:: এ এম এম শওকত আলী ::
সরকারি কর্মচারীদের দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি বহুল আলোচিত। তবে এ ধরনের আলোচনা ১৯৯১-পূর্ব সময়ে কখনো হয়নি বা হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। এ ধারণার প্রমাণ ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সময়ে মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। এ ধারণার ভিত্তি ছিল নির্বাচনের কিছু আগে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারীদের ব্যাপক রদবদল। জাতীয় সংসদেও এ ধরনের বিতর্ক নব্বইয়ের দশকে হয়েছে বলে প্রমাণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ১৯৯৩ সালে তৎকালীন প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা প্রশাসনকে দলীয়করণের অভিযোগ উত্থাপন করেন। এ অভিযোগে বলা হয়, পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে দলীয় অনুগত কর্মচারীদেরই যোগ্য প্রার্থীদের উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর ফলে প্রশাসনে রাজনৈতিকীকরণ প্রক্রিয়াই প্রাধান্য পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীরা রাজনৈতিক দলের অনুগত না হওয়ার বিধান ধ্বংস করা হয়। একই ধরনের অভিযোগ সাবেক প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান ক্ষমতাসীন দল সম্পর্কে পরবর্তী সময়ে করেন বলে জানা যায়। ২০০১ সালে একটি পত্রিকায় তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় কর্তৃক একটি তালিকা রচিত হয় মর্মে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। তালিকাটি ছিল ৪৫ জন অতিরিক্ত সচিবের জ্যেষ্ঠতাবিষয়ক। এ তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা কর্মচারীসহ ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অনুগত বা অনুগত নয় সে বিষয়টিও চিহ্নিত করা হয়। এদের মধ্যে কিছু কর্মচারীকে অবসর প্রদানের সুপারিশও করা হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ওই সময়ের ক্ষমতাসীন সরকার এ ধরনের সুপারিশ আমলে নেয়নি। ১৯৯১ সাল-পরবর্তী সময়ে যত দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বলবৎ ছিল, এ সরকারি কর্মচারীদের, বিশেষ করে মাঠপর্যায়ের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ব্যাপক রদবদলের পরিসংখ্যান মিডিয়ায় প্রচার করার বিষয় কারো অজানা নয়। সাধারণত তিনবার এ ঘটনা ঘটে। এক. রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। দুই. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর। তিন. নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ক্ষমতা গ্রহণের পর। এসংক্রান্ত পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট সময়ের প্রায় সব দৈনিকে প্রকাশ করা হয়।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে যে ব্যাপক নিয়োগ-বদলির বিষয়টি মিডিয়ায় প্রকাশিত ছিল, ওই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৪ জুলাই ক্ষমতা গ্রহণ করার পর মাঠপর্যায়ে ব্যাপক রদবদল করা হয়। এ নিয়ে মিডিয়ায় কিছু সমালোচনা হলে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে চাপের মুখে নতিস্বীকার করব না, আরো বদলি করা হবে। এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নও করা হয়। দেশের প্রায় সব থানার ওসিদের বদলিসহ ১০৯ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বদলি হয়েছিলেন। একজন গবেষক এ প্রক্রিয়ার মধ্যে বাস্তবতা ও বাস্তবতার শূন্যতার বিষয় উল্লেখ করেছেন। বাস্তবতা হলো, সব ক্ষমতাসীন দলই সংশ্লিষ্ট সময়ে ব্যাপক নিয়োগ ও বদলি করে। বাস্তবতাবিবর্জিত বিষয় হলো, সব দলই প্রশাসনে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে, তা নিশ্চিত করে না। রাজনৈতিক দলগুলো কিভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, সে বিষয়টি কমবেশি সবার অজানা। তবে এ সম্পর্কে কিছু তথ্য হয়তো সংশ্লিষ্ট সময়ে সচিবালয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা দিতে সক্ষম। এ বিষয়ে অতীতের সংস্থাপন (জনপ্রশাসন) সচিবের কিছু অভিজ্ঞতা উল্লেখ করা যায়। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ওই সময়ের সাবেক বিরোধী দলের একজন প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সংস্থাপন সচিবকে ফোনে একটি জেলা সদরের নির্বাহী কর্মকর্তাকে বদলি করতে অনুরোধ করেন। সচিব এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অপারগতার বিষয় উল্লেখ করেন। কারণ বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এখতিয়ারভুক্ত। এর দু-তিন দিন পর তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে এসে সংস্থাপন ও মন্ত্রিপরিষদসচিবকে ডেকে পাঠান, অন্যান্য বিষয় আলাপের পর প্রধান উপদেষ্টা একটি চিরকুট সংস্থাপন সচিবকে দিয়ে ওই প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক মন্ত্রীর অনুরোধ সম্পর্কে জানতে চান। সংস্থাপন সচিব ও মন্ত্রিপরিষদসচিব একই মত পোষণ করে বদলি না করার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। এরপর আর কিছু হয়নি। এরপর অন্য দল থেকেও এ ধরনের আরো কিছু ঘটনা ঘটে, যা প্রধান উপদেষ্টা পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু কোনো অনুরোধই রক্ষা করা হয় না।
সংসদীয় শাসন কাঠামোর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য সরকারি কর্মচারীদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা। যুক্তরাজ্যের কাঠামোই আমরা গ্রহণ করেছি। এ কাঠামোয় এ বিষয় স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানেও পরোক্ষভাবে এ বিষয় স্বীকৃত। সংবিধানের নবম ভাগে সরকারি কর্মচারীর কোনো উল্লেখ নেই। এদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বিধায় এরা কোনো দলের অনুগত নয় বা হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীদের শপথে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয় যে ‘ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’ বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রীয় কার্যপরিচালনার ক্ষেত্রে বাস্তবতা ভিন্নতর। ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে দলীয় আনুগত্যই সরকারি তথা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য হয়েছে। নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়ে সংবিধানে আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতার বিষয় উল্লেখ করা হলেও তা করা হয়নি। তবে ২০১১ সাল থেকেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে একটি আইনের খসড়াও প্রস্তুত হয়। সরকারি নীতিনির্ধারকরা ঘোষণা দেন যে ২০১১ কি ২০১২ সালের মধ্যে খসড়া বিল সংসদ বিবেচনা করে চূড়ান্ত করবে। যথারীতি খসড়াটি মন্ত্রিসভায় আলোচনাও হয়। মন্ত্রিসভা খসড়াটি পরীক্ষা করে আবার মন্ত্রিসভায় পেশ করার নির্দেশও মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এ নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে খসড়াটি আবার সংশোধন করা হয়। খসড়ার শিরোনাম ছিল—‘সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৪ (সংশোধিত) খসড়া’। তবে খসড়ায় বলা হয় যে প্রস্তাবিত আইন ‘সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৩’ নামে অভিহিত হবে। খসড়া আইনের ৭ ধারায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়নের বিষয়েও খসড়া আইনে করণীয় কী, তা বলা হয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা ও পেশাগত জ্ঞানকে সাধারণ ভিত্তি হিসেবে গণ্য করার বিষয় উল্লেখ করা আছে। তবে সংবিধান অনুযায়ী নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের জন্য সমান সুযোগের শর্তও খসড়ায় দেওয়া হয়। খসড়ার ৯ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে সরকারি কর্মচারীরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবেন না এবং নিরপেক্ষভাবে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করবেন। এ খসড়া চূড়ান্তভাবে সংসদে অনুমোদিত না হলে দলীয় আনুগত্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দূর হবে না। আলোচ্য বিধানের (খ) উপধারায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে বলা হয় যে তাঁরা আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবেন। এ প্রক্রিয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো আদেশ প্রচলিত আইন বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে বিষয়টি উপযুক্ত কারণ উল্লেখ করে আদেশ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। এ ধরনের আপত্তি বা অপারগতা শাস্তিযোগ্য অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে না।
দলীয় আনুগত্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন বিরাজ করছে। এমনটাই আশঙ্কা করেছেন ফেব্রুয়ারি ২২-এ প্রকাশিত খবরের প্রতিবেদক। এ সংবাদের শিরোনাম ছিল—‘প্রশাসনে বিএনপিপন্থীদের এখনো সুদিন’। প্রধান মন্তব্য—‘পরীক্ষিত কর্মকর্তারাও কোণঠাসা’। আসন্ন নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতেই এ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা