সিন্ডিকেটের ৬শ জনের তালিকা মন্ত্রণালয়ে

কয়েকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি নিত্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। মানুষের চাহিদাকে পুঁজি করে সিন্ডিকেটগুলো নানা কৌশলে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। কুরবানির ঈদ সামনে রেখে এরা বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পেঁয়াজ, আদা, রসুন, জিরাসহ মসলাজাতীয় পণ্যের বাজারও এখন আকাশচুম্বী। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও সিন্ডিকেটগুলো ডলার সংকট, এলসি সমস্যাসহ নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। গত রমজানেও সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নিত্যপণ্যের বাজার।মসলাজাতীয় পণ্য ছাড়াও চিনি, ভোজ্যতেলের বাজারও অস্থির করে রাখে তারা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনও পাইকারি বাজারে সিন্ডিকেট থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। এরই মধ্যে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটের বিভিন্ন পর্যায়ের ৬০০ জনের তালিকা তৈরি করেছে প্রশাসন। তালিকা ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিলেই তাদের বিরুদ্ধ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।শনিবার ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ পরিদর্শন করেন প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী। এ সময় তিনি দেখেন সরকার নির্ধারিত চিনির দামের বিষয়ে বিক্রেতা নিজেই জানেন না। আহাদ ট্রেডিংয়ের বিক্রেতা আবু তাহের ১২৬ টাকা ক্রয় দেখিয়ে বিক্রি করছেন ১৪৭ টাকা। পাইকারি ব্যবসায়িরা ডিও কেনাবেচার রসিদ দেখাতে ব্যর্থ হন। হাতবদলের সময় কত কমিশন পান, এর চালানও দেখাতে পারেননি তারা।এ সময় প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বেশকিছু অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। একটি পণ্য আমদানিকারকের গুদাম থেকে খাতুনগঞ্জের কমিশন এজেন্টের হাতে আসতে ৮ থেকে ১০ বার হাতবদল হচ্ছে। সব পক্ষ ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে পরের জনের কাছে বিক্রি করছে। বারবার হাতবদলের কারণেই নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এ কারণে যে কোনো নিত্যপণ্য ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে কয়েক গুণ দাম বাড়ছে। এছাড়া আমদানিকারক ও কমিশন এজেন্টের সম্পর্ক নিয়েও অস্বচ্ছতা রয়েছে।সংশ্লিষ্টরা জানান, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে পৃথক সিন্ডিকেট রয়েছে। চিনির সিন্ডিকেট শুধু চিনি নিয়ে কারসাজি করে। পেঁয়াজের সিন্ডিকেট শুধু পেঁয়াজের বাজারে কারসাজি করে। আর মসলার সিন্ডিকেট মসলার বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।দীর্ঘদিন চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) ব্যবসার প্রচলন রয়েছে। ডিও প্রচলনের কারণে বেশির ভাগ সময় নিত্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ে। কোনো পণ্যের লেনদেন ছাড়াই একটি ডিও কয়েক দফা হাতবদল হয়। যতবার হাতবদল হয়, ততবার ডিও বা পণ্যের দামও বেড়ে যায়। চিনি কিংবা অন্য কোনো পণ্য কেনাবেচায় ডিও বেচাকেনার মাধ্যমে বিভিন্ন আগাম লেনদেন হচ্ছে। দেখা যায়, পণ্য হাতে না পেলেও ওই স্লিপটিই বেচাকেনা হচ্ছে। কোনো কোম্পানি বাজার থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্যের ডিও কিনে নেয়।

যে দরে ডিও কেনা হয়, এর বাজার দর যদি বেড়ে যায়, তখন পণ্যটি ডেলিভারি দিতে তারা গড়িমসি করে। আবার দেখা যায়, কোম্পানির পণ্যই আসেনি; কিন্তু ডিও কিনে রেখেছেন অনেক বেশি। এর ফলে কোম্পানি বাজারে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারে না। তাই এসব পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এক্ষেত্রে চিনির ডিও বেচাকেনা বেশি হয়।সিন্ডিকেটের কারণে মসলার দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। কুরবানিকে ঘিরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে মসলার বাজার। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা এলাচের দাম পড়েছে কেজিপ্রতি গড়ে ৮০০ টাকার কিছু বেশি। কিন্তু পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টাকার বেশি। ব্যবসায়ীরা কেজিতে প্রায় দ্বিগুণ লাভ করছেন। প্রতি কেজি আদার আমদানি মূল্য ১০১ টাকার মতো। তবে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। প্রতি কেজি আদা আমদানি মূল্যের চেয়ে তিনগুণ দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। একইভাবে মুনাফা করছেন জিরা, লবঙ্গ, রসুন, দারুচিনি, হলুদ, মরিচ, জয়ত্রিসহ অন্য মসলায়ও। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, আমদানি কম হওয়ায় পণ্যের দাম বাড়ছে। কিন্তু বন্দরের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এবার মসলা বেশি আমদানি হয়েছে।চলতি বছরের পাঁচ মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রায় ২৫ হাজার টন রসুন আমদানি হয়েছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় তা প্রায় ৯ হাজার টন বেশি। গত বছরের তুলনায় এবার আদা বেশি এসেছে ৪০ শতাংশ। একইভাবে লবঙ্গ ৩০, মরিচ ১১ ও রসুনের আমদানি বেশি হয়েছে ৩৫ শতাংশ। গতবারের তুলনায় গড়ে প্রায় দ্বিগুণ আমদানি হয়েছে মসলা। তবুও আমদানি মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি মসলাজাতীয় পণ্য।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি লবঙ্গের দাম বেড়েছে ১০০ টাকার বেশি। এখন দাম ১ হাজার ৬০০ টাকা। তবে প্রতি কেজি লবঙ্গের আমদানি মূল্য ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। এক সপ্তাহ আগের তুলনায় এলাচের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। এর আমদানি মূল্য গড়ে ৮১৫ টাকা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি গোলমরিচ বিক্রি হচ্ছে ৬৬০ টাকা। এক সপ্তাহ আগের তুলনায় কেজিতে ৬০ টাকা বেড়েছে। পাইকারি বাজারে একইভাবে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে জিরা, দারুচিনি ও জয়ত্রি। বর্তমানে দারুচিনি ৩২০ টাকা, জিরা ৭৭০ টাকা, জয়ত্রি ৩ হাজার ২০০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। গত সপ্তাহেও এসব মসলার দাম কেজিতে ৩০ থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত কম ছিল। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আদার দাম। এক মাস আগেও মিয়ানমারের প্রতি কেজি আদা ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। এখন দাম দ্বিগুণ, বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়।চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের শক্তিশালী সিন্ডিকেটে ৬০০ সদস্যের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, আমরা বাজার পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খোঁজখবর নিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে বিভিন্ন সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকার চিত্র পেয়েছি, যারা নানা কৌশলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায়। কোনো উৎসব-পার্বণ সামনে রেখে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ ধরনের সিন্ডিকেটের বিভিন্ন স্তরের ৬০০ সদস্যের একটি তালিকা জেলা প্রশাসন তৈরি করেছে। সেই তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশেনা এলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Advertisement