সবই কি তুচ্ছ হয়ে যাবে?

ফারুক ওয়াসিফ :: ‘সামনে আসছে শুভদিন…’ বলে শুরু হয় ভোটের স্লোগান। সব দুর্দিনে নেতারা আমাদের এই আশা দেন। অষ্টম শতাব্দীতে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন গোপাল নামের এক সামন্তকে রাজা নির্বাচিত করেছিলেন, তখনো বাংলায় দুর্দিন চলছিল। বড় মাছের গ্রাসে ছোট মাছের গ্রাসিত হওয়ার যে দশাকে মাৎস্যন্যায় বলা হয়, সেটা ছিল। এ রকম অবস্থার সুযোগ নিয়ে সেনাপতিরা ক্ষমতা নেন কিংবা বিদেশি রাজারা সাম্রাজ্য বাড়ান। দিশেহারা মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছিল নতুন নেতা। কোনো উপায় যখন পাওয়া গেল না, তখন জনগণের ভেতর থেকেই সমাধান এল। প্রকৃতিপুঞ্জ, তথা ছোট জমিদারেরা মিলে একজন নেতা নির্বাচন করে নিলেন। তিনি পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা গোপাল—বিশ্বের প্রথম নির্বাচিত রাজা। অনেকটা গ্রিক গণতন্ত্রের আদলে অভিজাত দশজনা মিলে তাঁদের একজনকে রাজা বানিয়ে শান্তি এনেছিলেন দেশে। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আহমেদ

কামালের মতে, ‘বাংলায় তখন বৌদ্ধপ্রাধান্য চলছিল। নির্বাচনের সংস্কৃতি খুব ভালো করে জানা ছিল বাঙালি বৌদ্ধদের। বৌদ্ধবিহার ও ধর্মসংঘের প্রধান ব্যক্তি সংঘের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন এবং রাজা গোপালও ছিলেন বৌদ্ধ।’

পরের যে নির্বাচন সমাজে পরিবর্তন আনার রাস্তা সুগম করেছিল, সেটা হয় ১৯৩৭ সালে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক কৃষিজীবী মধ্যবিত্তদের নিয়ে দল বানালেন কৃষক প্রজা পার্টি (কেপিপি)। এই দলের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল জমিদারদের আবওয়াব-খাজনা কমানো এবং মহাজনি সুদের ফাঁস আলগা করার দাবি। বাংলাপিডিয়া বলছে, ‘হক জনগোষ্ঠীর সকল অংশ নিয়ে এক নতুন বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন বলে তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার বাংলার জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।’ হক সাহেব এভাবে উপমহাদেশের রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক, সেক্যুলার এবং শ্রেণিভিত্তিক কর্মসূচি দিয়ে দুটি উপকার করলেন দেশের। এক. জমিদার-অভিজাতদের কংগ্রেস-মুসলিম লীগের দাপট কমিয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের ভিত গাড়লেন এবং দুই. জমিদারি-মহাজনি ব্যবস্থার মারণঘণ্টা বাজালেন। বাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের দ্বিতীয় মাইলফলক এটা।

তৃতীয় মাইলফলক সত্তরের নির্বাচন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচন যদি সমাজসংস্কারের শক্তি জোগায়, ’৭০-এর নির্বাচন জোগায় স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আত্মবিশ্বাস। এই নির্বাচন উপহার দিয়েছিল এক গণতান্ত্রিক ভোটারমণ্ডলী এবং তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং জাতিকে প্রস্তুত করেছিল একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য।

চতুর্থ মাইলফলকটি ছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচন হয়েছিল বাংলাদেশি গণতন্ত্রের ম্যাগনাকার্টা তিন জোটের রূপরেখা মেনে অস্থায়ী সরকারের অধীনে। তাতে স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার পায় দেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির কপাট খোলায় এই ঘটনার প্রভাব বিরাট।

ওপরের এই চার নির্বাচন আপনা-আপনি সুফল দেয়নি। ১৯৩৭ সালের বিজয়ের আগে শেরেবাংলার নেতৃত্বে গ্রাম-মফস্বলে গণ-আন্দোলন হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ঘটে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে জয়ী হয় নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান। প্রতিটি নির্বাচন হয়েছিল গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শক্তিকে দুর্বল করে আনার পর, নচেৎ নয়। এমনকি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনেও আগের বছরের আন্দোলনের শক্তিই জয়ী হয়। তার ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হতে পেরেছিল বলেই ওই সব নির্বাচন তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ ছিল। ৩০ ডিসেম্বর যে নির্বাচন হবে, তার আগে দুটি সামাজিক আন্দোলন (কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে) হলেও ব্যাপক কোনো গণ-আন্দোলন হতে পারেনি।

গণ-আন্দোলন + নির্বাচন = গণতন্ত্র—এই সমীকরণ দেখায়, গণ-আন্দোলন ছাড়া নির্বাচনে জনমতের জয় আসে না। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে গণ-আন্দোলন না থাকলেও ছিল জরুরি অবস্থাকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমর্থন। সুতরাং, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সমীকরণ বলে, এবারের নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন দেখতে পাওয়ার সুযোগ কম।

যে দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্রের চল এত পুরোনো, সে দেশে অগণতান্ত্রিক ও অসহিষ্ণুতা রাজনীতির মধ্যে গেড়ে বসল কী করে? সমাজের আর কোনো অংশে এমন দাঁতে দাঁত ঠোকাঠুকি বিবাদ ছিল না। সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা ব্যবসায়ীদের মধ্যে। কিন্তু বিভিন্ন রকম প্রতিষ্ঠান, সমিতি-অ্যাসোসিয়েশন বানিয়ে তাঁরা ঠিকই খেলার নিয়ম বানিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশন, বাজার সমিতি, আবাসিক এলাকার ফ্ল্যাট মালিক সমিতি, বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের মতো জায়গায়ও আর সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। একটি দলের অনুসারীরা ছাড়া আর কাউকে সেখানে নির্বাচিত হতে দেখা যায় না।

সর্বশেষ স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ভোটের সংস্কৃতি বিনষ্টের দুটি আলামত মেলে: স্থানীয় সরকারের রাজনীতিকীকরণ এবং একদলীয়করণ। আগে গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের সহাবস্থান দেখা যেত। ক্ষমতাসীনেরা বেশি সুবিধা নিলেও বিরোধী পক্ষকে উপড়ে ফেলা হতো না। দুই পক্ষের মধ্যে মুখ দেখাদেখি, বিয়েশাদি, ব্যবসা-বাণিজ্য চলতে দেখা যেত। কিন্তু গত প্রায় দুই দশকে বিরোধী পক্ষের যত লোক নিহত হয়েছে, জেল খাটছে ও খেটেছে এবং মামলা-হামলার ভয়ে এলাকাছাড়া, তত আর কখনোই হয়নি। ১৯৭১ সালের পরে দেশটা তৃণমূল পর্যন্ত এত বিভক্ত ও যুদ্ধংদেহী আর কখনো হয়েছে কি? গত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একচেটিয়া দাপট প্রতিষ্ঠা ছিল সহাবস্থানের সংস্কৃতির ওপর মরণ-আঘাত। অভিযোগ আছে, তৃণমূল পর্যায়ে বিরোধী পক্ষের পরিবারগুলোর তালিকাও নাকি করা আছে।

২০১৪ সালে বিএনপি চায়নি মানুষ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনে ভোট দিতে যাক। ২০১৮ সালে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট চায় মানুষ ভোট দিক। কিন্তু ভয়ের পরিবেশ আগেরবারের মতোই বিরাজিত। সরকার বলছে ভোট দেওয়ার অবাধ পরিবেশ বিরাজ করছে।

ওদিকে সাংবাদিকেরাও হামলার শিকার হচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনের শর্ত, পুলিশের চালচলন—সব বলছে, ভোটার-সাংবাদিক-পর্যবেক্ষকেরা ১০০ হাত দূরে থাকুন। সরকার কি বিদেশিদের বোঝাতে চায় নিরপেক্ষ না হলেও আমরা অন্তত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করেছি। আর জনগণকে বোঝাতে চায় ‘আপনার ভোটটাও আমি পেয়ে গেছি’! হায় দুর্ভাগা তরুণ! মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে লড়াই করেছিলেন পাঁচ লাখ তরুণ। আর আমাদের আছে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি ভোটার। এর মধ্যে আড়াই কোটিই তরুণ। আমাদের আছে গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ আর সংগ্রামী গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য। আমাদের আছে ১৮ কোটি জনগণ। এর সবই কি তুচ্ছ হয়ে যাবে?

Advertisement