্জিত ঘোষণাতেই ‘আওয়ার সুপ্রিম লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন মেজর জিয়া। ওই ড্রাফটটি এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অমোচনীয় দলিলে পরিণত হয়েছে। মমতাজ স্যারকে নাট্যকার হিসেবে সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ‘একুশে পদক’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে তার এই ঐতিহাসিক অবদানকে যথাযথ স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ জীবদ্দশায় তাকে দেওয়া হলে সেটাই যৌক্তিক হতো।

অধ্যাপক মমতাজউদদীন ছাত্রাবস্থায় রাজশাহীতে একজন নেতৃস্থানীয় ভাষাসংগ্রামী ছিলেন। এর পর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের খ্যাতিমান নেতা হিসেবে রাজশাহীতে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। তার শিক্ষকতা জীবনে পাকিস্তান আমলের ষাটের দশকে সরকারি কলেজের বাংলার অধ্যাপক হিসেবে তার অসামান্য সাহসী ভূমিকার জন্য সবাই খুব ভয়ে থাকত, তাকে সরকারি নির্যাতনের শিকার হতে হয় কি-না! কিন্তু তিনি নিজে এসব নিয়ে কখনও ভীত ছিলেন না। যেখানেই তিনি শিক্ষকতা করেছেন, সেখানেই সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তার নির্ভীক নেতৃত্ব ও প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে তার সাহসী সংযোগ তাকে সহজেই নেতৃত্বের ভূমিকায় অধিষ্ঠিত করে চলেছিল। ১৯৬৪ সালে যখন তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন, তখন আমার বাবা ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের লাইব্রেরিয়ান। চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে মমতাজ স্যারের বাসা আমাদের বাসার পাশের বিল্ডিংয়ে হওয়ায় এবং তার শ্বশুর ডা. কামরুজ্জামান বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় এর পর তাদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল, যে সম্পর্ক এখনও অটুট। তিনি এবং তার স্ত্রী কুমু আপা আজীবন আমাদের পরিবারের আপনজন। আমার মাকে খালাম্মা বলে পায়ে ধরে সালাম করতেন দু’জনই। ১৯৬৪ সালে আমি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, যা আজীবন অটুট ছিল। ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হওয়ার পর মমতাজ স্যার হয়ে গেলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। ওই দু’বছর তার একটি ক্লাসও মিস করিনি আমি। তখন চট্টগ্রাম কলেজে একঝাঁক বরেণ্য শিক্ষকের সমাবেশ ঘটেছিল। কিন্তু মমতাজ স্যারের ক্লাসগুলোর আকর্ষণ ছিল অপরিমেয়। একই সঙ্গে সংস্কৃতি জগতে পদচারণার কারণে তাকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েছিলাম আমি গুরু হিসেবে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরও তার সান্নিধ্য হারাইনি প্রতিবেশী হওয়ার কারণে। চট্টগ্রামে এলেই তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, আলাপ-আলোচনা হতোই। বিশেষত, তখন আমি ছাত্রলীগের মাঠ পর্যায়ের সক্রিয় কর্মী হিসেবে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত থাকায় প্রতিবারই মমতাজ স্যারকে জানাতে হতো ঢাকার ছাত্র রাজনীতির হাল-হকিকত। কারণ, তখন তিনি চট্টগ্রামের প্রগতিশীল রাজনীতির নেতৃস্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর তিনি সরাসরি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাতারে যুক্ত হয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম নগরীর যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উজ্জীবিত করতে তার ওই সময়ে রচিত একাধিক গণনাটক লালদীঘির মাঠে এবং চট্টগ্রাম কলেজের প্যারেড ময়দানে মঞ্চস্থ হয়েছে একাধিকবার। ওই নাটকগুলো পরিচালনাও করেছেন তিনি। সবশেষে ২৪ মার্চ ১৯৭১ তারিখ সন্ধ্যায় যখন প্যারেড ময়দানে প্রায় ২০ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে তার নাটক চলছিল, তখন রাত ৯টার দিকে খবর এসেছিল- এমভি সোয়াত থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামানোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য মিছিল নিয়ে সবাইকে চট্টগ্রাম বন্দরে যেতে হবে। মঞ্চ থেকে ঘোষণা শোনার পর কয়েক হাজার মানুষের মিছিল প্যারেড মাঠ থেকে বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করার দৃশ্য এখনও আমার স্মৃতিতে ভাস্বর। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ওই প্রতিরোধ আন্দোলনে গুলিবর্ষণের শিকার হয়ে শতাধিক মানুষ শহীদ হয়েছিলেন।

মমতাজ স্যার চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষক নেতা হিসেবে এবং চট্টগ্রামের সংস্কৃতি জগতের একজন স্বীকৃত অভিভাবক হিসেবে ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখ সন্ধ্যা থেকেই ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ পরিচালনার অন্যতম মূল সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন (পরবর্তী সময়ে এই বেতার কেন্দ্রের নাম থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছিল)। তার লেখা এতদসম্পর্কীয় বইটিতে তার এই ভূমিকার বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে তার সঙ্গে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা-বিতর্ক নিয়ে আমার বেশ কয়েকবার আলাপ করার সুযোগ হয়েছে। এসব আলোচনার ফলেই ওই বিতর্ক সম্পর্কে আমার সত্যিকার ঘটনা জানার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি বেশ কয়েকবার তাকে অনুযোগ করেছি, ‘স্যার, এই কথাগুলো বিস্তারিতভাবে আপনার জাতিকে জানানো উচিত।’ তিনি শুধু বলেছেন, ‘আমাদের অনেকেই নিজের পাতে ঝোল টানার জন্য বেশ খানিকটা ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছে। কিন্তু আমি প্রকাশ্যে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে তাদেরকে বিব্রত করতে চাই না।’ এটাই হলো আমার পরম শ্রদ্ধেয় মমতাজ স্যারের আসল চরিত্র। আপনজনকে জনগণের দৃষ্টিতে খাটো করতে চাননি বলেই তিনি ওই বিষয়ে অনেক কিছু জানা সত্ত্বেও ‘পাতে ঝোল টানা’ মানুষদের বিরুদ্ধে কখনোই প্রকাশ্যে কটাক্ষ করেননি। বিতর্কে নামলে অনেকে হয়তো তাকেও আক্রমণ করতে পিছপা হতো না! কেন জানি, তার বইটিও খুব বেশি প্রচার পায়নি। সরকারের কাছে আমার আবেদন থাকবে, প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য মমতাজ স্যারের বইয়ে যে বর্ণনাটুকু রয়েছে, সেটাকে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা হোক, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের প্রয়োজনে।

১৯৭২ সালেই মমতাজ স্যার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিলেন। আশির দশকে ডক্টরেট করে দেশে ফেরার পর মাঝেমধ্যে তার বাসায় গেছি প্রাণের টানে। তখন তিনি দেশের নাট্যজগতের দীপ্যমান নক্ষত্র; টেলিভিশনেরও নিয়মিত অভিনেতা, পরিচালক ও নাট্যকার। কিন্তু তার ভেতরের বিপ্লবী সত্তার আগুন তখনও জ্বলছে। তাই স্বৈরাচারী এরশাদ শাহির বিরুদ্ধে তার রচিত মঞ্চনাটক ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’ এ দেশের জনগণের গণতন্ত্রের সংগ্রামে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছিল। ওই সময়ের সংবাদমাধ্যমে নাটকটিকে একটি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রহসন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। ইস্কাটনের নাটকপাড়ায় বহুদিন চলেছিল এই নাটক। কার বিরুদ্ধে এই নাটক, তা বুঝতে দর্শকের মোটেও কষ্ট হয়নি। দর্শকরা অভিভূত হয়েছেন জনধিক্কৃত একনায়ক এরশাদের বিরুদ্ধে মমতাজ স্যারের এমন সাহসী প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আহ্বানে। অথচ তখনও মমতাজ স্যার সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেননি।

এ মানুষটিকে অনেকেই অত্যন্ত ‘বর্ণিল মানুষ’ হিসেবে বর্ণনা করতে দেখলাম তার মৃত্যু-পরবর্তী জানাজার সময় প্রদত্ত মন্তব্যে। আমরা যারা তাকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছি, তারা জানি কী মর্মান্তিক একটি বেদনা নিয়ে জীবন নির্বাহ করতে হয়েছিল তাকে শেষ জীবনে! তার মেয়ে তাহিতি বহুদিন আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। একটু একটু করে তাহিতির একটি পা অপারেশন করে অপসারিত করা হয়েছিল। আর তখনও মমতাজ স্যার নাটকে, টেলিভিশনে বর্ণিল নাটক উপস্থাপন করে চলেছেন। তার অভিনয়ে কখনোই ধরা পড়েনি তার ওই বেদনাহত জীবন। আমরা যখন তার বাসা মিরপুরের রূপনগরের ‘কুমুর নিজের বাড়ি’তে তার সঙ্গে এবং তার স্ত্রী কুমু আপার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম, দেখতাম কত অনায়াসে তারা ব্যাপারটি এড়িয়ে যেতেন। এটাই হলো অধ্যাপক মমতাজউদদীনের আসল ব্যক্তিসত্তা। নীতির ব্যাপারে তার ছিল পাহাড়সমান দৃঢ়তা, অথচ দৈনন্দিন জীবনে সর্বদাই সহাস্য উপস্থিতি ও সরস আচরণ পরিলক্ষিত হয়েছে। এই মহাপ্রাণ শিক্ষককে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। জাতি মমতাজ স্যারকে পেয়েছিল- এটাই আমাদের সৌভাগ্য।

একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Advertisement